চলমান ডেস্ক : পাকিস্তানের ৭৪ বছরের ইতিহাসে এ পর্যন্ত কোন প্রধানমন্ত্রীই তাদের মেয়াদ পূর্ন করতে পারেননি। অনেক বিশ্লেষকরা ধারনা করেছিলেন হয়তো সদ্য বিদায়ী পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মাধ্যমে এ রেকর্ডটি ভাঙবে। কিন্তু সেটাও আর হলো না। গতকাল শনিবার সংসদে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে অবশেষে তাকেও মেয়ার শেষ হওয়ার আগে বিদায় নিতে হয়েছে। কিন্তু তিনি শেষে পর্যন্ত লড়ে গেছেন। এমনকি ক্ষমতার শেষেও তার কোন এমপি, মন্ত্রী তাকে ছেড়ে যাননি। তার পক্ষে সবাই লড়ে গেছেন। অনাস্থা ভোটের শুরুতে স্পিকার এবং ডেপুটি স্পিকার পদত্যাগও করেছেন।
২০১৮ সালে ইমরান খান যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন তখন মনে হচ্ছিল যেন সবকিছু তারই পক্ষে কাজ করছে। ক্রিকেট খেলার সেই দিনগুলো থেকেই একজন জাতীয় বীর, তারপর তার রূপান্তর একজন ক্যারিশম্যাটিক রাজনৈতিক নেতা হিসেবে। বহু দশক ধরে পাকিস্তানের রাজনীতিতে গেঁড়ে বসা প্রতিদ্বন্দ্বী দুই পরিবারকে বেশ সংগ্রামের পর অপসারণ করতে পেরেছেন।
আবেদনময় সব গান নিয়ে প্রাণবন্ত রাজনৈতিক সমাবেশ, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে জোরালো উপস্থিতিসহ তার আবির্ভাব হয়েছিল দুর্নীতিবিরোধী নতুন শক্তি হিসেবে। তিনি পরিবর্তন আর নতুন পাকিস্তান গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। দেশটিতে এপর্যন্ত কোন প্রধানমন্ত্রী তার পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। মনে হচ্ছিল যেন ইমরান খান হয়তো প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সেই ইতিহাস বদলাতে পারবেন। যে কারণে তাকে তার অবস্থানে খুব সংহত মনে হয়েছিল সেই একই কারণ দিয়েই তার পতন ব্যাখ্যা করা যায়।
তিনি পাকিস্তানের শক্তিশালী সেনাবাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় ক্ষমতায় আসীন হয়েছিলেন বলে মনে করা হয় – যদিও দুই পক্ষই এমন দাবি অস্বীকার করে। কিন্তু এখন তাদের সাথে সেই সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। দুই হাজার আঠারো সালে যদিও তার জনসমর্থন ছিল। একই সাথে তার গোপন খুঁটির জোর ছিল সেনাবাহিনী। পাকিস্তান রাষ্ট্রের অস্তিত্বের বেশিরভাগ সময় ধরেই দেশটির নিয়ন্ত্রণ রয়েছে সেনাবাহিনীর হাতে। সমালোচকরা ইমরান খানের শাসনকালকে ‘হাইব্রিড; সরকার বলে আখ্যা দিয়ে এসেছে। তার প্রতি সেনা সমর্থন নানা উদাহরণ রয়েছে।
দুই হাজার আঠারো সালের নির্বাচনী প্রচারণার সময় যেসব সংবাদসংস্থা তার প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছে তাদের অবস্থান সংকুচিত হতে দেখা গেছে। সেসময় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা কিছু প্রার্থীকে প্ররোচিত করে অথবা চাপ প্রয়োগ করে তার দলে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। সে তাদেরই সৃষ্টি-সেনাবাহিনীর প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে বলছিলেন ইমরান খানের দলত্যাগী একজন। তারাই তাকে ক্ষমতায় এনেছে। ইমরান খানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী নওয়াজ শরিফকে প্রথমে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। পরে তাকে দুর্নীতির অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
অনেকেই সন্দেহ করেন যে শরিফ অতীতে দুর্নীতির সাথে যুক্ত ছিলেন কিন্তু তাকে ওই সময় সাজা দেবার কারণ হিসেবে বলা হয় যে সেনাবাহিনীর সাথে সেসময় তার নিজের সম্পর্কের অবনতি। রাজনীতিতে নওয়াজ শরিফের শুরুটা ছিল একজন সামরিক একনায়কের শিষ্য হিসেবে। পরেরদিকে সেই সম্পর্ক থেকে স্বাধীন হয়ে উঠেতে থাকেন যার কারণে তিনি সেনাবাহিনীর রোষের মুখে পড়েন। তিনি সবসময় তার বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত আখ্যা দিয়ে তা অস্বীকার করে এসেছেন।
ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর ইমরান খান বেশ গর্বের সাথে ঘোষণা দিয়েছেন যে নীতি নির্ধারণের বিষয়ে সেনাবাহিনীর সাথে তার অবস্থান একই। যার একটি ফল ছিল সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থার সমালোচক হিসেবে পরিচিত ব্যক্তি এবং সাংবাদিকদের আক্রমণ ও অপহরণ।
যাতে উদ্বেগ প্রকাশ করে এসেছে সুশীল সমাজ। অন্যদিকে তা অস্বীকার করে এসেছে অভিযুক্ত দুই পক্ষই। এসব আক্রমণের জন্যেও কাউকে কখনো চিহ্নিত করা যায়নি। ইমরান জোর দিয়ে বলেছেন তার উদ্দেশ্য হচ্ছে সুশাসন নিশ্চিত করা। যেমন তিনি সমাজ সেবা ব্যবস্থার বেশ চমৎকার কিছু সম্প্রসারণ করেছেন দেশের বেশিরভাগ যায়গায় স্বাস্থ্য বীমা ব্যবস্থা চালু করেছেন। কিন্তু বেশ কিছু দিক দিয়ে তিনি হোঁচটও খেয়েছেন।
উদাহরণ হিসেব বলা যায় পাকিস্তানের সবচেয়ে জনবহুল পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী উসমান বুজদারের মত একজন রাজনৈতিক নবিশকে নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বেশ বিদ্রূপের শিকার হয়েছিলেন তিনি। ইমরান খান ব্যাপক সমালোচনা সত্ত্বেও উসমান বুজদারকে সরিয়ে দিতে রাজি হননি।
সেসময় গুজব ছড়িয়েছিল যে ইমরান খানের স্ত্রী, আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে যার পরিচয়, তাকে সতর্ক করেছিলেন যে উসমান বুজদার তার জন্য শুভ শক্তি এবং তাকে সরিয়ে দিলে সরকারের পতন হবে। ইমরান খানের জন্য অন্য আরো চ্যালেঞ্জ ছিল। দেশটির জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে চলেছে, খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ছে এবং ডলারের বিপরীতে রুপির দাম কমে গেছে। ইমরান খানের সমর্থকরা বলেন এর পেছনে কারণ হচ্ছে বৈশ্বিক পরিস্থিতি। কিন্তু তার বিরুদ্ধে জনরোষ বাড়ছিল। জনগণের মধ্যে প্রচলিত কথা ছিল ‘শরিফ পরিবার হয়ত নিজেদের পকেট ভারি করেছে কিন্তু তার অন্তত কিছু কাজ করেছে’।
তারপরও কিছুদিনের জন্য সেনাবাহিনীর জন্য সবচেয়ে ভাল বিকল্প ছিলেন ইমরান খান।
বিশ্বের দরবারে তার উপস্থিতি ছিল ক্যারিশম্যাটিক নেতা হিসেবে। অন্যদিকে সেনাবাহিনী – বিশেষ করে সেনাপ্রধান এবং গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানের বিরুদ্ধে বিরোধীদের কণ্ঠ জোরালো হতে শুরু করে। রাজনীতির গতিতে নাটকীয় পরিবর্তন আসে গত বছর।
বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিবিসিকে বলেছিলেন যে, বিশেষ করে পাঞ্জাবে সুশাসন নিশ্চিত করতে ইমরান খানের ব্যর্থতায় সেনাবাহিনীতে বিরক্তি বাড়ছিল এবং সম্ভবত তাকে ক্ষমতায় বসানোর ব্যাপারে যে সমালোচনার মুখে তারা সেনাবাহিনী ছিল সেটির প্রভাব পড়ছিল। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল সেনাপ্রধান জেনারেল বাজওয়া এবং গোয়েন্দা প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফায়েজ হামিদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়ায়। ফায়েজ হামিদ পরিবর্তী সেনাপ্রধান হওয়ার আশা পোষণ করতেন।
সেনাপ্রধান হওয়ার ব্যাপারে তিনি এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, তিনি আফগান কর্মকর্তাদের সাথে সে ব্যাপারে কথাবার্তা বলেছিলেন। যদিও সেনাবাহিনীর সাথে ঘনিষ্ঠ এক সূত্র বলেছিল, লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদকে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ, বিরোধীদের মুখ বন্ধ করার মত ‘নোংরা কাজে’ উপযুক্ত মনে করা হলেও তাকে সেনাপ্রধান হিসেবে যোগ্য মনে করা হয়নি। জেনারেল বাজওয়া এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফায়েজ হামিদের মধ্যেকার বিরোধ প্রকাশ্য হয়ে উঠেছিল গত গ্রীষ্ম মৌসুমে প্রভাবশালী রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সাথে এক আলাপচারিতার সময়।
একজন সাংবাদিক একটি প্রশ্ন করেছিলেন, কিন্তু আইএসআই প্রধান বলে বসেন যে সময় শেষ হয়ে গেছে। “আমি হচ্ছি সেনাপ্রধান এবং আমি সিদ্ধান্ত নেব কখন সময় শেষ হবে”, লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন জেনারেল বাজওয়া।
এমনকি ওই সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরও দেন সেনাপ্রধান। অক্টোবর মাসে তাদের দুজনের বিরোধ চরমে পৌঁছায় এবং এর মধ্যিখানে পড়ে যান ইমরান খান। জেনারেল বাজওয়া গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান হিসেবে নতুন কারো কথা ভাবছিলেন এবং বিভিন্ন পদে পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন ইমরান খান, যিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন। পরিবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত আইএসআই প্রধান স্বপদে থাকুন সেটা চাইছিলেন ইমরান খান। তিনি মনে করছিলেন যে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদ তাকে আরো একবার জয়ী হতে সাহায্য করতে পারবেন।
তার পদ পরিবর্তন বিষয়ক প্রজ্ঞাপন সপ্তাতিনেক আটকিয়েও রেখেছিলেন ইমরান খান, যদিও শেষ পর্যন্ত হাল ছাড়তে হয় তাকে। তবে এসব কারণে সেনাবাহিনীর সাথে ইমরান খানের সরকারের সম্পর্কের ফাটল আরো প্রকাশ্য হয়। ইমরান খানের বিরুদ্ধে যখন অনাস্থা ভোটের পরিকল্পনা হচ্ছিল, তার দল থেকে কারা বেরিয়ে যাবেন সেটি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। তখন বেশ কটি সূত্র থেকে বিবিসিকে বলা হয়েছিল, সেনাবাহিনী এ ব্যাপারে ‘নিরপেক্ষ’ থাকবে বলে উল্লেখ করেছে। ইমরান খানের দলত্যাগী একজন বিবিসিকে বলেছেন, তিনি এবং অন্য সংসদ সদস্যরা গোয়েন্দা বাহিনী থেকে ফোন কল পেতেন এবং তাদেরকে বলে দেয়া হতো কি করতে হবে।
এফআইটি/সিএন
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন