রোববার বাংলাদেশে ঈদুল আজহা; করোনা রোধে আট নির্দেশনা জারি

ঢাকা: বাংলাদেশে রোববার (১০ জুলাই) মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা পালিত হবে। যথাযথ ধর্মীয় মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে মুসলিম সম্প্রদায় ঈদুল আজহা উদযাপন করবেন। আল্লাহর অপার অনুগ্রহ লাভের আশায় ঈদের জামাত শেষে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সামর্থ অনুয়ায়ী পশু কুরবানি করবেন।

নামাজ শেষে মুসল্লিদের অনেকেই যাবেন কবরস্থানে। চির বিদায় নেয়া স্বজনদের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে অশ্রুসজল চোখে এ আনন্দের দিনে তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে আল্লাহর দরবারে আকুতি জানাবেন।

ঈদুল আজহা উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীসহ পৃথিবীর মুসলমানদের আন্তরিক অভিনন্দন ও মোবারকবাদ জানিয়ে পৃথক বাণী দিয়েছেন।

রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেন, ‘আল্লাহর প্রতি গভীর আনুগত্য ও সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর ঈদুল আজহা। ‘আজহা’ অর্থ কুরবানি বা উৎসর্গ করা। ঈদুল আজহা উৎসবের সাথে মিশে আছে চরম ত্যাগ ও প্রভুপ্রেমের পরাকাষ্ঠা। আল্লাহর নির্দেশে স্বীয় পুত্র হযরত ইসমাইলকে (আ) কুরবানি করতে উদ্যত হয়ে হযরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর প্রতি অগাধ ভালোবাসা, অবিচল আনুগত্য ও অসীম আত্মত্যাগের যে সুমহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা ইতিহাসে অতুলনীয়।’

রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘কুরবানি আমাদের মাঝে আত্মদান ও আত্মত্যাগের মানসিকতা সঞ্চারিত করে। আত্মীয় স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর সাথে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়ার মনোভাব ও সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়।’

শেখ হাসিনা তার বাণীতে ঈদুল আজহার মর্মবাণী অন্তরে ধারণ করে নিজ নিজ অবস্থান থেকে জনকল্যাণমুখী কাজে অংশ নিয়ে বৈষম্যহীন, সুখী, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ গড়ে তোলার আহবান জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘আমি প্রত্যাশা করি, প্রতি বারের মত এবারো ঈদ ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকলের জীবনে সুখ ও আনন্দের বার্তা বয়ে আনবে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘হযরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর উদ্দেশে প্রিয় পুত্রকে উৎসর্গের মাধ্যমে তার সন্তুষ্টি লাভে যে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, তা বিশ্ববাসীর কাছে চিরকাল অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় হয়ে থাকবে।’

গত বারের মত এবারো করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঈদ উদযাপন করবেন মুসলমানরা। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস রোধে ধর্ম মন্ত্রণালয় এবারো ৮ দফা নির্দেশিনা জারি করেছে। করোনা সংক্রমণ রোধে ঈদুল আজহা উদযাপন ও ঈদের নামাজে স্বাস্থ্যবিধি মানার আহবান জানিয়ে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত আট দফা নির্দেশনায় রয়েছে- ঈদুল আজহা উদযাপন উপলক্ষে কোন ধরনের আলোকসজ্জা করা যাবে না। প্রত্যেককে নিজ নিজ বাসা থেকে ওজু করে ঈদগাহে ও মসজিদে আসতে হবে। করোনা সংক্রমণ রোধ নিশ্চিতকল্পে মসজিদ ও ঈদগাহের ওজুখানায় সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখতে হবে। ঈদের নামাজের জামাতে আগত মুসল্লিকে অবশ্যই মাস্ক পরে আসতে হবে। মসজিদ অথবা ঈদগাহে সংরক্ষিত জায়নামাজ ও টুপি ব্যবহার করা যাবে না। ঈদের নামাজ আদায়ের সময় কাতারে নামাজে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে দাঁড়াতে হবে। এক কাতার অন্তর অন্তর কাতার করতে হবে। পশু কোরবানির ক্ষেত্রে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা যথাযথভাবে পালন করতে হবে।

মহামারি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ঈদুল আজহার নামাজ শেষে রাব্বুল আলামিনের দরবারে খতিব ও ইমামদেরকে দোয়া করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।

নির্দেশনা বাস্তবায়নে খতিব, ইমাম এবং মসজিদ পরিচালনা কমিটি ও স্থানীয় প্রশাসনকে অনুরোধ জানিয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়।

এবার হাইকোর্ট সংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহে ঈদের প্রধান জামাত হবে সকাল আটটায়। জাতীয় ঈদগাহে নামাজ আদায় করার জন্য ঢাকাবাসীর প্রতি আহবান জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস।

করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে বিধিনিষেধ থাকায় দুই বছর পর এবার কিশোরগঞ্জের শত বছরের ঐতিহ্য ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ময়দানের ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হবে। রোববার (১০ জুলাই) সকাল নয়টায় শুরু হবে এ ঈদ জামাত।

ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ কমিটির সভাপতি ও কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম জানান, এবারের ১৯৫ তম ঈদুল আজহার জামাতে ইমামতি করবেন ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা ফরীদ উদ্দিন মাসউদ।

প্রতি বছরের মত এবারো বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদে ঈদের পাঁচটি জামাত অনুষ্ঠিত হবে। সকাল সাতটা থেকে পর্যায়ক্রমে জামাতগুলো অনুষ্ঠিত হবে।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, ঈদের প্রথম জামাত অনুষ্ঠিত হবে সকাল সাতটায়। দ্বিতীয়টি সকাল আটটায়, তৃতীয়টি সকাল নয়টায়, চতুর্থটি সকাল দশটায় ও পঞ্চম ও সর্বশেষ জামাত হবে দুপুর পৌনে ১১টায়।

বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সকাল সাতটার প্রথম জামাতে ইমামতি করবেন বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদের সিনিয়র পেশ ইমাম হাফেজ মুফতি মাওলানা মিজানুর রহমান। মোকাব্বির থাকবেন বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদের সাবেক মুয়াজ্জিন হাফেজ মো. আতাউর রহমান। এরপর সকাল আটটার দ্বিতীয় জামাতে ইমামতি করবেন হাফেজ মুফতি মুহিবুল্লাহিল বাকী নদভী। মোকাব্বির থাকবেন বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদের খাদেম মো. আব্দুল হাদী। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মুফাসসির আবু সালেহ পাটোয়ারী সকাল নয়টার তৃতীয় জামাতে ইমামতি করবেন। মোকাব্বির থাকবেন বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদের খাদেম মো. শহিদ উল্লাহ। সকাল দশটার চতুর্থ জামাতে ইমামতি করবেন বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদের পেশ ইমাম মুহীউদ্দিন কাসেম। মোকাব্বির থাকবেন বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদের খাদেম মো. জহিরুল ইসলাম। দুপুর পৌনে ১১টার সর্বশেষ জামাতে ইমামতি করবেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মুফতী মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ। মোকাব্বির থাকবেন বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদের খাদেম মো. রুহুল আমিন। পাঁচটি জামাতের কোনটিতে কোন একজন ইমাম অনুপস্থিত থাকলে বিকল্প ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ভাষা শিক্ষক মোহাম্মদ নূর উদ্দীন।

জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় পবিত্র ঈদ-উল-আজহার নামাজের জামাত সকাল আটটায় অনুষ্ঠিত হবে। চিফ হুইপ, হুইপবৃন্দ, মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবর্গ, সাংসদ ও সংসদ সচিবালয়ের কর্মচারীসহ এলাকার মুসল্লীরা জামাতে অংশ নেবেন। এ ছাড়া এ জামাত সবার জন্য উন্মুক্ত বলে সংসদের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। জামাতে আগ্রহী সব মুসল্লীকে অংশ নেয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ মসজিদুল জামিআয় পবিত্র ঈদুল আজহার দুইটি জামাত অনুষ্ঠিত হবে। ঈদের প্রথম জামাত সকাল আটটায় ও দ্বিতীয় জামাত সকাল নয়টায় অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম জামাতে ইমামতি করবেন মসজিদের সিনিয়র ইমাম সৈয়দ মুহাম্মদ এমদাদ উদ্দীনG দ্বিতীয় জামাতে ইমামতি করবেন মসজিদের সিনিয়র ইমাম নাজীর মাহমুদ।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ঈদুল আজহার নামাজের জামাত সকাল সাড়ে ছয়টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে অনুষ্ঠিত হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী পরিচালক শফিউর রহমান স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, আবহাওয়া অনুকূলে না থাকলে খেলার মাঠের পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত তিনটি মসজিদে ঈদ জামাতের আয়োজন অন্যত্র করা হবে। সে গুলো হল- কেন্দ্রীয় মসজিদে সকাল পৌনে সাতটায়, বকশীবাজার বায়তুল সালাম মসজিদে সকাল সাতটায় ও আজাদ আবাসিক এলাকা মসজিদে সকাল সোয়া সাতটায় ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হবে। সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণপূর্বক ঈদুল আজহার জামাতে অংশ নেয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।

সারা দেশে বিভাগ, জেলা, উপজেলা, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ এবং সরকারি সংস্থাগুলোর প্রধানরা জাতীয় কর্মসূচীর আলোকে নিজ নিজ কর্মসূচি প্রণয়ন করে ঈদ উদযাপন করবেন।

এ ছাড়া বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার ও বেসরকারি গণ মাধ্যমগুলো যথাযোগ্য গুরুত্ব সহকারে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার ও সংবাদপত্রগুলো বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করবে। ঈদ উদযাপন উপলক্ষে দেশের সব হাসপাতাল, কারাগার, সরকারি শিশু সদন, বৃদ্ধ নিবাস, মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হবে। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস ও মিশনগুলোতেদ যথাযথভাবে ঈদুল আযহা উদযাপন করবে। এ উপলক্ষে সারা দেশে আইন শৃংখলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রক্ষার্থে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

কুরবানীকৃত পশুর রক্ত বা বর্জ্য পদার্থ দ্বারা যাতে পরিবেশ দুর্গন্ধময় না হয়, সে বিষয়ে সব প্রকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে ঢাকার দুই সিটি কররপোরেশনসহ দেশের সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান। ঈদুল আজহার পূর্ববর্তী জুমার খুৎবায় এ বিষয়ে মুসল্লীদের সচেতন করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, প্রায় চার হাজার বছর আগে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি লাভের জন্য হজরত ইব্রাহিম (আ.) নিজ পুত্র হজরত ইসমাইলকে (আ.) কোরবানি করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু পরম করুণাময়ের অপার কুদরতে হজরত ইসমাইলের (আ.) পরিবর্তে একটি দুম্বা কোরবানি হয়ে যায়। হজরত ইব্রাহিমের (আ.) ত্যাগের মহিমার কথা স্মরণ করে বিশ্বব্যাপি মুসলিম সম্প্রদায় ১০ জিলহজ আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের আশায় পশু কোরবানি করে থাকে। আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান মুসলিমের জন্য আল্লাহ কোরবানি ফরজ করে দিয়েছেন। এ জন্য ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কোরবানি করাই এ দিনের উত্তম ইবাদত। সেই ত্যাগ ও আনুগত্যের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সারা দেশের মুসলিম সম্প্রদায় রোববার (১০ জুলাই) দিনের শুরুতেই মসজিদে সমবেত হবেন ও ঈদুল আজহার দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায় করবেন। নামাজের খুতবায় খতিব তুলে ধরবেন কোরবানির তাৎপর্য। তবে এবার করোনা ও বন্যার মতো দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে ভিন্ন পরিবেশে কুরবানীর ঈদ হওয়ায় অন্যান্য বারের চেয়ে পশু কোরবানি কিছুটা কম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ১০ জিলহজ ঈদুল আজহা উদযাপিত হলেও পরের দুই দিনও পশু কোরবানি করার বিধান রয়েছে। সামর্থবান মুসলমানদের জন্য কোরবানি ফরজ হলেও ঈদের আনন্দ থেকে দরিদ্র দুঃস্থরাও বঞ্চিত হবেন না। কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির সমুদয় অর্থ ও কোরবানি দেয়া পশুর মাংসের তিন ভাগের এক ভাগ তাদের মধ্যে বন্টন করে দেয়া হবে। মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় এ উৎসব উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দও দেশবাসীকে ঈদ শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে স্বাস্থবিধি মেনে পশু কোরবানির জন্য নগরবাসীকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। সেই সাথে উভয় সিটি করপোশনের পক্ষ থেকে কোরবানীর পশুর বর্জ্য দ্রুত অপসারণের বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। দুই সিটি করপোরেশনের প্রয়োজনীয় সংখ্যক পরিচ্ছন্নতাকর্মী বর্জ্য অপসারণে নিয়োজিত থাকবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

সিএন/এমএ