মোহনা জাহ্নবী: আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই থাক বা না থাক, আমাদের সবারই একটা করে পরিবার আছে, হোক তা ছোটো কিংবা বড়। পরিবারের প্রতিটা মানুষই আমাদের সবচেয়ে বেশি আপনজন। আর পরিবারের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ্য মানুষগুলো আমাদের মাথার ছাদ। যেখানে থাকি যেভাবেই থাকি, তারা বেঁচে থাকলে মনে হয় মাথার ওপর ছাদটা বেঁচে আছে আমাদের। তারা সত্যিই আমাদের আশ্রয়, তারা আমাদের জীবনের কারিগর।
তারা তাদের জীবনের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে আমাদের সুন্দরভাবে গড়ে তোলে, আমাদের একটা নিশ্চিন্ত জীবনের রূপকার তারা। তারা তাদের সুখযাপনের কথা না ভেবে, শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত আমাদের দিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকে সবসময়। একসময় তারা আমাদের সত্যিই বড় করে তোলে, কিন্তু আমরা মানুষের মতো মানুষ হই কি! পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ্য লোকটা, হোক সে আমাদের বাবা-মা কিংবা দাদা-দাদী, তারা আমাদের জন্য কতো কিছুই না করেন। অথচ যখন তারা বৃদ্ধ হয়ে যান, আমরা কতোটুকু করি তাদের জন্য। বাবা-মা সন্তানকে লালন পালন করে বড় করে তোলেন, দিন রাত জেগে বসে থাকেন সন্তানদের পাশে, তারপর একেকটা সন্তান গ্রাজুয়েট হয়ে বের হয়, স্বাবলম্বী হয়। তখন থেকেই ভাঙনের শুরু।
যতোদিন আমরা আত্মনির্ভরশীল না হই, বাবা-মা’র রক্ত চুষে খাই। তারপর আত্মনির্ভরশীল হয়ে গেলেই বন্ধন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসি। আমরা ভুলে যাই আমাদের জীবনে তাদের একনিষ্ঠ অবদানের কথা। কোনো কোনো সন্তানকে বাবা-মা বসতভিটে বিক্রি করে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে পাঠান। সেই সন্তান সেখানে গিয়ে তার জীবন টিপটপ ভাবে গুছিয়ে নেয়, ভুলে যায় দেশে ফেলে আসা বাবা-মায়ের কথা। যে বাবা-মা তার সন্তানদের একটু জ্বর হলেও সারারাত জেগে সেবা করেছেন একসময়, সে বাবা-মা’ই তাদের মৃত্যুশয্যায় এক ফোঁটা পানি মুখে দেবার জন্য তাদের সন্তানদের পাশে পাননা। তবু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তারা সন্তানদের সুখ কামনা করে যান। মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় হয়ে পড়ে কখন জানেন? যখন সে বৃদ্ধ হয়ে যায়। বয়সের সাথে সাথে তার কর্মস্পৃহা শেষ হয়ে যায়, শেষ হয়ে যায় তারুণ্য কিংবা যৌবনে ফেলে আসা সমস্ত উদ্দামতা। একটা সময় শরীর নুয়ে পড়ে বয়সের ভারে, তখন নিজ হাতে খাবারটা মুখে তুলে খাওয়ার মতোও সামর্থ্য থাকেনা অনেকের। সে বাবা-মা’কে ফেলে আমরা চলে যাই ব্যাক্তিগত সুখ সন্ধানে, যে বাবা-মা কিনা একদিন ঘন্টার পর ঘন্টা আমাদের রূপকথার গল্প শুনিয়ে, আমাদের পেছনে বাড়িময় ছুটোছুটি করে আমাদের মুখে খাবার তুলে দিতো। আমরা কর্মজীবন আর ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে এতো বেশি ব্যাস্ত হয়ে পড়ি যে, আমরা আমাদের সবচেয়ে কাছের মানুষগুলোকেই দূরে সরিয়ে দেই। আমরা ভুলে যাই, শুধুমাত্র আমাদের ভালো রাখবার জন্য তারা একসময় তাদের ব্যাক্তিগত জীবনের সমস্ত সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করেছিলো হাসিমুখে।
বৃদ্ধ বয়সে সবাই খুব একা হয়ে পড়ে। আমরা যে যার মতো নিজেদের জীবন নিয়ে মুখিয়ে থাকি। তারা একেকটা দিন গুমড়ে মরে ঘরের কোণে। আমরা তার খবরও রাখিনা। অথচ তাদেরও একসময় কতো সঙ্গ ছিলো, কতো রঙিন জীবন ছিলো। সে দিনগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে একলা ঘরের কোণে তাদের চশমার কাঁচ দুটো ঝাঁপসা হয়ে আসে। আমাদের সময় কই সে খবর রাখার! এতোটা একাকীত্বে কাটে তাদের জীবন যে, একসময় তারা প্রার্থনা করতে থাকে রোজ এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার। কতোটা অসহায়ত্ব ঘিরে ধরলে মানুষ মৃত্যু কামনা করে, ভাবতে পারেন! আমরা তাদেরকে পরিবারের বোঝা ভাবি, অথচ তারাই যে আমাদের মাথার ছাদ। তাদের শূন্যতাটা ঠিকই বোঝা যায়, যখন তারা আমাদের ছেড়ে চলে যায়। কারন ছাদ না থাকলেই কেবল বোঝা যায়, আকাশ নামক ছাদের রোদের তীব্রতা কতোটা!
আজকাল যে এতো বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বেড়ে গেছে, কেনো জানেন? কারন আমরা শিক্ষিত হওয়ার নামে অমানুষ হয়ে যাচ্ছি দিনেদিনে। জরিপ করে দেখা গেছে, বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে শিক্ষিত ও কর্মজীবি সন্তানদের বাবা-মা’র সংখ্যাই বেশি। তারা তাদের চাকুরি জীবন আর সংসার নিয়ে এতোটা হিমসিম খেয়ে যায় যে, তখন পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ্য মানুষটাকে তাদের কাছে বাড়তি ঝামেলা কিংবা আবর্জনার মতো মনে হয়। তাই তারা দায়িত্ব এড়াতে তাদের রেখে যায় বৃদ্ধাশ্রমে কিংবা অচেনা কোনো মাঝপথে অনিশ্চিত জীবনের দিকে ঠেলে দিয়ে চলে যায়। বৃদ্ধ বয়সে তাদের প্রয়োজন হয় সঙ্গ আর এক্সট্রা কেয়ার। কিন্তু আমরা তাদের সঙ্গ তো দেই’ই না বরং আত্মীয় পরিজনহীন ভীষন নিঃসঙ্গ জীবন চাপিয়ে দেই তাদের ওপর। যত্নের বদলে অনেক অনেক বেশি অবহেলা পান তারা। অথচ আমাদের তারা এতোটুকু অযত্ন কিংবা অবহেলার আঁচ লাগতে দেননি কখনো। বাংলাদেশ হোক কিংবা অন্য কোনো দেশ হোক, প্রতিটা দেশেই বৃদ্ধ বয়সের জীবনটা খুব ভয়াবহ নিঃসঙ্গতা আর অবহেলায় কাটে।Tia Walker বলেছেন- “To care for those who once cared for us is one of the highest honors”
অর্থাৎ তাদের প্রতি আমাদের যত্নবান হওয়া উচিত, যারা একদিন তাদের জীবনের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে আমাদের যত্ন নিয়েছে।
আমাদের কাছে বাবা-মা ততোদিনই গুরুত্ব পান, যতোদিন তারা নিঃস্বার্থ ভাবে আমাদের জন্য করে যেতে পারেন, যতোদিন তারা সামর্থ্যবান থাকেন। যে সময়টাতে তারা অসহায় হয়ে পড়েন, যে সময়টাতে তাদের সবচেয়ে বেশি যত্ন প্রয়োজন, যে সময়টাতে তাদের সবচেয়ে বেশি সঙ্গ দেয়া প্রয়োজন, সে সময়টাতেই আমরা তাদের চরম অবহেলায় ছুঁড়ে ফেলে দেই আস্তাকুঁড়ে। যারা নিজেদের সুখ বিসর্জন দিয়ে আমাদের সুখ নিশ্চিত করেছেন, আমরা তাদের বিসর্জন দেই আরো আরো বেশি সুখে থাকার জন্য। দিনশেষে আমরা কি সত্যিই সুখী হই?
বাবা-মা কিংবা দাদা-দাদী যেই হোকনা কেনো, পরিবারের প্রতিটা মানুষই আমাদের জন্য আশীর্বাদ, পরিবারের প্রতিটা মানুষ একেকটা হৃদস্পন্দন। একবার সেই স্পন্দনের সুতোটা ছিঁড়ে গেলে হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায় বিচ্ছেদের ক্ষত।
একটা কথা মনে রাখবেন, বাবা-মা যতোদিন বেঁচে আছে, ভাববেন সারা পৃথিবী আপনার প্রতিকূলে থাকলেও আপনার ফিরে যাওয়ার মতো একটা গন্তব্য আছে, একটা আশ্রয় আছে। তাই তাদেরকে অবহেলা না করে অনেক যত্নে ভালোবেসে আগলে রাখুন।
তাদেরকে বৃদ্ধাশ্রমে না পাঠিয়ে ঘরের প্রদীপ করে রাখুন, তারা যতোদিন বেঁচে থাকবে কোনো অন্ধকার আপনাকে ছুঁতে পারবেনা। সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে তাদের প্রাধান্য দিন। অফিস থেকে ফিরে তাদের সঙ্গ দেবার জন্য সময় তুলে রাখুন। আপনার সন্তানদেরও সুশিক্ষার মাধ্যমে বড় করে তুলুন। আপনার বাবা-মা যেনো আপনার সন্তানদের চোখের মধ্যমনি হয়ে থাকে, সেই ভালোবাসার জায়গাটুকু ওদের বুঝিয়ে দিন। দেখবেন, শেষ বয়সে কোনো নিঃসঙ্গতা ভীড় করবেনা আপনার বাবা-মা’র কাছে। তাদেরকে বোঝা না ভেবে, আশীর্বাদ ভেবে মাথায় করে রাখুন। তাদের শরীরের যত্ন নিন, মাঝেমাঝে সময় করে তাদের নিয়ে ঘুরতে যান। দেখবেন, আপনার বাবা-মা’র হাসিমুখ আপনাকে শত শত রাত আত্মতৃপ্তি নিয়ে ঘুমাতে সাহায্য করবে।
সবাই সবাইকে নিয়ে ভালো থাকুক, প্রতিটা পরিবার এক একটা পুষ্পোদ্যান হয়ে উঠুক। গড়ে উঠুক একটা সভ্য জাতি, সুন্দর সমাজ আর প্রতিটা দেশ হয়ে উঠুক একেকটা স্বর্গরাজ্য…
লেখকঃ কবি ও গল্পকারহোম ইকোনোমিক্স কলেজ, আজিমপুর।
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন