শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

যে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিতে ঝুঁকি কম

শুক্রবার, অক্টোবর ৬, ২০২৩

প্রিন্ট করুন
জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি

কামরুন নাহার: সন্তান পিতা-মাতার কাছে পৃথীবিতে শ্রেষ্ঠ উপহার। তবে কিছু কিছু সময় চারপাশের পরিবেশগত কারণে কিছু সমস্যা ও উপযুক্ত সময়ের জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ করা হয়। তবে এটি এমন একটি সেনসেটিভ বিষয় সঠিক পদ্ধতি ব্যবহার না করলে পরে স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিতে পারে।

আমাদের সমাজে অনেকে একটা সন্তান নেওয়ার পরে বিরতি নিতে চান। কেউ দুইটি সন্তান আছে তাই আর সন্তান নিতে চাচ্ছেন না। এমতাবস্থায়, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কোনটি ভালো কিংবা আপনার জন্য কোনটি ভালো হবে তা জেনে নেওয়া জরুরী।


বয়স ও চাহিদা ভেদে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি একেক রকম হয়ে থাকে। কোন পদ্ধতি আপনার জন্য উপযোগী সেটা জানার জন্য আপনাকে অবশ্যই অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। এছাড়া জেলা উপজেলা পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্য কর্মীদের পরামর্শ নিতে পারেন। আপনাদের সুবিধার্থে বাংলাদেশে জন্ম নিয়ন্ত্রণের ভালো ও প্রচলিত পদ্ধতি সমূহ নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা।

জন্মনিয়ন্ত্রণ কি?
গর্ভাবস্থা প্রতিরোধ বা এর সম্ভাবনাকে প্রতিরোধ করতে যে সকল পদ্ধতি বা কৌশল গ্রহণ করা হয় তাকে জন্মনিয়ন্ত্রণ বলা হয়।

এটি হতে পারে ডিভাইস নির্ভর অথবা ঔষধ নির্ভর। কোন জন্মনিয়ন্ত্রক পদ্ধতি আপনার জন্য উপযোগী বা ভালো হবে সেটা জানার জন্য অবশ্যই আপনার ব্যক্তিগত ডাক্তারের সাথে কথা বলে নেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে এমন অনেক পদ্ধতি আছে যেগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত আবার ঝুকিও কম। চিকিৎসাগতভাবে বিশ্বাসযোগ্য এসব পদ্ধতি থেকে এমন একটি পদ্ধতি বেছে নেওয়া উচিত যেটা আপনার স্বাস্থ্য ও সন্তান নেওয়ার উপর নির্ভর করবে আপনাকে বিভিন্ন যৌন রোগ থেকেও রক্ষা করবে।

জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে কেন জানবেন?
বিবাহিত জীবনে সঠিক একটি পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি পারে আপনাকে সুস্থ ও সুন্দর একটি জীবন উপহার দিতে। পরিবার পরিকল্পনার একটি অংশ হলো জন্মনিয়ন্ত্রণ। সঠিকভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি জানা থাকলে আপনি আপনার পরিকল্পনা মাফিক পরিবার সাজাতে পারবেন। অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না।

এছাড়া জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি আপনার শুধু জন্মনিয়ন্ত্রণই করে না, আপনাকে যৌনবাহিত রোগ প্রতিরোধেও সাহায্য করবে।
বাংলাদেশ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার

পরিবার পরিকল্পনার তথ্যনুযায়ী বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালে জন্মদানে সক্ষম দম্পতিদের মধ্যে মাত্র ৮ শতাংশ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৩.১ শতাংশ। শহরের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলের নারীরাও জন্মনিয়ন্ত্রণের আওতায় আসছে।

বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় জন্মনিয়ন্ত্রণে খাবার বড়ি, ইনজেকশন ও কনডম বেশি জনপ্রিয় বা সহজলভ্য। এবার জানা যাক, কোন জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিটি আপনার জন্য ভালো?

কিভাবে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি চয়ন করতে হবে
জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণের আগে আপনাকে কিছু বিষয় জেনে বুঝে পদ্ধতি চয়ন করতে হবে।
• আপনার সঙ্গী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিতে রাজি কিনা। তার কাছ থেকে লুকাতে হবে কিনা।
• জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিটিতে ব্যয় কেমন
• পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কিনা
• রোগ প্রতিরোধী কিনা
• পদ্ধতিটি সহজ কিনা, এবং কত দিন পর আপনার সেটি আবার ব্যবহার করতে হবে।
• গর্ভধারণ রোধে কতটা কার্যকরী হবে পদ্ধতিটি।
• আপনার অন্যান্য চাহিদা বা উদ্বেগের কারণ আছে কিনা।যেমনঃ আপনি বুকের দুধ খাওয়ান কিনা।আপনার কাঙ্খিত সন্তান আছে কিনা যত সংখ্যক সন্তান আপনি চেয়েছিলেন।
• আপনার বয়স এবং শারিরীক অবস্থার উপর নির্ভর করেও পদ্ধতি নির্বাচন করতে হবে।

বাংলাদেশে জনপ্রিয় জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সমূহ
এখন মানুষের মাঝে সচেতনতা হার অনেকাংশেই বেড়েছে। তবে বাংলাদেশ কনডম, খাবার বড়ি এবং ইঞ্জেকশন এখনো বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এসব পদ্ধতি গুলো সহজসাধ্য বলে মানুষ সহযে এগুলো গ্রহণ করতে পারে। তবে বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের প্রকাশিত বুকলেটে স্থায়ী-অস্থায়ী মোট ৭টি জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির কথা উল্লেখ রয়েছে। পদ্ধতি গুলো হলো-
• খাবার বড়ি
• কনডম,
• জন্মনিয়ন্ত্রণ ইনজেকশন
• ইমপ্ল্যান্ট,
• আইিইউডি,
• ভ্যাসেকটমি ও
• টিউবেকটমি।

এরমধ্যে ভ্যাসেকটমি পুরুষের স্থায়ী পদ্ধতি আর টিউবেকটমি নারীদের স্থায়ী পদ্ধতি। আর অস্থায়ী দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতির মধ্যে আছে ইমপ্লান্ট ও আইউডি।

১. কনডম
কনডম হলো পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির সবচেয়ে সহজ ও জনপ্রিয় পদ্ধতি। এটি জন্মনিয়ন্ত্রণ ও যেকোনো যৌনবাহিত রোগ প্রতিরোধ করতে সবচেয়ে কর্যকর পদ্ধতি। তবে এটি ব্যবহারে পুরুষটিকে প্রতিবার সঙ্গম করার সময় কনডম ব্যবহার করতে আগ্রহী থাকতে হবে। প্রতিবার মিলনে একটি নতুন কনডম ব্যবহার করতে হবে।

২. জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি
প্রতিদিন যদি একই সময়ে সেবন করা হয় তবে ভাল ফলাফল পাওয়া যায়। জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ির কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। নির্দিষ্ট কিছু শারিরীক সমস্যা ব্যতিত সবাই এটি গ্রহণ করতে পারে। জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ির আরো কিছু সুবিধা রয়েছে যেমন, এতে রয়েছে বেশ কিছু হরমন যার ফলে নারীদের মাসিক নিয়মিত হয়, রক্তক্ষরণ কমিয়ে দেয়, পেট খিচুনি হয় না পেট ব্যাথাও কমে যায়। জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি ক্যান্সার সৃষ্টি করে না। তাই অনেক নারী বড়ি গ্রহন করা পছন্দ করে।

৩. প্রথোন
প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্য কর্মী দ্বারা এটি প্রতিস্থাপন ও অপসারণ করতে হয় এবং এর ধরনের উপর নির্ভর করে প্রতি ৩ থেকে ৫ বছরে বদলাতে হয়। জন্মনিয়ন্ত্রণে এটি ৩/৫ বছর কার্যকর। এর কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। এই পদ্ধতি যৌনবাহিত রোগ প্রতিরোধ করে না। অবশ্যই কোন প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী দ্বারা পদ্ধতিটি গ্রহণ করতে হবে।

৪. ইঞ্জেকশন
এটি একটি সহজ ও কার্যকরী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। তবে ইঞ্জেকশনের ধরন অনুযায়ী প্রতি ৩/৪/৫ মাস পর পর ইঞ্জেকশন নিতে হবে।আপনাকে অবশ্যই কোন প্রশিক্ষত স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শ নিয়ে এই পদ্ধতি গ্রহন করতে হবে।

৫. বন্ধাকরণ
এটি স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। এটি সবচেয়ে বেশি কার্যকরী পদ্ধতিও বটে। একজন পুরুষ বা নারীকে একবার করা হলে তারা আর কখনও গর্ভবতী হবে না বা কাউকে গর্ভবতী করতে পারবে না। যেহেতু আর সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা নেই তাই ভেবে চিন্তে এই পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে।

জরুরি জন্মনিরোধন
জন্ম নিয়ন্ত্রক ছাড়াই যদি যৌনক্রিয়া করে থাকেন বা আপনার কনডম ফেটে যায় তাহলেও আপনি জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ির সাহায্যে গর্ভধারণ রোধ করতে পারেন। এটিকে বলা হয় জরুরী গর্ভনিরোধন। তবে এই বড়ি আপনাকে যৌনক্রিয়া করার পর প্রথম ৫দিনের মধ্যে বা ৭২ ঘন্টার মধ্যে নিতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সেবন করা যায় তত ভাল এটি কাজ করবে। এটি নারী ডিম্বাণুকে নিসৃত হতে দেরী করানোর মাধ্যমে কাজ করে যাতে গর্ভাবস্থা শুরু হতে না পারে কিন্তু যদি ইতোমধ্যেই আপনি গর্ভবতী হয়ে যান তবে জরুরী জন্মনিরোধন গর্ভাবস্থা থামাবে না।

জরুরী গর্ভনিরোধের জন্য আপনাকে হয়তো ১টি বা ২টি বড়ি সেবন করতে হতে পারে। নির্দেশাবলী ভালভাবে পড়ে নিবেন।
তবে খাবার বড়ির মতো বেশি না হলেও অনেক নারীই এখন ইঞ্জেকশনের নিয়ে থাকে। প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর ইঞ্জেকশন দিতে হয়। এছাড়াও কিছু পদ্ধতি রয়েছে যেমন :

• কন্ট্রাসেপশন: এই পদ্ধতিটি নিশ্চিত করে যে ডিম্বাণুটি শুক্রাণুর দ্বারা নিষিক্ত হয় না। এটি সহজ ও নিরাপদ একটি পদ্ধতি।
• কন্ট্রাজেশন: এটি জরুরি গর্ভনিরোধক পদ্ধতি।
• উইথড্রল
• আউটারকোর্স
• ডায়াফ্রাম, ইত্যাদি।

এগুলোর মধ্যে আপনি যেকোন একটি বা একাধিক পদ্ধতি চয়ন করতে পারেন। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি বাছাই করার সম্পূর্ণ অধিকার আপনার রয়েছে।

পুরুষদের জন্য জন্ম নিয়ন্ত্রণ বিকল্প
সারা বিশ্বব্যাপী এখনো পুরুষের জন্য বিকল্প কোন পদ্ধতি নেই। হয় কনডম নয়তো স্থায়ী পদ্ধতি।
কিন্তু আমাদের সামাজিক নানা কারনে আগ্রহ থাকলেও অনেক পুরুষ স্থায়ী পদ্ধতি রাজি হন না। আবার অনেক ক্ষেত্রে স্ত্রীরাও চান না স্বামী স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করুক।
কোনটি সবচেয়ে ভালো জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি?
এখানে নির্দিষ্ট করে বলা যায় না কোনটি সবচেয়ে ভাল পদ্ধতি। মানুষ তাদের পছন্দ ও চাহিদার উপর নির্ভর করে পদ্ধতি বাছাই করতে পারেন। ভিন্ন ভিন্ন পরিবার পরিকল্পনার সুবিধা অসুবিধাও ভিন্ন। জন্মনিয়ন্ত্রণে চাই সঠিক একটি পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি। পদ্ধতি বাছাই করার ক্ষেত্রে আপনাকে যেসব দিক মাথায় রাখতে হবে-
• এটা আপনার জন্য নিরাপদ কিনা।
• জন্মনিয়ন্ত্রণে কতটা কার্যকর
• পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া
• রোগ প্রতিরোধ
এসব বিষয়গুলো মাথায় রেখে আপনাকে পদ্ধতি নির্বাচন করতে হবে।

আপনার বয়স চাহিদা শারিরীক সমস্যাগুলোর উপর নির্ভর করে পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। এজন্য আমরা বাংলাদেশে প্রচলিত সকল জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সমূহ নিয়ে আলোচনা করেছি। আপনি আপনার চাহিদা ও সুবিধা মত বাছাই করতে পারবেন।

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন