মো. গনি মিয়া বাবুল: মুহম্মদ আলতাফ হোসেন, তিনি জাতীয় সংবাদিক সংস্থার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। মূলত ১৯৮২ সালে ১২ ফেব্রুয়ারি তার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা হয় দেশের তৃণমূল সাংবাদিকদের সংগঠন ‘জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা’। দেশের স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে কর্মরত সব স্তরের সাংবাদিকদের সুরক্ষা, পেশাগত মানোন্নয়ন, তাদের অধিকার সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই সংগঠন ৪৩ বছর ধরে সফলভাবে প্রশসনীয় কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। এই সংগঠনের প্রথম থেকেই শ্রদ্ধেয় আলতাফ ভাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তার সাথে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৯৩ সালের সম্ভবত অক্টোবর মাসে এক অনুষ্ঠানে। গাজীপুর জেলা শাখা জাতীয় সাংস্থার কমিটি গঠনকল্পে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে তিনি প্রধান অতিথি ছিলেন এবং তখন তিনি দৈনিক ইনকেলাব পত্রিকায় কর্মরত ছিলেন। এই অনুষ্ঠানে সংগঠনের জেলা কমিটির গঠন করা হয়। আমাকে এই জেলা কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি মনোনিত করা হয়। আমি তখন দৈনিক খবর পত্রিকায় গাজীপুর জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলাম। দৈনিক জনতা পত্রিকায় কর্মরত মো. সরু মিয়াকে সভাপতি এবং দি নিউ নেশন পত্রিকার গাজীপুর জেলা প্রতিনিধি মো. নজরুল ইসলাম বাদামীকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
সেই সময় থেকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে আলতাফ ভাইয়ের সাথে আমার পথ চলা শুরু। দীর্ঘ প্রায় ৩২ বছর ধরে আমি ও আলতাফ ভাই পারস্পরিক সুখে-দুঃখে সব সময় সাংগঠনিক বিষয়াদি ছাড়াও ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বহু বিষয় বিনিময় করেছি। আলতাফ ভাইয়ের বড় ছেলে মো. মনির হোসেন যখন ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়, তখন সম্ভবত এই খুশির সংবাদটি প্রথমে আলতাফ ভাই আমাকে জানান। মনির হোসেন সফলতার সাথে এমবিবিএস পাশ করার পর নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে এমপিএইচ সম্পন্ন করে। সে বর্তমানে ‘ইউএনএফপিএ’র বাংলাদেশের কান্ট্রি প্রোগ্রাম অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। তার কনিষ্টপুত্র মুহম্মদ মনঞ্জুর হোসেন এমবিএ ডিগ্রী সম্পন্ন করার পর বর্তমানে সিটি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত আছে। কাজেই বলা যায়, আলতাফ ভাই একজন সফল পিতা। তার ছেলেদের লেখাপড়ার বিষয়টি আমাকে অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ করে।
শ্রদ্ধেয় আলতাফ ভাই আমার গ্রামের বাড়িতে স্থানীয় মসজিদ কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত বার্ষিক ওয়াজ মাহফিলে ১৯৯৮ সালে ও ২০০৪ সালে আমার আমন্ত্রণে অংশ নিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলায় আমার জন্মস্থান টেপিরবাড়ী গ্রামে এলাকাবাসীর উদ্যোগে ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত মসজিদ কমিটিতে আমাকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ১৯৯৫-২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর মসজিদ কমিটি ও স্থানীয় লোকজনের উদ্যোগে আমার সভাপতিত্বে বার্ষিক ওয়াজ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। ঐ দুটি বার্ষিক ওয়াজ মাহফিলে অংশগ্রহণের পর আমার পিতাসহ পরিবারের অন্যান্যদের সাথে আলতাফ ভায়ের পরিচয় হয়। এরপর থেকে আলতাফ ভাই আমার কুশলাদি জানার পর প্রতিনিয়ত আমার পরিবারের সদস্যদের খোঁজ-খবর নিতেন। আমার এলাকায় আমার উদ্যোগে ২০০২ সালে ‘বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ’ বিতরণ অনুষ্ঠানে আলতাফ ভাই বিশেষ অতিথি হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন। আমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই আয়োজনে প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. আব্দুল হান্নান। যত দূর মনে পড়ে আলতাফ ভাই সাংগঠনিক কাজ শেষে স্বল্প সময়ের জন্যে আরো দুই বার আমার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ছিলেন। আলতাফ ভাই আমার ঢাকার বাসতেও বহু বার আমার আমন্ত্রণে এসেছেন। আমিও বহু বার আলতাফ ভাইয়ের বাসায় গিয়েছি এবং আলতাফ ভাইয়ের সাথে খেয়েছি। রমজান মাসে ইফতার মাহফিলে তার বাসায় আমন্ত্রণে অংশ নিয়েছি। তিনি আমাকে খুবই ভালবাসতেন, তিনি হৃদয়-অন্তরে আমাকে খুবই পছন্দ করতেন। তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা সবসময়ই ছিল এবং তা অব্যাহত থাকবে। কারণ, আলতাফ ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল আদর্শিক। এই আদর্শ হচ্ছে মানবকল্যাণের ও সৃজনশীল নান্দনিক কাজের।
তিনি একজন নান্দনিক ও সৃজনশীল মানুষ ছিলেন। তার নানা সীমাবদ্ধতা থাকার পর তিনি সৃজনশীল কাজে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। তিনি একজন সাংস্কৃতিকমনা মানুষ ছিলেন। বিভিন্ন সাংস্কৃতি সংগঠনের সাথে তিনি সক্রিয়ভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। সংবাদপত্রে নিউজ, ভিউজ, প্রবন্ধ, নিবন্ধন ছাড়াও তিনি কবিতা ও ছড়া লেখতেন। বাংলাদেশ লেখক সমিতির সাথে তিনি সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এই সংগঠনের মাসিক আড্ডা ও সাহিত্য সভা জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা ১৪ পুরানাপল্টনস্থ কার্যালয়ে দীর্ঘ দিন যাবত অনুষ্ঠিত হয়। তখন এই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন দেশের আরেকজন প্রবীণ সাংবাদিক ফরহাদ খাঁ। এছাড়া আলাপন সাহিত্য সংগঠন আলতাফ ভাইয়ের নেতৃত্বে গঠিত হয়।
১৯৯৫ সালে ঢাকা মহানগরের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে যথারীতি আমি যোগ দেই। এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই বিকালে বা সন্ধ্যায় জাতীয় সাংবাদিক সংস্থার অফিসে আমার যাতায়াত ছিল। আলতাফ ভাইয়ের সাথে প্রায় প্রতিদিনই আমার দেখা হত। সাংবাদিকতার বিভিন্ন নিয়মাবলি ও আচরণবিধি আমি আলতাফ ভাইয়ের কাছ থেকে জেনেছি বা শিখেছি। সেই সময় জাতীয় সাংবাদিক সংস্থার উদ্যোগে নিয়মিত সাংবাদিক প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হত। আমি অনেকগুলো সাংবাদিক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় প্রথম দিকে প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং পরবর্তী রিসোর্সপার্সন বা প্রশিক্ষক হিসেবে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। জাতীয় সাংবাদিক সংস্থার উদ্যোগে ঢাকায় জাতীয় পর্যায়ে এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আলতাফ ভাইয়ের সাথে আমি অংশ নিয়েছি।
আমার জানা মতে, আলতাফ ভাই একজন ভাল মানুষ, তিনি একজন নির্লোভ, নিরঅঙ্ককার ও পরোপকারী মানুষ ছিলেন। সীমিত সামর্থের মধ্যে থেকেও তিনি অন্যের উপকার করার চেষ্টা করতেন। তিনি সর্বদা হাসি-খুশি থাকতেন। আমি তার চেয়ে বয়সে কনিষ্ঠ কিন্তু তিনি সর্বদা আমার সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করতেন। আমি ১৯৯৫ সালে পেশাগত কারণে ঢাকায় আসার পর প্রথমে আমাকে জাতীয় সাংবাদিক সংস্থার সাধারণ পরিষদ সদস্য এবং আলতাফ ভাইয়ের পরিচালনাধীন বাংলাদেশ নিউজ সিন্ডিকেটের (বিএনএস) স্টাফ রিপোর্টার পদে নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র দেয়া হয়। পরবর্তী ১৯৯৬-২০০৮ সাল পর্যন্ত আমি জাতীয় সাংবাদিক সংস্থার স্থায়ী পরিষদের সদস্য সচিব ছিলাম। পরবর্তী ২০০৮-২০১৪ সাল পর্যন্ত আমাকে জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা সিনিয়র সহসভাপতি করা হয়। এরপর ২০১৪-২০১৬ সাল পর্যন্ত আমাকে জাতীয় সাংবাদিক সংস্থার নির্বাহী সভাপতি করা হয়। পরবর্তী ২০১৬-২০২৩সাল পর্যন্ত জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা সর্বোচ্চ পরিষদের (স্থায়ী পরিষদ) চেয়ারম্যান হিসেবে আমাকে আলতাফ ভাই মনোনীত করেন; যা সর্বসম্মিতিক্রমে অনুমোদিত হয়। এরপর ২০২৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর আমাকে জাতীয় সাংবাদিক সংস্থার প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে আলতাফ ভাইয়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সর্বস্মতিক্রমে মনোনিত করা হয়।
উল্লেখ্য যে, জাতীয় সাংবাদিক সংস্থার উল্লেখিত গুরুত্বপূর্ণ পদে আলতাফ ভাই স্বপ্রণোদিত হয়ে আমাকে মনোনয়ন দেন। আমাকে জাতীয় সাংবাদিক সংস্থার কোন পদে মনোনিত করার জন্যে আমি আলতাফ ভাইকে কিংবা অন্য কাউকে কখনো বলেনি। আলতাফ ভাই নিজ ইচ্ছায় উল্লেখিত পদে আমাকে মনোনীত করেন এবং আমাকে সম্মানিত করেছেন। এই জন্য তার প্রতি জানাই কৃতজ্ঞতা।
উল্লেখ্য যে, দেশের সুপরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত বৃহত্তম বার্তা সংস্থা ‘ফেয়ার নিউজ সার্ভিসের (এফএনএস) নির্বাহী সম্পাদক পদে আলতাফ ভাইয়ের সুপারিশে কর্তৃপক্ষ আমাকে ২০১২সালে নিয়োগ দেয়। এই পদে দীর্ঘ দিন আমি সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেছি।
উল্লেখ্য যে, আলতাফ ভাই প্রতিষ্ঠালগ্ন এফএনএসের প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সাংবাদিকতায় আমার সফলতার পেছনে আলতাফ ভাইয়ের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। এই জন্যে তার প্রতি ফের শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা।
আমাদের প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় মুহম্মদ আলতাফ হোসেন গেল ১৪ অক্টোবর দিবাগত রাতে ঢাকার মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। তার আত্মার মাগফেরাত ও তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন, আমিন।
লেখক: শিক্ষক, গবেষক, কলাম লেখক, সমাজসেবক ও সংগঠক, ঢাকা।
সিএন/আলী
Views: 2
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন