শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

স্মরণ: বিপ্লবী মাওলানা মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী

বুধবার, আগস্ট ২৩, ২০২৩

প্রিন্ট করুন

সৈয়দ শিবলী ছাদেক কফিল: মাওলানা মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী (ইসলামাবাদী) কালের স্মরণীয় এক বিপ্লবীর নাম। তিনি ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কবি ও রাজনীতিক। তিনি বিখ্যাত আলেম হয়েও দেশ ও আমজনতার জন্য ছিলেন অসাম্প্রদায়িক সংগ্রামী নেতা। তিনি কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত কিংবা আপোষ করেন নাই। লোভ ও সংকীর্ণতা কখনো তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি নিজেকে এছলামাবাদী লিখলেও বর্তমানে ইসলামাবাদী নামে পরিচিত।

মনিরুজ্জামান ১৮৭৫ সালের ২২ আগস্ট চট্টগ্রাম জেলার তৎকালীন পটিয়া থানার (বর্তমান চন্দনাইশ উপজেলার) বরমা ইউনিয়ানের আড়ালিয়া গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেন। তার পিতার নাম মুনসী মতিউল্লাহ্। তিনি নিজ গ্রামের জনৈক হুজুরের নিকট প্রাথমিক শিক্ষা নেন। তার পিতা-মাতার আগ্রহে উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি কলকাতার হুগলী সিনিয়র মাদরাসায় ১৮৮৯ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৮৯৫ সালে এফএম ফাইনাল পরীক্ষা পাস করেন। আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় শিক্ষা শেষ করে তিনি প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতিতে বিশ্ব মানের উপযুক্ততা অর্জনের জন্য রাজস্ব আইন অধ্যয়ন করেন। তিনি ইংরেজি, বাংলা, আরবী, ফার্সী ও উর্দু ভাষায় পড়াশোনা করে অসাধারণ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন এবং বিখ্যাত ও জনপ্রিয় আলেম হয়ে ওঠেন।

অধ্যয়ন শেষে তিনি হুগলী সরকারি মাদরাসায় চাকুরির প্রস্তাব পেয়েও প্রত্যাখান করেন। তিনি সেখান থেকে রংপুরে এসে রংপুর শহরের মুনসীপাড়া জুনিয়র মাদরাসায় হেড মাওলানা পদে যোগ দিয়ে ১৮৯৬-১৮৯৭ পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। এরপর তিনি রংপুরের জেলার পীরগঞ্জ থানার কুমেদপুর মাদরাসায় হেড মাওলানা পদে ১৮৯৮-১৯০০ পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। এরপর সীতাকুণ্ড সিনিয়র মাদরাসার প্রধান শিক্ষক পদে কিছু দিন শিক্ষকতা করেন।

এছলামাবাদী ছিলেন সুন্দর-শিক্ষিত, উজ্জীবিত, কুসংস্কারমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক এক কৃতী মানুষ। শিক্ষা যাতে বৈজ্ঞানিক ও বাস্তবিক জ্ঞানের ভিত্তিতে হতে পারে, সে জন্যও তিনি নানা পরিকল্পনা ও ব্যবস্থার উদ্ভাবন করেন। এছলামাবাদী রংপুর থাকাকালেই মাদরাসা শিক্ষায় ইসলামী শিক্ষার পাশাপাশি ইংরেজি, বাংলা, গণিত এবং ইতিহাস ও ভূগোলের কিছু কিছু জ্ঞান চর্চার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

রংপুর থেকে চট্টগ্রামে ফিরে খান বাহাদুর আবদুল আজিজের আহব্বানে যোগ দেন ভিক্টোরিয়া এছলামী হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্ট পদে। এখানে পরিচিত হন সীতাকুণ্ডের মাওলানা ওবায়দুল হকের সাথে। হুজুরের আহবানে এছলামাবাদী এসে যোগ দেন, আত্মনিয়োগ করে মাদরাসা ও স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজে। সীতাকুণ্ডে অবস্থানকালে ওবায়দুল হক ও মাওলানা জামালউল্লাহর সান্নিধ্যে থেকে তিনি অধিক কর্মমুখী হন। বার্মা থেকে কলকাতা-আসাম পর্যন্ত তার প্রভাব ও পরিচিতি বিস্তার লাভ করে। অবিভক্ত বাংলায় মুছলেম শিক্ষা কনফারেন্স আহবান, বঙ্গীয় মুছলমান সাহিত্য সমিতি, প্রাদেশিক মোছলেম শিক্ষা সমিতি গঠন ও পরবর্তী আঞ্জুমান প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ১৯৩০ সালে তিনি চট্টগ্রামের কদমমোবারক মুসলিম এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন।

এছলামাবাদী রাজশাহীর বিশিষ্ট পণ্ডিত মির্জা ইউসুফ আলী প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘ছোলতান’ (১৯০৩) এর সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। তার সম্পাদনায় পত্রিকাটি বাংলা সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বিশেষ স্থান অধিকার করে। ১৯১৩ সালে বগুড়ার বানিয়ায় আঞ্জুমান-এ-ওলামা-এ-বাঙ্গালা প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের জয়েন্ট সেক্রেটারি ছিলেন। ১৯১৫ সালের এপ্রিল-মে, ১৩২২ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে কলকাতায় ‘আঞ্জুমানের’ মুখপাত্র ‘আল-এছলাম’ প্রকাশিত হয়। মনিরুজ্জামান বহুদিন পর্যন্ত এ পত্রিকাটির সম্পাদনা করে মুছলেম সাহিত্যের দুর্ভিক্ষের যুগে খ্যাতিমান মুছলেম লেখক গোষ্ঠী গঠন ও এছলামী সাহিত্য প্রণয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ‘বঙ্গীয় মুছলমান শিক্ষাসমিতি’ (১৯০৩) ও ‘বঙ্গীয় মুছলমান সাহিত্য সমিতি’ (১৯১১) এরও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও উভয় সমিতির কার্যনির্বাহ কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯১৮ সালে তিনি সাপ্তাহিক ‘মোহাম্মদী’র সম্পাদনা পরিষদে যোগ দেন ও এর পরিচালনায় মাওলানা আকরম খাঁর সহযোগিতা নেন। ১৯১২ সালে কলকাতার ফার্সী পত্রিকা ‘হাবলুল মতিন’ এর বাংলা সংস্করণের সম্পাদন করেন কিছু দিন। এছাড়া, আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাংলার মুখপত্র মাসিক ‘আল-এছলাম’ পত্রিকারও তিনি সম্পাদক ছিলেন। এর বাইরেও তিনি একাধিক পত্রিকার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯২৮ সালে তিনি নিজ দায়িত্বে দৈনিক ‘আম্বর’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। তিনি চট্টগ্রাম থেকে ‘এছলামাবাদ’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা কিছু দিন পরিচালনা করেন।

চট্টগ্রামের দক্ষিণ মহকুমার কর্ণফুলীর তীরবর্তী দেয়াং পাহাড়ে এছলামী (ইসলামী) বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ১৯১৫ সালে তিনি ৬০০ বিঘা জমি ৫০০ কানি ভূমি রেজিস্ট্রিমূলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নিয়েছিলেন। তিনি নিজ গ্রামের পাশে বরকল শামসুজ্জামান উচ্চ বিদ্যালয়, কদমমোবারক ইয়াতিমখানা, কদমমোবারক ইয়াতিমখানা (ওয়াইকে) উচ্চ বিদ্যালয়, বরকল প্রাথমিক বিদ্যালয় ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও, তার চেষ্টা ও প্রেরণায় উত্তরবঙ্গে কয়েকটি স্কুল, মাদ্রাসা গড়ে ওঠে।

তিনি কংগ্রেসের অহিংস নীতির প্রতি আস্থা হারান ও নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি সমর্থন দান করে ফরোয়ার্ড ব্লকে যোগ নেন। তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ভারত ছাড় আন্দোলনে যোগদান ও আজাদ হিন্দ ফৌজের কার্যক্রমের প্রতি সক্রিয়ভাবে সমর্থন করা। তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় বিপ্লবী কেন্দ্র স্থাপন করেন। নেতাজী যখন আজাদ হিন্দ ফৌজ নিয়ে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দখল করে ভারতের ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা উড়িয়ে ‘দিল্লি চলো’ শ্লোগান তুলে এগিয়ে চলছিলেন ভারতের দিকে, ঐ সময় মনিরুজ্জামান এছলামাবাদীর সাথে পরিচয় হয় বেংগল ভলান্টিয়ার্সের সুবোধ চক্রবর্তীর। সুবোধের সাথে আলাপ করে মনিরুজ্জামান এত বেশি মুগ্ধ হন যে, শেষ বয়সে একটা ঝুঁকি নেয়ার জন্য রাজি হন। সুবোধকে সঙ্গে নিয়ে তিনি চলে আসেন চট্টগ্রাম। পাহাড়-পর্বত ডিঙ্গিয়ে আরাকানের পথ ধরে ফের নেতাজীর সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার লক্ষ্যে যখন পথ চলছিলেন, তখন সীমান্ত এলাকায় ছিল সতর্ক পাহারা। আজাদ হিন্দ ফৌজ দখলে থাকার কারণে সতর্কতা সীমাহীন হয়ে পড়ে। মনিরুজ্জামানের বীরকণ্ঠে তার সহচরকে বলেছিলেন, আমার জীবনের মাত্র কয়েক দিন বাকি, এই সময় চরম ঝুঁকি নিতে আমার অসুবিধেও নেই। শ্যালক মোরশেদকে নিয়ে একেবারে ফকির সেজে নেতাজীর সাথে তিনি সাক্ষাৎ করেছিলেন। ব্রিটিশ গুপ্তচরেরা তখন মাওলানার সব বিপ্লবী কর্মকান্ড বুঝতে পারে। সে কারণে চট্টগ্রাম শহরস্থ বাড়ি, তৎকালীন আড়ালিয়া গ্রামের বাড়ি, সীতাকুন্ডের বাড়ি, কলকাতার বাস ভবন ইত্যাদি স্থানে ইংরেজ সার্জেন্টের নেতৃত্বে বিপুল সেনার মাধ্যমে তল্লাশি চালায়। মাওলানাকে চট্টগ্রাম শহর থেকে গ্রেফতার করা হয়। ব্রিটিশ সরকার মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু প্রভৃতি নেতার সাথে মনিরুজ্জামানকেও ভারতের দিল্লির লালকিল্লায় বন্দী করে রাখেন। অতঃপর তাকে সেখান থেকে পাঞ্জাবের মাওয়ালী জেলে স্থানান্তর করা হয়। সেখানকার জেলের ছাদের বিমে রশিতে ৬৫ বছর বয়স্ক মাওলানা মনিরুজ্জামান এছলামাবাদীর দুই পা বেঁধে মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে রেখে তার উপর অশেষ নির্যাতন চালানো হয়েছিল গোপন তথ্য জানার জন্য।

মনিরুজ্জামান ছিলেন মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানীর শিক্ষক। তিনি (মনিরুজ্জামান) সাহিত্য চর্চা, গবেষণা ও রচনা করতেন যথেষ্ট। ইসলামি সভ্যতা ও গণমানুষের অধিকার নিয়ে লিখেছেন। লিখেছেন কবিতা ও গল্প। লেখালেখি করেছেন একাধিক ভাষায়। বাংলা, আরবী ও ফারসি তার লেখালেখির ভাষা। ইসলামি সংস্কৃতি ও ইতিহাস নিয়ে তার অবদান অপরিহার্য। তেমনি দেশীয় ও বৈশ্বিক সংস্কৃতি ও ইতিহাসেও অবদান উল্লেখযোগ্য। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন কলম দিয়ে, মাঠে নেমে আন্দোলন করেছেন। তার লেখায় জ্ঞান পিপাসা মিঠায় এবং উদ্দীপনা ও জাগরণ সৃষ্টি করে। এছলামাবাদী ৪২টির মত গ্রন্থ রচনা করেন। তৎমধ্যে ইসলামী শিক্ষা, কোরআন ও বিজ্ঞান, ভারতে মুছলেম সভ্যতা, সমাজ সংস্কার, ভূগোল শাস্ত্রে মুছলমান, এছলাম জগতের অভ্যুত্থান, ভারতে এছলাম প্রচার, সুদ সমস্যা, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুছলমানদের অবদান ও আত্মজীবনী ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

এই কৃতী ও প্রাতঃস্মরণীয় মহান ব্যক্তি (মনিরুজ্জামান) ১৯৫০ সালের ২৪ অক্টোবর মৃত্যু বরণ করেন। তার ইচ্ছা অনুযায়ী তার প্রতিষ্ঠিত কদমমোবারক ইয়াতিমখানা ও মসজিদ সংলগ্ন কবর স্থানে তাকে দাফন করা হয়। তিনি জাতির প্রেরণা হয়ে তার কাজের মধ্য দিয়ে অমর হয়ে থাকবেন অনন্তকাল।

লেখক: ছড়াকার ও সাংবাদিক, বরমা, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম।

সিএন/এমএ

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন