ইফতেখার ইসলাম: উন্নত শিক্ষা-সভ্যতা-স্টাইলের এক বিরাট নিদর্শন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক। এটি এমন এক শহর যা বিশ্বের সকল শহরের কাছেই অনুসরনীয়। যেখানে রয়েছে স্ট্যাচু অব লিবার্টির মত দর্শনীয় স্থান। ১৭৮৫ থেকে ১৭৯০ সাল পর্যন্ত ৬ বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ছিল। বলছি বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবেও বিবেচিত নিউইয়র্ক শহরের কথা। শহরটির মূল আয়তন ৩০২.৬ বর্গমাইল অথবা ৭৮৪ কিলোমিটার। নিউ ইয়র্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বিশাল জনবহুল শহর। মূল নিউ ইয়র্ক শহরের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৮৬ লক্ষ। যা পুরো বিশ্বের মধ্যে দশম স্থানে রয়েছে। নিউইয়র্কে নাগরিকদের “নিউ ইয়র্কার” বলা হয়। বিশ্বের রাজনীতির বড় আসর বসে ওখানে। এই শহরেই জাতিসংঘের সদর দপ্তর অবস্থিত। এ কারণে একে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিকদের তীর্থস্থানও বলা হয়। বিগত দুইশত বছর ধরে শহরটি মার্কিন যু্ক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ও সম্পদশালী শহর।
নিউইউয়র্ক একটা সময় ছিলো সাদামাটা কয়েকটা দ্বীপ। উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরকে সামনে নিয়ে দাঁড়িয়েছিলো। এখানেই হাডসন এবং ইস্ট নদীর মোহনা। মোহনায় জেগে উঠা দ্বীপে বসতি ছিলো লেনাপি উপজাতির। ভূমির মালিক ছিলো ওরাই। সাগর আর নদীকে কেন্দ্র করে ছিলো ওদের জীবন। কিন্তু বাইরের পৃথিবী এই ভূমিপুত্রদের থাকতে দেয়নি। লেনাপিদের উচ্ছেদ করা হয়। এদের কেউ কেউ অন্য উপজাতির কাছে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। লেনাপিরা নিউইয়র্ক ছেড়ে চলে গেলেও তাদের কিছু চিহ্ন রয়ে গেছে। কিছু এলাকার নামও রয়ে গেছে লেনাপিদের ভাষায়।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, অতীতে প্রথম যে ১৩ টি ব্রিটিশ উপনিবেশ মিলে স্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল নিউইয়র্ক ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম প্রভাবশালী অঙ্গরাজ্য। ১৫২৪ সালে ইতালীয় অভিযাত্রী জোভান্নি দ্যা ভেরাৎসানো সর্বপ্রথম ইউরোপীয় হিসেবে বর্তমান নিউইয়র্ক শহর যেস্থানে অবস্থিত, সেই অঞ্চলটি আবিষ্কার করেন। তখন সেখানে প্রায় ৫হাজার আদিবাসী আমেরিকান লেনাপি জাতির লোক বাস করতো। ভেরাৎসানো তৎকালীন ফ্রান্সের রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় এই অঞ্চল আবিষ্কার করেছিলেন। আবিষ্কারের পর তিনি অঞ্চলটির নাম দেন “নুভেল অঁগুলেম” বা নতুন অঁগুলেম। অগুঁলেম হলো ফ্রান্সের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের শারঁত দেপার্ত্যমঁ বা জেলার একটি শহর। এখানে প্রথম ইউরোপীয় বসতি স্থাপন আরম্ভ হয় যখন ওলন্দাজরা ১৬১৪ সালে ম্যানহাটনের দক্ষিণ পার্শ্বে একটি পশম ব্যবসায় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে। তারা পরবর্তীতে এই অঞ্চলের নাম রাখে ‘নতুন আমস্টারডম’।
ওলন্দাজ উপনিবেশের পরিচালক পিটার মেনুইট ১৬২৬ সালে ম্যানহাটন দ্বীপটি স্থানীয় লেনাপিদের নিকট হতে ক্রয় করেন। ১৬৬৪ সাল নাগাদ ব্রিটিশরা শহরটি দখল করে এবং এর নতুন নাম রাখে নিউইয়র্ক। ইঙ্গ-ওলন্দাজ যুদ্ধ শেষে ওলন্দাজরা রান দ্বীপের কর্তৃত্ব পাওয়ার শর্তে নতুন আমস্টারডামের কর্তৃত্ব বিট্রিশদের নিকট ন্যস্ত করে। ব্রিটিশ শাসনের অধীনেই নিউর্য়ক শহরটি বন্দরনগরী হিসেবে বেশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। মার্কিন বিপ্লবী যুদ্ধের সময় এই শহরে বেশ কিছু ছোটখাটো যুদ্ধ সংঘটিত হয় যেগুলোকে একসঙ্গে বলা হয় নিউর্য়ক ক্যাম্পেই।
সারা বিশ্ব থেকে আগত অভিবাসীদের স্বাগত জানানোর জন্য নিউইয়র্ক শহরে রয়েছে স্ট্যাচু অব লিবার্টি। এটি শুধু নিউ ইয়র্ক শহরেরই নয়, সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শান্তি ও স্বাধীনতার প্রতীক। এটি একটি বিশালাকার তাম্র মূর্তি। স্ট্যাচু অব লিবার্টিকে চোখ মেলে দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে ম্যানহাটনের দক্ষিণে ব্যাটারি পার্কে। কাছ থেকে দেখতে চাইলে নৌকা ভাড়া করে চলে যেতে হবে লিবার্টি দ্বীপে। ওখানে মূর্তিটির ভীতের চারপাশে হাঁটতে পারবেন। পাদদেশে ঢুকতেও পারবেন। আগাম রিজার্ভেশন থাকলে সরাসরি চূড়ায়ও উঠতে পারবেন। নিউইয়র্কে স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখা শেষ হলে আপনি যেতে পারেন এলিস দ্বীপে। ওখানে আছে ইমিগ্রেশন জাদুঘর। ঐতিহাসিক ইমিগ্র্যাশন স্টেশনে এই জাদুঘর ভবন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের আগে হাজার হাজার অভিবাসীকে এই স্টেশনেই যাচাই-বাছাই করা হয়েছিলো। নিউইয়র্কে আসা অভিবাসীদের রেকর্ড দেখতে জাদুঘরের ডাটাবেসে অনুসন্ধানও করতে পারেন।
উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে আরও রয়েছে সেন্ট্রাল পার্ক। এটি একটি বিশাল নাগরিক উদ্যান। আধা মাইল প্রশস্ত আর আড়াই মাইল লম্বা এই পার্কটি নিউইয়র্কের ফুসফুস। সেন্ট্রাল পার্ক নিউইয়র্ককে যেমন সাজিয়েছে, তেমনি শহরটিকে রেখেছে বাসযোগ্য। ওখানে গেলে আপনি পাবেন হাঁটার অবারিত সুযোগ। চাইলে প্যাডেল বোটে করে ভাসতেও পারেন।
নিউ ইয়র্কের বিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক ভবন এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং। ৩১১ মিটার উঁচু ১০২তলা ভবনটি ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার গড়ার আগে বিশ্বের বৃহত্তম উঁচু ভবন ছিলো। এর চূড়ায় দাঁড়িয়ে পৃথিবী দেখার জন্য আছে দু’টো অবসারভেটর এলাকা। ঝকঝকে দিনে যদি ওখান থেকে তাকান, গোটা পৃথিবী দেখা না গেলেও পাশের অঙ্গরাজ্য নিউ জার্সি, পেনসালভেনিয়া, কানেকটিকাট এবং ম্যাসাচুসেটসের ৪০ মাইল এলাকা দেখা যাবে। ওখান থেকে দেখতে পাবেন বিধ্বস্ত ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার।
নিউইয়র্কে আসল ‘স্বর্গ’ নেমে আসে সন্ধ্যায়। সন্ধ্যার নিউইয়র্ক রোমাঞ্চকর, উত্তেজনায় ভরপুর। অনেকে জড়ো হন টাইম স্কোয়ারে। এই টাইম স্কোয়ারে বছরের প্রথম দিন উদযাপন হয়। যখন রাত বাড়ে, লোকে থইথই করে স্কোয়ার, তখন হয় ‘বল ড্রপ’। শুধু বছরের প্রথম দিন নয়, টাইম স্কোয়ার সবসময় ব্যস্ত। নিউইয়র্ক টাইমস টাওয়ারের নামে এর নাম রাখা হয়েছিলো ১৯০৪ সালে।
উল্লেখযোগ্য আরেকটি দর্শনীয় স্থান বর্ণীল আলোয় আলোকউজ্জ্বল টাইমস স্কয়ার চত্ত্বর। রয়েছে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শিল্পকলা যাদুঘর খ্যাত মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট।
এছাড়াও আরও রয়েছে- গ্রাউন্ড জিরো অথবা নাইন ইলেভেন মেমোরিয়াল, টপ অব দ্যা রক, এ্যম্পায়ার স্টেট বিলডিং, বিজ্ঞান যাদুঘর আমেরিকান মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্টোরি, সংগীত ও অন্যান্য শিল্প পরিবেশন কেন্দ্র রেডিও সিটি মিউজিক হল, ব্রংক্স জু নামক চিড়িয়াখানা, ত্রিভুজাকার ফ্ল্যাট আয়রন বিল্ডিং প্রভৃতি।
নিউ ইয়র্কে রয়েছে বেশ কিছু ব্রিজ যা প্রাচীন কাল থেকেই বিভিন্ন ভাবে উল্লেখযোগ্য। যেমন-১৮৮৩ সালের ব্রুকলিন ব্রিজ, ১৯০৩ সালেন উইলিয়ামসবার্গ ব্রিজ, ১৯৩১ সালের জর্জ ওয়াংশিংটন ব্রিজ, ১৯৬৪ সালের ভেরাজানো-ন্যারোজ ব্রিজ প্রভৃতি।
নিউইয়র্কের শিক্ষা ব্যবস্থার মান খুবই উন্নত। শহরটিতে ১১০টি বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষা পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরি এমন একটি গণগ্রন্থাগার ব্যবস্থা যা বিশ্বের ৩য় বৃহত্তম লাইব্রেরি নামে খ্যাত। লাইব্রেরিটির ৯২টি শাখায় প্রায় ৫ কোটি বই রয়েছে। শুধু লেখাপড়াই নয়, শহরটি খেলাধুলা বা অন্যান্য সংস্কৃতির জন্য খুবই বিখ্যাত।
আমেরিকার সবচেয়ে সম্পদশালী শহরগুলোর মধ্যে নিউ ইয়র্ক শীর্ষস্থানীয়। এমনকি এটি পুরো বিশ্বের শীর্ষস্থানীয়দের মধ্যেও অন্যতম। ব্যবসায়-বাণিজ্য কিংবা অন্যান্য কার্যক্রম সর্বদিকে থেকেই নিউইয়র্কের স্থান সর্বোচ্চ। নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে পৃথবীর সবচেয়ে বেশি স্বর্ণের মজুদ রয়েছে। ৭ হাজার টন স্বর্ণের দাম প্রায় ৯০বিলিয়ন ডলার। ফলে বুঝাই যায় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিলিয়নিয়ার বাস করে নিউর্য়কে। এই শহরে প্রায় ৩ লাখ ৮০ হাজার মিলিয়নিয়ার রয়েছে।
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন