বহুদিনের মিত্র বাংলাদেশ-ভারত সরকার দুই দেশের সম্পর্ককে ‘সোনালি অধ্যায়’ বলে বর্ণনা করতো। তবে গণঅভ্যুত্থানের পর দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে যে ধরনের আমূল পরিবর্তন এসেছে তা এক কথায় অভাবিত। দুটো দেশের সরকার এখন দৃশ্যতই পরস্পরকে সন্দেহ ও অবিশ্বাস করছে, ঠিক শত্রুতা না হলেও সম্পর্ক গড়াচ্ছে বিদ্বেষের দিকে।
যে বাংলাদেশকে ভারত তাদের প্রতিবেশী বা নেইবারহুডে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র বলে দাবি করতো- সে দেশে এখন ভারতের ভিসা কার্যক্রম প্রায় বন্ধ। বাংলাদেশকে দেওয়া বিভিন্ন বাণিজ্য সুবিধাও একের পর এক বাতিল করেছে ভারত। বাংলাদেশে অবকাঠামো, জ্বালানি-সহ বিভিন্ন খাতে ভারতের বহু প্রকল্পের কাজও অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতুবি হয়ে আছে।
দিল্লির পররাষ্ট্রনীতির বিশেষজ্ঞ ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্তর বলতে কোনও দ্বিধা নেই, শুধু সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রিজম দিয়ে বাংলাদেশকে দেখেছিল ভারত আর তার জন্যই দিল্লিকে আজ চরম মূল্য দিতে হচ্ছে।
তার কথায়, ‘ভারতের একটা ঐতিহাসিক সম্পর্ক ছিল আওয়ামী লীগের সাথে এবং শেখ হাসিনার সাথে অফ কোর্স। তারপরে উনি যখন ২০০৯ জানুয়ারিতে ইলেক্টেড হয়ে আসলেন, সেই যে কাজটা শুরু করেছিলেন ভারতের সাথে সেটা ও দেশের কোনও গভর্নমেন্টই এর আগে করতে পারেনি।’
তিনি আরও জানাচ্ছেন, শেখ হাসিনা শুধু ভারতের ‘সিকিওরিটি কনসার্ন’গুলোই অ্যাড্রেস করেননি, ভারত যেভাবে ট্রেড বা কানেক্টিভিটি প্রোজেক্টগুলো চেয়েছিল সেটাও তার মতো করে আগে কোনও সরকার করেনি।
‘মানে একদম একজনের সাথেই শুধু কাজ করছি, কিন্তু সে কী করছে সেটাকে ইন্টারনাল ম্যাটার বলে ইগনোর করে যাচ্ছি- আমরা শুধু দেখছি আমাদের সাথে তো সম্পর্ক ভাল আছে, বাকিটা আমাদের কিছু যায় আসে না।’
শ্রীরাধা দত্ত বলেন, এই পুরো জিনিসটার একটা ড্রাস্টিক ট্রান্সফর্মেশন হলো ফিফথ আগস্টে। আর ঠিক তার আগে এটাও আমরা দেখেছি একটা চরম বিদ্বেষ তৈরি হচ্ছিল শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে- আর তাদের স্বাভাবিক মিত্র হিসেবে ভারতের বিরুদ্ধেও।
এরপর যখন সেই ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ভারতেই আশ্রয় ও আতিথেয়তা পেলেন, ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভটা তাতে আরও বাড়ল। সেই জায়গা থেকেই বাংলাদেশে যে একটা অদ্ভুত রাগ ভারতের ওপর তৈরি হয়েছিল- আজকের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে ঠিক সেটারই প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এই বিশেষজ্ঞ।
ভারতের অর্থনীতিবিদ ও আঞ্চলিক কানেক্টিভিটির বিশেষজ্ঞ ড. প্রবীর দে মনে করেন, ভারত যে বাংলাদেশে তাদের এই ইন্টারেস্টগুলো খরচের খাতায় ফেলে দিয়েছে তা নয়। তবে গোটা বিষয়টাকে একটা পজ বা সাময়িক বিরতির মোডে রাখা হয়েছে।
দিল্লির থিঙ্কট্যাঙ্ক আরআইএস এর এই অধ্যাপক বলেন, না, সম্পর্কটা বিগড়ে যায়নি। আমি সেটা বলবো না। সম্পর্কটা আছে … কিন্তু ব্যাপারটা এরকম যে দুটো বন্ধুর মধ্যে এখন কিছুদিন কথাবার্তা হচ্ছে না।
‘অন্যভাবে বললে, সম্পর্ক রয়েছে, কিন্তু আমরা ঠিক করেছি যে এখন কিছুদিন অন্যভাবে থাকা যাক। আমরা এখন ওয়েট করে আছি, বিশেষ করে ইন্ডিয়ার দিক থেকে, যে বাংলাদেশ কখন ফার্স্ট মুভটা করবে।’
ড. প্রবীর দে বলেন, এই ফার্স্ট মুভ বা সম্পর্কটা আবার স্বাভাবিক করতে কোনও এক পক্ষের দিক থেকে ইঙ্গিত- সেটা বোধহয় বাংলাদেশে নির্বাচনের স্পষ্ট দিনক্ষণ ঘোষণা হলে বা একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসার পরই হবে বলে ভারতের ধারণা।
তিনি বলেন, আসলে বাংলাদেশ ও ভারত দুজনে দুজনকে নিয়েই থাকতে চায়- সেটাই স্বাভাবিক, কারণ নেইবার আমরা। প্রতিবেশীকে তো আর পাল্টানো যায় না। কিন্তু এবারে যেটা হয়েছে যে একটা অদ্ভুত দৃশ্যপট তৈরি হয়েছে … দুটো দেশের মধ্যে যে রিলেশনটা একাত্তর বা তারও আগে থেকে তৈরি হয়েছিল, যেটা সরকার পরিবর্তন হলেও ভেঙে যায়নি- এবারে সেখানে আঘাতটা লাগানো হচ্ছে। কুড়ালটা ওখানে মারা হয়েছে আর কী।
পররাষ্ট্রনীতির বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্তর কথায়, আমরা (বাংলাদেশের) সব জায়গাতেই দেখি, সোশ্যাল মিডিয়াতে বা অন্য কোথাও- অসম্ভব একটা অ্যান্টি-ইন্ডিয়া রেটোরিক চলে।
‘এটা তো নিশ্চই সেখানে ইয়ুথরাই করে, কারণ ওদের একটা খুব বিতৃষ্ণা দাঁড়িয়ে গেছে, অ্যাবাউট ইন্ডিয়া। তো সেই জায়গাটা আমাদের পক্ষে বোধহয় একদম নর্মাল করা … কঠিন, কিন্তু বোধহয় অসম্ভব নয়।’
তার যুক্তি হলো, বাংলাদেশের কাছে যেহেতু সবচেয়ে স্পর্শকাতর ইস্যু পানি। সেখানে নদীর সম্পদের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করতে পারলেই সম্পর্কে ম্যাজিক ঘটানো সম্ভব।
‘যেমন ধরুন তাদের কিছু কিছু কনসার্ন আছে, আমি যেটা বিশ্বাস করি- যেমন ওয়াটার। ওটাতে কেন ইন্ডিয়া প্রোগ্রেস করেনি, কেন ওটা নিয়ে কথা বলতে রাজি হয়নি? সেই জায়গাগুলো যদি একটু দেখা যেত- তাহলে আমার মনে হয় ওদের কাছেও কিছু ইতিবাচক বার্তা পাঠাতে পারতাম।’
অর্থনীতিবিদ প্রবীর দে-র কথায়, সামনের বছর, মানে ২০২৬-এ বাংলাদেশ এলিভেট করছে ডেভেলপিং কান্ট্রি হিসেবে। এখন সেই থ্রাস্ট ওদের দরকার একটা … সেই থ্রাস্টটা পেতে গেলে … মানে একটা ফ্লাইটকে, প্লেনকে টেক-অফের সময় ওপরে উঠতে গেলে যেমন একটা থ্রাস্ট দরকার, এখানেও ঠিক তাই। নেক্সট ইয়ারে ডেভেলপিং কান্ট্রিতে ওনারা এলিভেট করার পর সেখান থেকে যদি তারপরে ফ্লাই করতে হয়, মানে লং টাইম অ্যাজ আ ডেভেলপিং ইকোনমি – তাহলে বাংলাদেশের দরকার ইন্ডিয়াকে, ভারতবর্ষকে।
তিনি বলেন, ধরুন, ওনারা যে পোর্টটা তৈরি করছেন মাতারবাড়িতে, একটা বড় ডিপ সি পোর্ট … সেই পোর্টটায় বড়জোর ৩৫% ওদের নিজেদের কার্গো যাবে – ৬৫% দরকার ইন্ডিয়া থেকে কার্গো। একইভাবে আরও বহু যে সব প্রকল্পের কথা ওনারা ভাবছেন অন ইকোনমিক ফ্রন্ট আর কানেক্টিভিটি – সেগুলোতেও ইন্ডিয়াকে খুব ভালভাবে দরকার।
তিনি আরও বলেন, তারা যদি এটা উপলব্ধি করেন এবং সেই অনুযায়ী এনগেজ করেন, তাহলে রিলেশনশিপ আবার কামব্যাক করতেই পারে।
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন