সানজিদা ইয়াসমিন লিজা: “ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি”- কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের এই কথার সাথে একাত্বতা পোষণ করে জীবনের সাথে সংগ্রাম করে যেসব শিশুরা শুধু খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় শুধু তারাই বুঝতে পারে জীবন মানে কি! সেটা আমরা সভ্য সমাজে দালান অট্টালিকায় বসে অনুভব করা সম্ভব নয়।জীবনে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকাটাও তাদের কাছে স্বপ্নের মতো।
আমরা জানি যে,পৃথিবীতে বাবা মায়ের চেয়ে আপন কেউ কখনো হতে পারে না।জীবনের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে হলেও প্রত্যেক বাবা-মা তার সন্তানদের সুখে শান্তিতে থাকার ব্যবস্থা করে যেতে চান।সন্তানের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য তারা আজীবন নিজের সাথে যুদ্ধ করে যান। প্রত্যেক পিতামাতাই তার সন্তানকে রাজপুত্র, রাজকুমারীর মতো রাখার স্বপ্ন দেখেন, কিন্তু বাস্তবে তা আর অনেকের হয়ে ওঠেনা। হাজারো কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করার পরেও জীবন ধারনের ৫ টি মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে তারা ব্যর্থ হন।
তখন বাধ্য হয়ে সন্তানেরা নিজের বেঁচে থাকার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়।ফলস্রুতিতে যে বয়সে তাদের বই খাতা নিয়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা ছিলো, ঠিক সেই বয়সে তারা নিজের জীবনের তাগিদে, কোনো রকম খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন বাসাবাড়িতে কাজ নেয়।অথবা সেই সময়ে বিভিন্ন কল- কারখানায় শিশু শ্রমিক হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে।
তাদের মধ্যে ছেলে শিশুরা বেশিরভাগ সময় ইট ভাটায়,মুদি দোকানে বা হোটেলে কাজ নেয়। আর মেয়ে শিশুরা বিভিন্ন বাসা বাড়িতে বুয়ার কাজ নেয়।
এসব মেয়ে শিশুরা কাজ করতে গিয়ে অসাবধানতাবশত অনেক সময় বাসার অনেক জিনিসের ক্ষতি করে ফেলে।যেমনঃ প্লেট বা গ্লাস ভেঙে ফেলা,অথবা রুম পরিষ্কার করতে গিয়ে ফুলদানি বা অন্যান্য জিনিস ভেঙে ফেলে।তখন অনেক কম মালিকেরাই আছে যারা ওদের না শাসিয়ে থাকে।অনেকে মারধর পর্যন্ত করে এসব নাবালক শিশুদের উপরে। অনেক নির্দয় মানুষ আজও আমাদের সমাজে বিদ্যমান যারা এই সামান্য থেকে সামান্য ভুলও মেনে নেয় না।তারা এই বাচ্চা শিশুদের উপরে অনেক অত্যাচার করে, অনেকে মারধর করে বেতন না দিয়েই বাসা থেকে তাড়িয়ে দেয়।
ক্ষনিকের জন্যেও এদের মনে এতটুকু মায়ার জন্ম হয় না যে,একই বয়সী মেয়ে শিশু তার নিজের ঘরে আছে, যাদেরকে অনেক আদরে আহ্লাদে বড় করা হচ্ছে, সে যতই ক্ষতি ভাঙচুর করুক না কেন সে আদরেই থাকে। অথচ একই কাজ কাজের মেয়ে করলে তার উপরে কত শাস্তি,কত নির্মম ব্যবহার করা হয় ওর সাথে।
সময় এসেছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর।জীবনের সাথে লড়াই করে যারা শুধু খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন নিয়ে বিভিন্ন বাসাবাড়িতে, কল কারখানায় কাজ নেয়,নিজেকে শিশু শ্রমিক হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে তাদেরকে নিয়ে কিছু ভাবার।আমরা সচেতন ও বিবেকবান মানুষেরাই পারি তাদের অবস্থার উন্নতি করতে।আমরা আমাদের সাধ্যনুযায়ী তাদের জন্য কাজ করতে পারি।প্রতিটি ঝড়ে পড়া এমন নাবালক শিশুদের স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারি।সমাজের বিত্তবান মানুষ এক্ষেত্রে অনেক কাজ করতে পারেন।প্রতিটি এলাকায় যদি ১০ জন মানুষও এদের জন্য ভাবে,ওদের পড়াশোনা ও দেখাশুনার দায়িত্ব নেয় তাহলে এমন একটা সময় আসবে যখন নাবালক শিশুদের কাজে যেতে হবে না,শিশুশ্রম বন্ধ হবে, এই কনকনে শীতের মধ্যে খালি গায়ে ফুটপাতে দেখতে হবে না পথশিশুদের। আমাদের তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে।
আমরা যারা সুস্থ ও সচেতন নাগরিক তারাই একমাত্র পারি এই পরিবর্তন আনতে। আমরা এমন একটা দেশের স্বপ্ন দেখি যেখানে থাকবে না কোনো নাবালক গৃহকর্মী,থাকবে না কোনো শিশু শ্রম,থাকবে না কোনো ফুটপাতে কনকনে ঠান্ডায় পথশিশুদের বিছানা।
তবে আশার কথা হচ্ছে, ধীরে ধীরে অনেক পরিবর্তন শুরু হয়েছে। পুরোপুরি পরিবর্তন করতে হলে আমাদের সবাইকে যে, যার জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা, সহানুভূতিশীল ও আন্তরিক হতে হবে, তাহলেই একদিন আমাদের এই সমাজের চিত্র পরিবর্তন হতে বাধ্য থাকবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ২য় বর্ষ,কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
আইআই/সিএন
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন