এম. মতিন: নির্বিচারে বৃক্ষনিধন চলছে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলায়। চলছে পাহাড় কাটার মহোৎসব। পাশাপাশি সংরক্ষিত ন্যাড়া পাহাড়ে গড়ে উঠেছে অবৈধ বসতি। অথচ বনভূমি রক্ষা ও দেখভাল কাজে বন বিভাগ নিয়োজিত থাকলেও তা কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। অনেকটা ‘গা ছাড়া ভাব’ তাদের।
সরেজমিনে দেখা যায়, চলতি শীত মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাঙ্গুনিয়ার সবুজ পাহাড়ে শুরু হয়েছে কঁচি চারা গাছ নিধনের মহোৎসব। ড্রাম্পা জিপ গাড়ি ও ট্রাকে ট্রাকে এসব কঁচি চারা গাছের লকড়ি পাচার এখন ‘ওপেন সিক্রেট’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রশাসনের নাকের ডগায় দিনদুপুরে এসব বৃক্ষ নিধনের মহোৎসব চললেও রহস্যজনক কারণে বন বিভাগ নীরব ভূমিকা পালন করছে। ফলে প্রতিকারের কেউ না থাকায় দিনের পর দিন ন্যাড়া হচ্ছে রাঙ্গুনিয়ার সবুজ পাহাড়। শুধু তাই নয়, কোনো কোনো স্থানে বনদস্যু ও ভূমিদস্যুদের করাল গ্রাস থেকে ন্যাড়া পাহাড়ও রক্ষা করা যাচ্ছে না। সেখানে শত শত অবৈধ বসতি স্থাপনের পাশাপাশি পাহাড় কেটে সাবাড় করে বিক্রি করা হচ্ছে মাটি।
জানা গেছে, রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে দিনে রাতে প্রতিদিন শতাধিক টন চারা গাছের লাকড়ির গাড়ি উপজেলার বিভিন্ন ইটভাঁটি গুলোতে পাচার করা হচ্ছে। কাঠের লাকড়ি সস্তায় পাওয়া যায় বিধায় রাঙ্গুনিয়ার ইটভাঁটিগুলো কয়লার পরিবর্তে এই চারা গাছের লাকড়ি দেদার ব্যবহার করা হচ্ছে। অথচ সন্ধ্যার পর বন আইন অনুসারে বৈধ বা অবৈধ কোন ধরনের কাঠ সড়ক দিয়ে স্থানান্তর না করার আইন থাকলেও এর কোন প্রয়োগ নেই। কিন্তু রক্ষক ভক্ষক হয়ে যাওয়ায় এক শ্রেণীর বন কর্মকর্তার যোগসাজশে রাঙ্গুনিয়া বিভিন্ন সড়ক দিয়ে প্রতিনিয়ত টনে টনে লাকড়ি সড়ক ও নদী পথে ইটভাঁটিতে চলে যাচ্ছে।
প্রতি চাঁদের গাড়ি বা ট্রাকের চাঁদার টোকেন বন কর্তাদের কাছে জমা হওয়ার পর গাড়িগুলো ফ্রি চলাচলের অনুমতি পেয়ে যায়। রাঙ্গুনিয়া রেঞ্জ, ইছামতী রেঞ্জ, ইসলামপুর, বগাবিলী, কোদলা, খুরুশিয়া, চিরিঙ্গা, পোমরা বনবিট ও কর্ণফুলী নদীর পাশে বনজ শুল্ক ফাঁড়ি থাকলেও টোকেন দেখানোর পর ওরা নীরব দর্শক হয়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে এই পদ্ধতি চালু থাকায় রাঙ্গুনিয়ার শ্যামল পাহাড়গুলো দিনে দিনে ন্যাড়া মাথার রূপ ধারণ করছে।
কথায় আছে ‘কাজীর গরু কেতারে আছে গোয়ালে নেই।’ তার সত্যতা মিলে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা বনজ সম্পদের বেলায়। পাহাড়ে অশ্রেণীভুক্ত বনাঞ্চলের বেলায় তাই হয়েছে। বন ও পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ইটভাঁটি করার জন্য কিছু শর্ত আরোপ করা আছে। ইটভাঁটির মালিকেরা তা কোন সময় মেনে চলে না। কিছু চালাক মালিক ইটভাঁটি প্রবেশ মুখে কিছু কয়লা স্তূপ করে রাখে। যাতে কোন কারণে প্রশাসনের লোকজন গেলে তা দেখানো যায়। শুধু পাহাড়ের কাঠ পোড়ানের সুবিধার জন্য রাঙ্গুনিয়ায় পাহাড় ও সংরক্ষিত বনের পাশে গড়ে উঠেছে শতাধিক অবৈধ ইটভাঁটি। আবার এসব উপজেলার ইটভাঁটিগুলোতে মাঝে মধ্যে লোক দেখানো অভিযানও চালানো হয়ে থাকে। তবে কোন ইটভাঁটা বন্ধ হয়না।
এদিকে রাত হলে অবৈধ কাঠের গাড়ি চলাচলে সরব হয়ে উঠে রাঙ্গামাটি- চট্টগ্রাম, কাপ্তাই- চট্টগ্রাম, রাজস্থলী- চন্দ্রঘোনা, বান্দরবান- বাঙ্গালহালিয়া, কাউখালী- রানীরহাট ও মরিয়মনগর- রানীরহাট সড়ক দিয়ে কাঠ পাচার হয়ে থাকে। এছাড়া নদী পথগুলোর মধ্যে রয়েছে, কর্ণফুলী, ইছামতি, শিলকখাল ইত্যাদি। এই সব স্থানের সড়কগুলো রাত হলে কাঠ পাচারকারীদের দখলে চলে যায়। যা দেখার কেউ নেই।
এক শ্রেণীর লোভি ব্যসায়ীর কারণে সরকারী বেসরকারী সামাজিক বনবাগান থেকে শুরু করে ব্যক্তি মালিকেনা বাগান পর্যন্ত রক্ষা হচ্ছে না। পাচারকারীরা এতই বেপরোয়া যে কোন কোন ক্ষেত্রে বাগান মালিককে ভয় দেখিয়ে কচি গাছ নামে মাত্র মূল্যে কেটে নিয়ে যায়।
প্রশাসনের একটি মহল পাচারকারীদের কাছ থেকে সুবিধা পায় বিধায় অনেক সময় মাস্তানদের ভয়ে নিরহ মানুষের সৃজিত বাগান পানির ধরে লাকড়ি হিসেবে বিক্রি করতে বাধ্য হয়ে যায়। তারা কোথাও গিয়ে তেমন কোন প্রতিকারও পায় না বলে ভুক্তভুগীরা জানায়। এই অবস্থার উত্তোরণ করা না হলে পাহাড়ে আবারো গত ১৩ জুনের মতো ভয়াভহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা।
এ ব্যাপারে রাঙ্গুনিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা মাসুক করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর তিনি জরুরি কাজ থাকার কারণ দেখিয়ে এই ব্যাপারে কথা বলতে অপরাগতা প্রকাশ করেন।
এ প্রসঙ্গে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইফতেখার ইউনুস বলেন, ‘কোনো ইটভাঁটা পরিবেশ বিধ্বংসী কাজ করলে ছাড় দেওয়া হবে না। যদি কোন ইটের ভাঁটায় বনের কাঠ, ফসলি জমির উর্বর মাটি ও পাহাড় কেটে মাটি ব্যবহার করা হয়। তাহলে সে সব ইটেরভাঁটা বন্ধ করে মালিকদের বিরূদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মতিন/আইআই/সিএন
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন