কায়রোর আকাশে সূর্য তখন মৃদু স্বর্ণাভ। প্রাচীন মসজিদগুলোর মিনার ছুঁয়ে বাতাসে ভাসছে আজানের ধ্বনি। সেই পবিত্র নীরবতার মাঝে আল-আজহার শরীফের প্রাঙ্গণে মিলিত হলেন দুই প্রজ্ঞার আলোকবর্তিকা—আল-আজহারের গ্র্যান্ড ইমাম, অধ্যাপক ড. আহমদ আত-তাইয়্যিব, এবং সার্বভৌম মাল্টা অর্ডারের গ্র্যান্ড মাস্টার, প্রিন্স জন ডানল্যাপ।
তাদের সঙ্গে ছিলেন অর্ডারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিকার্ডো পাতারনো দি মন্টেকুপো। এ সাক্ষাৎ ছিল কেবল আনুষ্ঠানিক সৌজন্য নয়, বরং দুই মানবতার ঐতিহ্যের গভীর সংলাপ—একটি সভ্যতার সঙ্গে অন্য সভ্যতার অন্তরঙ্গ হাত মেলানো।
বৈঠকে গ্র্যান্ড ইমাম ড. আত-তাইয়্যিব আজকের বিশ্ব বাস্তবতার প্রতি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, যখন পৃথিবী শক্তি, ধ্বংস ও বিশৃঙ্খলার ভাষায় পরিচালিত হয়, তখন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেই মানবতার রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়াতে হবে।
তার কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল সেই করুণ আর্তি, যা নিরপরাধ শিশু, নারী ও শরণার্থীদের নীরব আহাজারি থেকে উঠে আসে।
গাজার মানুষের দুর্ভোগের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “গাজা আজ প্রমাণ করছে ক্ষমতার ঔদ্ধত্য কেমন করে মানবমর্যাদাকে পদদলিত করতে পারে। কিন্তু আমি আশার আলো দেখি—কারণ স্বাধীন বিশ্বের বিবেক জেগে উঠেছে। তরুণ প্রজন্ম আজ ইউরোপের রাস্তায় নেমে এসেছে, তারা গাজার নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে।
গ্র্যান্ড মাস্টার প্রিন্স জন ডানল্যাপ আল-আজহার শরীফ পরিদর্শন করে মুগ্ধতা প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, আল-আজহার শুধু একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়, এটি মানবতার আত্মা। সহস্র বছরের ইতিহাসে এটি প্রজ্ঞা, শান্তি ও সহমর্মিতার আলো জ্বালিয়ে রেখেছে।
তিনি গ্র্যান্ড ইমামের নেতৃত্বে বৈশ্বিক ন্যায়বিচার ও মানবভ্রাতৃত্বের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন এবং বলেন, মাল্টা অর্ডারও সেই একই মহৎ মূল্যবোধে বিশ্বাসী।
তিনি জানান, মাল্টা অর্ডারের সঙ্গে বর্তমানে ১১৫টি দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে এবং তারা ৫০টিরও বেশি দেশে মানবিক সহায়তা, ত্রাণ ও স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করছে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতায়।
তিনি দৃঢ় প্রত্যয় প্রকাশ করে বলেন, আমরা আল-আজহারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এমন এক বিশ্ব গড়তে চাই, যেখানে ধর্ম নয়, মানুষই হবে মানুষের পরিচয়।
আল-আজহার ও মাল্টা অর্ডারের এই ঐতিহাসিক সাক্ষাৎ কেবল দুই প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি নয়—এটি মানবতার প্রতি এক নৈতিক জাগরণের আহ্বান। কায়রোর প্রাচীন প্রাচীরে সেই দিনের সংলাপ যেন আজও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে: যেখানে শক্তির অহংকার নতজানু হয় করুণার সামনে, যেখানে ধর্ম ও জাতির সীমা ছাপিয়ে মানুষ আবারও মানুষকে খুঁজে পায়।
সেদিন কায়রোর বাতাসে এক অদ্ভুত প্রশান্তি নেমে এসেছিল—যেন হাজার বছরের পুরনো এই শহর আবারও সাক্ষী হলো এক নবজাগরণের, যেখানে প্রজ্ঞা, বিশ্বাস ও মানবতার আলো একসঙ্গে মিশে তৈরি করেছে নতুন এক ইতিহাসের সূচনা।
লেখক: কলামিস্ট ও শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর



চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন