চলমান ডেস্ক : একুশ আমাদের প্রতিবাদী সংগ্রামী হতে শিক্ষা দেয়। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে বাঙালি সংগ্রামের সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে তা সত্যিই বিস্ময়কর। ভাষা শহিদদের দেশপ্রেম ও ভাষাপ্রেমের ইতিহাস আজও আমাদের আত্মচেতনাকে জাগ্রত করে ভাষা সংস্কৃতি, কৃষ্টির উত্তরাধিকার ও ঐতিহ্য রক্ষায় সংকল্পবদ্ধ করে তোলে। একুশের যে চেতনা এ দেশের মানুষকে আত্মপরিচয়ের পথ দেখিয়েছে, সে চেতনায় সমগ্র বাঙালিসত্তা উপলব্ধি করে আমি বাঙালি, বাংলা আমার মাতৃভাষা, আমি মায়ের ভাষায় কথা বলি।
১৯৫২ সালে বাংলা ও উর্দু ভাষার বিতর্কের কারণে বাংলাদেশে চার তরুণ ছাত্র বিক্ষোভের সময় নিহত হয়েছিলেন। এ ঘটনার পর জাতিসংঘের শিক্ষাগত বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে একটি বার্ষিক অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত নেয়, যা সারা বিশ্বে উদ্যাপিত হয়। বাংলাদেশের জন্য তা এক ঈর্ষণীয় গৌরবের বিষয়। বাংলাদেশের বাঙালি জাতিসত্তায় গলে যাওয়া পাত্রের মতো আমাদের সংস্কৃতি। এর রয়েছে মিশ্র সংস্কৃতি। এর স্থাপত্য, নৃত্য, সাহিত্য, কবিতা, নাটক, সংগীত এবং চিত্রকলার শিকড় ও ঐতিহ্য ব্যাপকভাবে প্রতিফলিত। দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনেক বৈচিত্র্যের একটি সুখী সংমিশ্রণ।
যেভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেল : কানাডা প্রবাসী কতিপয় উদ্যমি বাঙালির সংগঠন Mother Tongue Lovers Association UNESCO- এর সাধারণ সম্মেলনে ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাবের জন্য বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে দাবি জানায়। তাছাড়া UNESCO সেক্রেটারিকে এদেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির গৌরবময় ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত করা হয়।
রবর্তীতে রাষ্ট্রগুলো ইতিবাচক সাড়া দেবার পর ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত UNESCO সাধারণ পরিষদের সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষামন্ত্রী একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বমাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব করেন। UNESCO -এর ১৯১টি সদস্যরাষ্ট্রের সর্বসম্মতিক্রমে বিলটি পাস হয়। এরপর ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সারাবিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়।
ইউনেসকো ২০২২ সালের জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের একটি থিম নির্ধারণ করেছে, ‘বহুভাষিক শিক্ষার জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার: চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ’। বহুভাষিক শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে এবং সবার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা ও শিক্ষার বিকাশে সহায়তা করতে প্রযুক্তির সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা হবে এবারের উদ্যাপনে।
একুশ বাঙালি জাতিকে প্রতি বিন্দু রক্তের জাগরণে জন্ম দিয়েছে। প্রতিষ্ঠা দিয়েছে এর ভাষাকে। একুশ মানে তাই আমরা বুঝি একতাবদ্ধতা, উন্নততর নৈতিক মূল্যবোধ, স্বদেশপ্রেম, ভ্রাতৃপ্রেম, মাতৃপ্রেম এবং মুক্তবুদ্ধি। একুশের মর্মবাণী বলতে আমরা বুঝি কারও কাছে মাথা নত না করা। একুশের দাবি বলতে আমরা বুঝি জীবনের দাবিকে ঘোষণা করা। একুশের অঙ্গীকার বলতে আমরা বুঝি হৃদয়ের অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়া। একুশ মানে হচ্ছে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, আন্দোলন ও সংগ্রাম।
বিশ্বব্যাপি একুশের চেতনা ছড়িয়ে দিতে এবং সারাবিশ্বের মার্তৃভাষা সংরক্ষণে আজ সোমবার (২১ ফেব্রুয়ারি) আর্ন্তজাতিক মার্তৃভাষা দিবস যথাযথ মর্যাদায় উদযাপন করছে জাতিসংঘ এবং ইউনেস্কো (জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা)। মার্তৃভাষার চেতনায় বিশ্ববাসীকে উজ্জীবিত করতে এবং সকল মায়ের ভাষা সংরক্ষেণে বৈশ্বিক উদ্যোগের পাশাপাশি বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের ৬০টি দূতাবাসের ৮১টি মিশনও দিবসটি উদযাপন করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কূটনৈতিক অঙ্গণে একুশের চেতনা (আর্ন্তজাতিক মার্তৃভাষা দিবস) বাংলাদেশের জন্য সফট পাওয়ার। যা কূটনীতিতে ব্যবহার করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি সকল মার্তৃভাষা সংরক্ষণে এবং মাতৃভাষার বিকৃতিরোধে বাংলাদেশ নেতৃত্ব দিতে পারে। মূলত একুশের চেতনা এখনও শতভাগ সারাবিশ্বে বাস্তবায়িত হয়নি। তাই একুশের মূল চেতনার বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাপি একটি সমন্বিত নীতিমালা প্রনয়ণ এবং বাস্তবায়ন জরুরি।
অপ্রিয় হলেও সত্য, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের যে দাবি ছিল তা আজও পূরণ হয়নি। শুধু কাগজে-কলমে রাষ্ট্রভাষা বাংলা। কিন্তু সর্বত্রই ইংরেজিসহ বিদেশি ভাষার দাপট ও আগ্রাসন। ভাষা শহিদদের চাওয়া এখনো পূরণ হয়নি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নেয়া হয়। বিভিন্ন সরকারের আমলে আইনও প্রণয়ন করা হয়। আইনের প্রয়োগ না থাকা অথবা মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞার কারণে দেশের বেশিরভাগ স্তরেই বাংলা বিমুখতা প্রকট আকার ধারণ করে। সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও রয়েছে। এত কিছুর পরও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়নি। এভাবে চলতে থাকলে রাষ্ট্রভাষা বাংলা একদিন অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। তাই মাতৃভাষার সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করতে হবে সবাইকে।
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন