শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

রুটির দোকান থেকে তুরস্কের মসনদে, মুসলমানদের কাছে এরদোয়ান যেন আরেক ওসমান!

সোমবার, মে ২৯, ২০২৩

প্রিন্ট করুন

ইফতেখার ইসলাম: অটোমান সম্রাজ্য—সুদীর্ঘ ৬২৫ বছরের বিশ্ব কাঁপিয়ে দেওয়া শাসনের এক গৌরবময় ইতিহাসের নাম। ১২৫৮ বা ১২৫৯ সালে তৎকালীন আনাতোলিয়া (বর্তমান তুরস্কে) জন্ম নেওয়া আরতুগ্রুল গাজীর ছেলে ওসমানের হাত ধরেই ১২৯৯ সালে এ সাম্রাজ্যের সূচনা হয়েছিল। যা পরবতর্তীতে দীর্ঘকাল গৌরবের সাথে শাসনের শেষে ১৯২৪ সালে ইতি টানে। সেসময় অটোমান সাম্রাজের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেন তুরস্কের জাতীয়তাবাদী নেতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক। তার হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় বর্তমান তুরস্ক। তবে তুর্কিদের সেই গৌরবময় ইতিহাস এখনও হৃদয়ে গেঁথে রেখেছেন মুসলিম বিশ্বের জনগণ। বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের কাছে তুরষ্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান যেন আরেক ওসমান!

রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান—২০০৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ছিলেন তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী। এরপর দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি। ২০১৮ সালের ভোটেও তার ওপরই আস্থা রাখেন তুরস্কের জনগণ। এবার টানা তৃতীয় মেয়াদে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। আগামী পাঁচ বছরও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নিয়ে চলা দেশটির নেতৃত্ব দেবেন তিনি।

এরদোয়ানের উঠে আসা রক্ষণশীল রাজনৈতিক শিবির থেকে। বিশের দশকে মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের হাত ধরে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে আধুনিক তুরস্কের আত্মপ্রকাশ ঘটে। সেই দেশে অনেকটা বিভাজন সৃষ্টিকারী নেতার ভাবমূর্তি নিয়ে এগোতে থাকেন এরদোয়ান। পাঁচ বছর আগেই আতাতুর্কের ১৫ বছর দেশ শাসনের মেয়াদ পার করেন তিনি। হয়ে ওঠেন তুরস্কের সবচেয়ে বেশি সময়ের শাসক। এরদোয়ান ২০১৭ সালে প্রথম ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার গণভোট করে প্রেসিডেন্টের হাতে সর্বময় ক্ষমতা নিয়ে নেন।

তুরস্কসহ মুসলিম বিশ্বের কাছে এতটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এই এরদোয়ানের পথচলা মোটেও সুগম ছিলো না। ছোটবেলা থেকে কন্টকাকীর্ণ পথে হেটেছেন তিনি। সহ্য করেছেন বহু যন্ত্রনা। এরদোগানের জন্ম ১৯৫৪ সালের ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, তুরস্কের কাসিমপাসা অঞ্চলে। তার শৈশবের একটি বড় সময় কেটেছে তুরস্কের কৃষ্ণ সাগর অঞ্চলের উত্তর-পশ্চিম তীরের রিজে শহরে। তার পরিবার জর্জিয়ার বাতুমি থেকে হিজরত করে এসেছিলো ইস্তাম্বুল। ইস্তাম্বুলে স্থায়ীভাবে বসাবাস করার আগে তার পিতা দীর্ঘদিন রিজে’র কোস্টগার্ড হিসেবে চাকুরিরত ছিলেন। এরদোগান অসচ্ছল পরিবারকে চালাতে লেমনেড এবং সিমিত নামে পরিচিত এক ধরণের রুটি এবং ও রাস্তায় লেবুর শরবত বিক্রি করেতেন।

১৯৬০ সালে তিনি কাসিমপাসা পিয়ালি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষালাভ শুরু করেন। ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ইস্তাম্বুলের ইমাম হাতিপে, যেটি ছিল ধর্মীয় ভোকশনাল উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় সেখানে পড়াশুনা করেছেন।

১৯৬৯ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত তিনি আন্ঞলীক পর্যায়ে ফুলবল খেলোয়ার হিসেবে নাম কুড়িয়েছেন। ১৬ বছর বয়সে তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তাকে ডিভিশন লীগে খেলার সুযোগ দেয়া হবে। ওই সময়ে তিনি কাসিমপাসা সুপার ক্লাবের হয়ে খেলতেন এবং তৎকালিন সংবাপত্রের তথ্য থেকে জানা যায়, তুরস্কের অন্যতম সেরা ক্লাব ‘ফিনেরবাক’ তাকে দলে নিতে চেয়েছিলো কিন্তু পিতার অনাগ্রহে তিনি যোগদান করেননি। পরর্বতিতে কাসিমপাসা সুপারসের খেলার মাঠ তার নামে নামকরণ করা হয়।

তরুন বয়সেই রাজনীতির সাথে যুক্ত হন এরদোগান। তার অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের সূত্র জানা যায়, উচ্চমাধ্যমিক পাঠ শেষে র্মারমারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত অবস্থায় তিনি ন্যাশনাল তুর্কি স্টুডেন্ট এসোসিয়েশনে যোগ দেন।

১৯৭০ দশকে প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল স্যালভাতিন পার্টির ছাত্র সংগঠনের প্রসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার মধ্যে দিয়ে তার সিরিয়াস রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু হয় বলে অন্য এক নির্ভরযোগ্য তথ্য সূত্রে জানা যায়। তবে ১৯৮০’র মিলিটারি ক্যু’র পরে ওই সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়। পরর্বতিতে সেনাবাহীনির ক্যু চলাকালিন সময়ে তিনি বেসরকারি কোম্পানির হিসাবরক্ষক এবং ম্যানেজার হিসেবে চাকুরি করে জীবন নির্বাহ করেন। ১৯৮১ সালে বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পোষ্ট গ্রাজুয়েশন সমাপ্ত করেন। এবং ১৯৭৮ সালে এমনি গুলবারানকে বিয়ে করেন, ব্যক্তিজীবনে তিনি দুই কন্য এবং দুটি পুত্র সন্তানের জনক।

রাজনীতিতে এরদোয়ানের উঠে আসা গত শতকের সত্তরের দশকে ইস্তাম্বুলের বেইওগ্লু অঞ্চল থেকে। তার শৈশব কেটেছে শ্রমজীবী মানুষ অধ্যুষিত ওই অঞ্চলের কাসিমপাসা এলাকায়। ১৯৭৬ সালে এরদোয়ান প্রথম ন্যাশনাল স্যালভেশন পার্টির যুব শাখার বেইওগ্লু অঞ্চলের প্রধান নির্বাচিত হন। ন্যাশনাল স্যালভেশন পার্টির প্রধান ছিলেন নাজিমুদ্দিন এরবাকান। তিনি পরে ১৯৯৬–৯৭ মেয়াদে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। নাজিমুদ্দিন এরবাকানকে এরদোয়ানের রাজনৈতিক গুরু হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।

অনেকের মতে, এরদোয়ান তুরস্কে বিভাজন বাড়িয়েছেন। বিশেষ করে ১০ বছর আগে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ এবং ২০১৬ সালের সেনা অভ্যুত্থানচেষ্টার পর এটা বেশি ঘটেছে। ১৯৯৪ সালে প্রথম ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচিত হন এরদোয়ান। সে সময় দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ইস্তাম্বুলে দেখা দেওয়া বিভিন্ন সংকট যেমন বায়ুদূষণ, বর্জ্য সংগ্রহ এবং বিশুদ্ধ পানির ঘাটতির মতো সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী হন তিনি। অবশ্য চার বছরের মাথায় বিতর্কিত একটি কবিতা আবৃত্তির জন্য আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় তাকে। এর মধ্য দিয়ে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগে চার মাসের কারাদণ্ড হয় এরদোয়ানের।

১৯৯৯ সালে কারাগার থেকে বেরোনোর পরও এরদোয়ানের রাজনীতিতে নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকে। এর দুই বছর পর জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (এ কে পার্টি) গড়ে তোলেন তিনি। এর ১৫ মাস পর ২০০২ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয় এ কে পার্টি। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে জনমনে সৃষ্ট ক্ষোভের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ওই নির্বাচন। দল সরকার গঠন করলেও রাজনীতিতে নিষেধাজ্ঞা থাকায় পরের বছর মার্চ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর পদে বসতে পারেননি এরদোয়ান। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে শুরু হয় তুরস্কের রাজনীতিতে এরদোয়ানের আধিপত্যের পর্ব।

তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন এরদোয়ান

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় দফায় জয়ী হয়েছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। বাংলাদেশ সময় রাত সোয়া ১১টা পর্যন্ত ৯৮ দশমিক ০৬ শতাংশ ভোট গণনা শেষে দেখা গেছে এরদোয়ান পেয়েছেন ৫২ দশমিক ১২ শতাংশ ভোট। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ন্যাশনস এলায়েন্সের কামাল কিলিজদারগলু পেয়েছেন ৪৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ ভোট। সরকারিভাবে এখনো নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হয়নি। দেশটির সুপ্রিম ইলেকশন কাউন্সিল আনুষ্ঠানিক ফলাফল প্রকাশ করবে। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত ফলাফল তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংবাদসংস্থা আনাদোলুর মাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে।

রোববার স্থানীয় সময় সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় ৬ কোটি মানুষ ভোটদান করেন। তাদের মধ্যে প্রায় ৫০ লাখ প্রথম ভোট দিয়েছেন। গত ১৪ মে অনুষ্ঠিত প্রথম দফা নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য কোনো প্রার্থীই প্রয়োজনীয় ৫০ শতাংশ ভোট পাননি। এরদোয়ান পেয়েছিলেন ৪৯ দশমিক ৫২ শতাংশ ভোট। কামাল কিলিজদারগলু পেয়েছিলেন ৪৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ ভোট। এই নিয়ে তৃতীয় মেয়াদে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন এরদোয়ান।

কেউ হারেনি, বিজয় হয়েছে তুরস্কের

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান ঐতিহাসিক ভাষণে তার নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রাখার জন্য দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। এ সময় তিনি জাতীয় লক্ষ্য ও স্বপ্ন পূরণে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তার বিজয়কে গণতন্ত্রের বিজয় হিসেবে অভিহিত করেছেন এরদোগান। আঙ্কারায় প্রেসিডেন্ট ভবন প্রাঙ্গণে জড়ো হওয়া লাখ লাখ মানুষের সামনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোগান ঐক্যের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

তিনি বলেন, নির্বাচনে প্রকৃত বিজয়ী হচ্ছেন সাড়ে আট কোটি তুর্কি নাগরিক এবং তুর্কি গণতন্ত্র। সমর্থকদের উদ্দেশে এরদোগান বলেন, আমরাই একমাত্র বিজয়ী নই, তুরস্কের বিজয় হয়েছে, আমাদের গণতন্ত্র বিজয়ী হয়েছে। আজ কেউ হারেনি। সবাই জিতেছে, দেশের ৮৫ মিলিয়ন মানুষ জিতেছে।

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন