সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫

শিরোনাম

যেভাবে আবিষ্কার হলো ব্রেইল পদ্ধতি

মঙ্গলবার, আগস্ট ১৯, ২০২৫

প্রিন্ট করুন

শাহাবুদ্দিন শুভ

মানবসভ্যতার ইতিহাসে এমন কিছু মানুষ আছেন, যাদের অবদান যুগ যুগ ধরে কোটি মানুষের জীবনকে আলোকিত করেছে। বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সমাজসংস্কারক কিংবা মানবতাবাদী—তারা প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে মানবকল্যাণে কাজ করেছেন। তবে খুব কম মানুষই আছেন, যারা নিজেদের ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতাকে জয় করে সমগ্র মানবজাতির জন্য পথ দেখিয়েছেন। তাদের একজন লুই ব্রেইল (Louis Braille)—অন্ধদের জন্য ব্রেইল পদ্ধতির আবিষ্কারক।

লুই ব্রেইলের অবদান কেবল একটি লেখার পদ্ধতি উদ্ভাবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তিনি কোটি কোটি দৃষ্টিহীন মানুষের জন্য জ্ঞানের দরজা খুলে দিয়েছেন। আজ পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে অন্ধ শিশুরা তার আবিষ্কৃত পদ্ধতিতে শিক্ষা গ্রহণ করছে, স্বপ্ন বুনছে, নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলছে। সম্প্রতি লুই ব্রেইলের সমাধির সামনে দাঁড়িয়ে আমি যেন মানবতার এক অমর প্রতীকের ছায়া অনুভব করেছি।

শৈশব ও দৃষ্টিহীনতার শুরু

লুই ব্রেইল জন্মগ্রহণ করেন ১৮০৯ সালের ৪ জানুয়ারি ফ্রান্সের প্যারিসের কাছে কুপভ্রে নামের ছোট্ট একটি গ্রামে। তার বাবা ছিলেন চর্মকার। মাত্র তিন বছর বয়সে চর্মকারের যন্ত্রপাতি নিয়ে খেলার সময় দুর্ঘটনায় তার চোখে গুরুতর আঘাত লাগে। সংক্রমণের কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি দৃষ্টিশক্তি হারান।

একজন শিশু যখন চোখের আলো হারায়, তখন তার জীবন থমকে যাওয়ার কথা। কিন্তু লুই ব্রেইলের ক্ষেত্রে ঘটেছিল উল্টোটা। অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর জ্ঞানপিপাসু মন তাকে এমন এক পথের সন্ধান দেয়, যা শুধু তার জন্য নয়—বরং সমগ্র বিশ্বের দৃষ্টিহীন জনগোষ্ঠীর জন্য আলো হয়ে জ্বলে ওঠে।

ব্রেইল পদ্ধতির আবিষ্কার

মাত্র ১৫ বছর বয়সে লুই ব্রেইল আবিষ্কার করেন ছয় বিন্দুর সেই জাদুকরি লিপি, যা ইতিহাসে ‘ব্রেইল পদ্ধতি’ নামে অমর হয়ে আছে। মূলত সেনাবাহিনীর জন্য তৈরি ‘নাইট রাইটিং’ নামের এক ধরনের স্পর্শনির্ভর লিপি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি এটিকে সহজ ও ব্যবহারযোগ্য করেন।

ব্রেইল লিপির মূল কাঠামো ছয়টি বিন্দুর সমন্বয়ে তৈরি। এই বিন্দুগুলোর ভিন্ন ভিন্ন বিন্যাসে গঠিত হয় অক্ষর, সংখ্যা, বিরামচিহ্ন, এমনকি সঙ্গীতলিপিও। এটি এতটাই কার্যকরী হয়ে ওঠে যে দৃষ্টিহীনরা কেবল বই পড়তেই নয়, বরং লিখতেও সক্ষম হয়। আজ পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে ব্রেইল পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়—সবখানেই এটি অন্ধদের শিক্ষার প্রধান মাধ্যম।

অন্ধদের জীবনে ব্রেইলের অবদান

ব্রেইল পদ্ধতির কারণে অন্ধরা আজ শিক্ষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, সঙ্গীত, এমনকি প্রশাসনিক কাজেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারছে। পৃথিবীর বহু দৃষ্টিহীন মানুষ উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছে, পেশাজীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সমাজে নেতৃত্ব দিয়েছে।

একজন অন্ধ শিশুর কথা কল্পনা করুন, যিনি বই হাতে নিয়ে আঙুল বুলিয়ে পড়ছেন—এটি সম্ভব হয়েছে লুই ব্রেইলের কল্যাণে। তার আবিষ্কার না থাকলে হয়তো অন্ধদের জীবন এখনও সীমাবদ্ধ থাকত মৌখিক শিক্ষা বা অন্যের ওপর নির্ভরশীলতায়। বলা যায়, ব্রেইল পদ্ধতি শুধু একটি লিপি নয়, এটি অন্ধ মানুষের কাছে আত্মনির্ভরতার চাবিকাঠি।

সমাধি দর্শনের অনুভূতি

সম্প্রতি আমার সৌভাগ্য হয়েছিল প্যারিসে লুই ব্রেইলের সমাধি ও মূর্তি দর্শনের। সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, আমি যেন এক মহামানবের সামনে দাঁড়িয়ে আছি—যিনি আলো না দেখেও কোটি মানুষের জীবনে আলো জ্বালিয়েছেন। তার কবরের নীরব পরিবেশে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল, এ মানুষটি যদি না থাকতেন, তবে কত অন্ধ মানুষ হয়তো জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত থাকত। হৃদয়ে কৃতজ্ঞতা আর শ্রদ্ধার এক অদ্ভুত মিশ্রণ কাজ করছিল।

এটি ছিল এক গভীর মানবিক অভিজ্ঞতা। আমি উপলব্ধি করেছি—মানুষের প্রকৃত মহত্ত্ব দেহে নয়, চেতনায়; চোখে নয়, হৃদয়ে।

শিক্ষা ও মানবতার বার্তা

লুই ব্রেইলের জীবন আমাদের শেখায়—শারীরিক সীমাবদ্ধতা কোনোদিন মানুষের সম্ভাবনাকে আটকে রাখতে পারে না। প্রতিকূলতাকে জয় করেই তিনি প্রমাণ করেছিলেন, সংকটই মানুষকে মহত্ত্বের পথে ঠেলে দেয়। আজ আমরা যারা চোখ দিয়ে বই পড়ি, পৃথিবী দেখি, তাদের হয়তো কখনো উপলব্ধিই হয় না দৃষ্টিহীন মানুষের কষ্টের। কিন্তু ব্রেইল পদ্ধতির কারণে সেই সীমাবদ্ধতা আজ অনেকটাই দূর হয়েছে।

মানবতার সেবায় লুই ব্রেইলের অবদান তাই অনন্য। তিনি শুধু একটি লিপি আবিষ্কার করেননি, তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন অন্ধ সম্প্রদায়ের মানবিক মর্যাদা ও আত্মসম্মান।

১৮৫২ সালের ৬ জানুয়ারি লুই ব্রেইল পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। কিন্তু তার সৃষ্টি তাকে অমর করে রেখেছে। আজ কোটি কোটি দৃষ্টিহীন মানুষ যখন বই পড়ছে, লিখছে বা নিজেদের স্বপ্ন পূরণের পথে হাঁটছে, তখন প্রতিটি মুহূর্তে লুই ব্রেইল তাদের হৃদয়ে জীবিত হয়ে আছেন।

লুই ব্রেইল শুধু একজন আবিষ্কারক নন; তিনি মানবতার প্রতীক, আত্মনির্ভরতার দূত এবং আলোহীন জগতের প্রদীপ।

লেখক: ফ্রান্সপ্রবাসী সাংবাদিক, লেখক ও কলামিস্ট

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন