শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

সরিষা হতে পারে সয়াবিনের বিকল্প

শুক্রবার, মে ১৩, ২০২২

প্রিন্ট করুন

ইফতেখার ইসলাম: তেলের তেলেসমাতিতে বাজারে আগুন যেন কোন ভাবেই নিভছে না। এই আগুনে প্রতিনিয়ত পুড়ে আঙ্গার হচ্ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো! যুদ্ধ,কৃত্তিম সংকট— সব মিলিয়ে তেলের বাজার চরম অস্থিতিশীল। বাজারে প্রতিলিটার সয়াবিন তেলের দর এখন ২২০ টাকার উপরে।  এমন পরিস্থিতিতে এই সংকট মোকাবেলায় বিকল্প কিছু ভাবার সময় এসেছে বলে মত বিশ্লেষকদের।

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশের অধিকাংশ ভূমি উর্বর। যেখানে উৎপাদিত হয় হরেক রকমের ফসল। এইসব ফসলের কিছু নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি হয় বিদেশেও। তবে পর্যাপ্ত পরিমাণে তেল দেশে উৎপাদিত না হওয়ায় প্রায় প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ তেল বাইরের দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এর ফলে বছরজুড়ে তেলের দাম কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী থাকে। তবে এবার কেবল ঊর্ধ্বমুখী নয়, তেলের দর একেবারেই আকাশচুম্বী। আবার কোথাও কোথাও সংকট এত প্রকোপ যে কয়েক দোকান ঘুরেও অস্তিত্ব নেই তেলের। এমন পরিস্থিতি থেকে রেহাই পেতে দেশে সরিষাসহ অন্যন্য তেলবীজ চাষে জোর দেওয়ার পরামর্শ বিশ্লেষকদের।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, দেশে প্রতিবছর ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে ২০ লাখ টন। যেখানে দুই লাখ উৎপাদন হয় স্থানীয়ভাবে। বাকি ১৮ লাখ টন সয়াবিন ও পাম অয়েল আমদানি হয় ভোজ্যতেল হিসেবে।

এর মধ্যে আবার অর্ধেকের বেশি আসে পাম অয়েল। এই পাম অয়েলের ৮০ শতাংশই আসে ইন্দোনেশিয়া থেকে। ইন্দোনেশিয়ার রপ্তানি বন্ধের কারণে শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশই ভোজ্যতেলের সরবরাহ সংকটে পড়েছে। কারণ এর আগে সানফ্লাওয়ারের বড় রপ্তানিকারক দেশ ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তাদের সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। এছাড়া লকডাউনের পর থেকে বেশিরভাগ মানুষ নতুন নতুন রেসিপি নিয়ে ঘরে তৈরি খাবারের দিকে ঝুঁকছেন। এতে করে তেলের চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত অয়েল সিড হিসেবে সরিষা, গ্রাউন্ডনাট, তিল, সয়াবিন ও সানফ্লাওয়ারের চাষ হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসেবে বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে তেলবীজের মোট উৎপাদন ছিল ৫,৮৮,৯৫৪ মে. টন, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৩২ হাজার টন বেশি। এর সঙ্গে রয়েছে রাইস ব্রান অয়েলের উৎপাদন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, সবমিলে স্থানীয়ভাবে ভোজ্যতেলের উৎপাদন ২ লাখ ৩ হাজার মে. টন।

এই পরিস্থিতিতে যখন চায়না, ভারতের মতো বড় দেশগুলো ভোজ্যতেলের বিকল্প খুঁজতে ব্যস্ত তখন বাংলাদেশেও আলোচনা চলছে সয়াবিন ও পাম অয়েলের বিকল্প নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিকল্প হিসেবে বাদামের তেল খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঠিকঠাক পরিকল্পনা করতে পারলে- রাইস ব্রান অয়েল, সরিষা, সানফ্লাওয়ার তেলের উৎপাদন বাড়াতে পারলে তা দিয়ে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বড় ধরনের আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে আনা সম্ভব।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘আমরা পাম অয়েলের বিকল্প সানফ্লাওয়ার অয়েল সহ অন্য যেসব তেল রয়েছে সেগুলোর আমদানি বাড়ানোর বিষয়ে কাজ করছি। একইসঙ্গে সরিষাসহ দেশে তেল উৎপাদনের যেসব উৎস রয়েছে, সেগুলো থেকেও উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়ে সরকারিভাবে আলোচনা ও পরিকল্পনার সুযোগ রয়েছে।’

বাংলাদেশে বেশ আদি ফসল হিসেবে পরিচিত সরিষা। তবে সময়ের পরিবর্তনের সাথে এর উৎপাদন খুব বেশি বাড়ানো যায় নি। ভারতভিত্তিক কমোডিটি মার্কেট রিসার্চ প্রতিষ্ঠান- মোরডোর ইন্টেলিজেন্স বাংলাদেশে সরিষার তেলের বাজার নিয়ে  সম্প্রতি আলাদা আলাদা গবেষণা প্রকাশ করেছে । দুটি গবেষণাতেই বাংলাদেশে সরিষার তেলের ঊর্ধ্বমুখী চাহিদার কথা বলা হয়েছে। ২০২৭ সাল পর্যন্ত ৫.৬-৫.৮ শতাংশ হারে এ তেলের বাজার বৃদ্ধি পাবে বলে সেখানে অনুমান করা হয়েছে।

তবে চাহিদা থাকার পরও উৎপাদন স্বল্পতার কারণে দেশে বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান ৩৫০ টাকারও বেশি দামে একেক লিটার তেল বিক্রি করছে। সরিষার তেলের উৎপাদন বাড়িয়ে চাহিদা পূরণ করতে পারলে এই দাম কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া পিঁয়াজের মতো ঊর্ধ্বমুখী তেলের দাম পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।

এক ফসলে বহুগুণ:

সরিষা শুধু তেল নয় এর আছে বহুগুণ। তেলের পাশাপাশি সরিষার খৈলও জমির সার ও পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সরিষার কঁচি গাছ ও পাতা শাক হিসেবেও অসাধারণ। কিছু গবেষণায় উঠে এসেছে সরিষা শাকের ভেতরে থাকা গ্লুকোসাইনোলেট ক্যান্সার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে, রক্তের কোলেস্টেরল কমায়, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে এবং হজমশক্তি বৃদ্ধি করে। এছাড়া সরিষার শাকে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও মিনারেল, যা শরীর রাখে সুস্থ ও কর্মক্ষম। এতে বিদ্যমান ভিটামিন ‘সি’তে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-এক্সিডেন্ট, যা ভাইরাসজনিত রোগ থেকে শরীরকে সুস্থ রাখে। আরো আছে ভিটামিন ‘এ’, যা দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে এবং ভিটামিন ‘কে’, যা কি না আমাদের মস্তিষ্ককে সক্রিয় রাখে। এ ছাড়া আছে আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, জিংক, সেলেনিয়াম, প্রোটিন ও ফাইবার। সবুজ পাতা ও গাছ সালাদ হিসেবে এবং সবুজ পাতা প্রক্রিয়াজাত রুচিবর্ধক খাদ্য হিসেবেও ব্যাপকভাবে সমাদৃত। এসব কারণে সরিষা শাক রক্তের কোলেস্টেরল কম রাখাসহ গর্ভবতী মায়ের সুস্থ সন্তান জন্মদানে উপকারী খাদ্য হিসেবে ভূমিকা রাখে।

এইদিকে সরিষা চাষে যেমন তেল,সবজি ও ঔষধি গুণ পাওয়া যায় ঠিক তেমনি এটির মাধ্যমে সম্প্রসারণ করা যায় মধু চাষও।  সরিষা ক্ষেতে মধু চাষ খুবই লাভজনক। এতে কৃষক ও মধু চাষি— দু’পক্ষই লাভবান হন৷ ফুলে ফুলে ঘুরে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে মৌমাছির ব্যাপক পরাগায়নে সরিষার বাড়তি ফলন পান কৃষক, আর মৌচাষিরা পান মধু।

মৌচাষিরা সাধারণত পছন্দের একটি সরিষা ক্ষেতের পাশে খোলা জায়গায় চাক ভরা বাক্স ফেলে রাখেন। একেকটি বাক্সে ৮-১০টি মোম দিয়ে তৈরি মৌচাকের ফ্রেম রাখা হয়। প্রতিটি মৌ বাক্সের ভেতরে রাখা হয় রানি মৌমাছি। ফুল থেকে মৌমাছিরা মধু এনে বাক্সের ভেতরের চাকে জমা করে। বাক্সে একটি রানি মৌমাছি রাখা হয়৷ রানি মৌমাছির কারণে ওই বাক্সে মৌমাছিরা আসতে থাকে। চাকের বাক্সের মাঝখানের নিচে ছিদ্র করে রাখা হয়। সে পথ দিয়ে মৌমাছিরা আসা-যাওয়া করতে থাকে। বাক্সের ভেতরের চাকগুলো মধুতে পরিপূর্ণ হতে সময় লাগে ছয় থেকে সাত দিন। এরপর মধু চাষিরা বাক্স খুলে চাকের ফ্রেম থেকে মেশিনের মাধ্যমে মধু বের করে নেন।

স্থানীয় কৃষকরা উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন সরিষা চাষে:

বাংলাদেশের ঢাকা, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, ফরিদপুর, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, বরিশাল, যশোর, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, পাবনা, রাজশাহী ও রংপুর জেলায় সরিষা বেশি চাষ হয়। অন্যান্য জেলায় এর চাষাবাদ তেমন নজরে পড়ে না। আর যে স্থানে হয় তাও সীমিত পর্যায়ে। তবে সম্প্রতি তেলার দাম অতিরিক্ত হারে বেড়ে যাওয়ায় চিন্তার ভাঁজ চাষাদের কপালেও। তাই অধিকাংশ কৃষক এখন আগ্রহী হচ্ছেন সরিষা চাষে।

চট্টগ্রাম মিরসরাই উপজেলার রফিক উদ্দীন নামে এক কৃষক বলেন, তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় পরিবার চালাতে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে। আমরা নিজের জমিতে ধান ও ডাল চাষ করে থাকি। তবে এখন থেকে চিন্তা করছি কিছু জমিতে সরিষাও চাষ করবে। তাহলে তেলের কিছুটা চাহিদা মিটবে।

এইদিকে চট্টগ্রামের হাটহাজারী এলাকার আরেক কৃষক শহজাহান খান বলেন, আমাদের এই দিকে সূর্যমুখীর চাষ হচ্ছে। তেলের দাম যে হার বেড়েছে তাতে বিকল্প কিছু ভাবা ছাড়া উচিত নেই। আমরা চিন্তা করছি সরিষা বা সূর্যমুখী চাষের। এতে সমস্যা কিছুটা হলেও সমাধান হবে।

বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা দাবি করেন, ভোজ্যতেলের আমদানিনির্ভরতা কমাতে সরিষা আবাদের পরিমাণ বাড়াতে হবে। এ জন্য এখনই প্রয়োজন তেল ফসলের চাষাবাদ বৃদ্ধি করে উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্ব দেয়া।

বিনার উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের উপপ্রকল্প সমন্বয়ক ড. রেজা মোহাম্মদ ইমনের দাবি, দেশের ২২ লাখ হেক্টর পতিত (দুই ফসলের মাঝের) জমিতে যদি বিনাসরিষা-৪ ও বিনাসরিষা-৯ আবাদ করা যায়, তাহলে বছরে ১৭ হাজার কোটি টাকার তেল আমদানি সাশ্রয় করা সম্ভব।

তিনি আরও মনে করেন, প্রতি বছর ৩ দশমিক ৫ লাখ টন উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হলে ২০৩০ সালে মোট সরিষা উৎপাদন হবে প্রায় ৪৬ দশমিক ৬৩ লাখ টন, যা থেকে প্রায় ১৬ দশমিক ৩২ লাখ টন তেল পাওয়া সম্ভব। এতে ১৭ হাজার কোটি টাকার যে তেল আমদানি করতে হয়, তা আর আমদানি করতে হবে না। এ জন্য অবশ্যই দুই ফসলি জমিকে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করতে হবে বিনাসরিষার মাধ্যমে।

আইআই/সিএন

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন