মাওলানা ছৈয়দ আখতার কামাল শাহ্: আলা হযরত গাউছে মোকাররম, শাহে দো আলম, হাজত রাওয়া, মুশকিল কোশা, শাহ্ছুফী হাফেজ মাওলানা ছৈয়দ নজীর আহমদ শাহ্ আল মাইজভান্ডারী (ক.) বার আউলিয়ার পূণ্যভূমি চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার (বর্তমান কর্ণফুলী থানা) অন্তর্গত জুলদা গ্রামে মুনছুর আলী চৌধুরী বাড়ীর সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে মরহুম মোহাম্মদ আছদ আলী চৌধুরীর ঔরষে জন্ম নেন। তিনি মরহুম আছদ আলী চৌধুরীর চার পুত্র সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় পুত্র ছিলেন। ২২ রবিউস ছানী ১৩১৬ হিজরী, ৩ আশ্বিন ১৩০২, ১২ জুন ১৮৯৬ ইংরেজী, সোমবার ছোবহে ছাদেক। এ মহান অলি ৬৩ বৎসর বয়সে, ১৫ রজব ১৩৮৯ হিজরী, ২৯ পৌষ ১৩৬৫ বাংলা, ১৩ জানুয়ারী ১৯৬০ ইংরেজী বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টায় অগণিত ভক্ত, অনুরক্ত ও আশেকানদের ছেড়ে পরম মাসুকে হাকিকির নিকট বেছাল প্রাপ্ত হন (ইন্না লিল্লাহে………রাজিউন)।
হযরত নজীর ভান্ডারী (ক.) তার পিতা-মাতা ও ভাই-বোনদের সাথে একটি আদর্শ পারিবারিক পরিবেশে বড় হয়ে উঠেন। বাল্যকালে তিনি বাড়ীর বা এলাকার অন্য সব ছেলেদের তুলনায় ভিন্ন স্বভাবের ছিলেন। একাগ্রতা, শিষ্টাচারিতা, সদালাপিতা ও অধ্যবসায় ইত্যাদি তার চরিত্রে শোভা পেত। পাশাপাশি তিনি লেখাপড়ায়ও মনোনিবেশ করেন।
তিনি এতই মেধাবী ছিলেন যে, মাত্র নয় বছর বয়সে কালামউল্লা শরীফ মুখস্থ করতে সক্ষম হন। ১৪ বছর বয়সে মসজিদে খতমে তারাবির নামাজের দায়িত্বভার নেন ও ঈমাম নিযুক্ত হন। স্থানীয় প্রাইমারী স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে উচ্চতর শিক্ষার জন্য তিনি চট্টগ্রাম শহরে আসেন ও পশ্চিম মাদারবাড়ী নিবাসি শিক্ষাবিদ রশিদ মাষ্টারের বাড়িতে জাগির থাকা শুরু করেন। তদ্বকালিন আলেমেদ্বীন, বাহারুল উলুম, হযরত মোহাম্মদ নাজের শাহের (রা.) (বর্তমানে হযরত গরিব উল্লাহ শাহের (রা.) মাজারের সামনে তার মাজার শরফি অবস্থিত) ব্যবস্থাপনায় পরিচালিক সরকারি মোহছেনিয়া মাদ্রাসায় তিনি ভর্তি হন। হযরত নজীর ভান্ডার (ক.) তার মেধা, অধ্যবসায় ও সৎ চরিত্রের কারণে হযরত নাজের শাহ (রা.) ও অন্যান্য মোদাচ্ছেরগণের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে সমর্থ হন। তিনি আরবী, উর্দু ও ফার্সী ভাষায় বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। ইলমে শরিয়তে পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জনে উদ্দেশ্যে ফিকাহ্, নাহু, ছরফ ও মানতেক বিষয়ে গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন। মোহছেনিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষা শেষে তিনি ইলমে তফছির ও ইলমে হাদিস শরীফের উপর স্নাতক ডিগ্রি লাভের উদ্দেশ্যে আরো দশজন সহপাঠীসহ এ উপমহাদেশের তদ্বকালীন সর্বোচ্চ ইসলামি বিদ্যাপীঠ কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় যান। সেখানে তিনি দীর্ঘ পাঁচ বছর ইলমে তফছির ও ইলমে হাদিস শরীফের উপর অধ্যয়ন করেন। অকুতোভয় যুবক হযরত নজীর ভান্ডারী (ক.) কোরআন শরীফ, হাদিস শরীফ, ইজমা, কেয়াস, ফেকাহ, নাহু, ছরফ, বালাগাত, মানতেকসহ সব বিষয়ে যেমন পারদর্শিতা অর্জন করেন, তেমনি ইলমে ফরায়েজ ও ইলমে সিফা তথা হেকিমি বিদ্যায়ও সমান পারদর্শিতা লাভ করেন।
হযরত নজীর ভান্ডারী (ক.) পর পর মোট চারটি বিবাহ করেন। প্রথম স্ত্রীর নাম জানা নাই। তার গর্ভে একটি মাত্র কন্যা সন্তান ছিল। নাম মরহুমা ছৈয়দা আমাতুন নুর বেগম। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর চট্টগ্রাম ডবলমুরিং থানার অন্তর্গত পাঠানটুলী কাপুড়িয়া পাড়াস্থ হযরত মাওলানা শাহ ছুফী ছৈয়দ আমানত উল্ল্যা শাহ্ আল মাইজভান্ডারীর (র.) কনিষ্ঠ কন্যা ছৈয়দা আছমা খাতুনকে (র.) তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করেন। তার ওই দ্বিতীয়া স্ত্রী আরবী শিক্ষায় শিক্ষিতা ও ইনছানে কামেলা ছিলেন। হযরত আছমা খাতুনের গর্ভে তিনটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। যথাক্রমে মরহুমা ছৈয়দা রাজারিয়াতুন নুর বেগম। যিনি শৈশবকালে ইন্তেকাল করেন। মরহুমা ছৈয়দা জিয়াততুন নুর বেগম ও মরহুমা ছৈয়দা সাজেদাতুন নুর বেগম। বিশেষ এক পর্যায়ে হযরত নজীর ভান্ডার দ্বিতীয় স্ত্রীর অনুরোধে তৃতীয় বিবাহ করেন ও শেষোক্ত স্ত্রীকে বিবাহের এক বছরের মধ্যে মোহরানা সমেত বিদায় করেন। দ্বিতীয় স্ত্রী হযরত ছৈয়দা আছমা খাতুন (র.) আধ্যাত্মিক সাধন ভজনে অনেক উচ্চস্তরে উপনীত হওয়ায় তিনি সংসার জীবন থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করতেন। যেহেতু তাদের কোন পুত্র সন্তান ছিল না, তাই পুত্র সন্তানের প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তা করে তিনি তার স্বামীকে অনেক অনুরোধ করিয়া চট্টগ্রাম জেলার চাদগাঁও থানার অন্তর্গত হযরত মাওলানা শাহছুফী ছৈয়দ আবদুল কাদের শাহ আল মাইজভান্ডারীর কনিষ্ঠ কন্যা ছৈয়দা জেবুননিছা বেগমকে (র.) চতুর্থ স্ত্রী রূপে বিবাহ করান। ওই স্ত্রীর গর্ভে তিন শাহজাদা ও এক শাহজাদী জন্ম নেন। তবে মেজ শাহজাদা চার বছর বয়সে মারা যান।
মোমেনের চরিত্রের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আমানত রক্ষা করা। আমানত বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে। এক- কারো গচ্ছিত সম্পদ কিংবা টাকা-পয়সা চাহিদা মোতাবেক ফিরিয়ে দেয়া, দুই- ওয়ারিশানগণের মধ্যে সঠিকভাবে স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির বন্টন করা ও তিন অন্যের গোপনীয়তা রক্ষা করা। উপরোল্লেখিত সব আমানতের হেফাজতকারী রূপে হযরত নজীর ভান্ডারী (ক.) ছিলেন দিনের সূর্যের ন্যায় প্রজ্বলিত (আল-হামদুলিল্লাহ)। স্মরণ রাখা উচিত যে, তরীকায়ে মাইজভান্ডারীরয়া খিজরি বেলায়েতের অন্তর্ভূক্ত। ওই খিজরি বেলায়ত তরীকায়ে মাইজভান্ডারীয়ার অন্তর্ভুক্ত থাকায় এ তিরকায় অনেক কাজকর্ম দৃশ্যত: শরিয়ত বিরোধী মনে হলেও আসলে তা নয়। সে যুগের অনেক আলেম উলামা মাইজভান্ডারী তরিকার বিরোধীতা করেছেন, বর্তমানেও করছেন। এমন বিরোধীতাকারী অনেক আলেম হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারীরে (ক.) সাথে মোনাজেরা করতে গিয়ে তার গাউছিয়াতের আলোতে আলোকিত হয়ে ইনছানে কামেল হয়েছেন। হযরত নজীর ভান্ডার (ক.) ও বিরোধীকারী আলেমদের মধ্যে একজন ছিলেন ও পরবর্তী তিনিও হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারীর (ক.) গাউছিয়াতের আলোতে আলোকিত হয়েছেন।
একদা হযরত নজীর ভান্ডার (ক.) রেঙ্গুন থাকাকালীন সেখানে চট্টগ্রাম শহরের পাঠানটুলী চাটশ্বরাই গায়েবি মসজিদ এলাকার এক পূর্ব পরিচিত লোক তার শরনাপন্ন হন ও আরজ করলেন, ‘আমি মানত করেছি, বাড়িতে গিয়ে আপনার মাধ্যমে আমার বাড়িতে মিলাদ মাহফিল উদযাপন করব। আপনি দয়া করে দাওয়াত কবুল করবেন কি? হযরত নজীর ভান্ডার (ক.) দাওয়াত কবুল করে তাকে দিন তারিখ নির্ধারিত করে দিলেন। উভয় জনে স্বদেশে আসার পরে যথা সময়ে ছাহেবে দাওয়াতের বাড়িতে এসে হযরত নজীর ভান্ডার (ক.) উপস্থিত হয়েছেন। যথা সময়ে ওয়াজ মাহফিল শুরু হয়ে গেল। ওই মাহফিলে ধর্মপ্রাণ অনেক ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। তার মধ্যে ওই এলাকার আলেম হযরত মাওলানা ছৈয়দ আমানত উল্ল্যাহ্ শাহ আল মাইজভান্ডারী (র.) উপস্থিত ছিলেন।
হযরত নজীর ভান্ডার (ক.) ওয়াজ নছিয়ত, আদব আখলাক দেখে হযরত মাওলানা ছৈয়দ আমানত উল্ল্যাহ্ শাহ মোলাকাত করে পর দিন সকালে নাস্তার দাওয়াত দিলেন ও হযরত নজীর ভান্ডার (ক.) উনার দাওয়াত সাদরে গ্রহণ করলেন। পর দিন সকালে পরিচয় মাওলানা ছৈয়দ আমানত উল্ল্যাহ্ শাহ্ (র.) হযরত নজীর ভান্ডার (ক.) যাবতীয় পরিচয় গ্রহণ করেন এবং এক পর্যায়ে মাওলানা ছৈয়দ আমানত উল্ল্যাহ্ শাহ (র.) তার কন্যার সাথে হযরত নজীর ভান্ডারের (ক.) বিয়ের প্রস্তাব করেন। প্রসঙ্গত, মাওলানা ছাহেবের ওই কন্যা আলেমা ছিলেন। ওই প্রস্তাবের ব্যাপারে হযরত নজীর ভান্ডার (ক.) কোন প্রকার মন্তব্য না করিয়া এ ব্যাপারে তার বড় ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। বড় ভাইয়ের নাম মরহুম নুরুজ্জামান আহমদ। সেখান থেকে বিদায় নিয়ে আসার পূর্ব মূহুর্তে তার বাড়ির নাম-ঠিকানা লিখে দিলেন। ২-৩ দিন পরে হযরত ছৈয়দ আমানত উল্ল্যাহ্ শাহ্ (র.) পশ্চিম পটিয়া থানার জুলদা গ্রামের মরহুম মুনছুর আলি চৌধুরী বাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন। যথাযথ মেহমানদারীর পরে মরহুম নুরুজ্জামান আহমদ মেহমানের আগমনের কারণ জানিতে চাইলে তিনি তার মেয়ের সাথে হযরত মাওলানা ছৈয়দ নজীর আহমদ শাহ্ আল্ মাইজভান্ডারীর (র.) বিয়ের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তখন মরহুম নুরুজ্জামান আহমদ দেরি না করে মেহমানের সাথে পাঠানটুলী কাপুড়িয়া পাড়াস্থ কনের পিত্রালয় এসে কনে দেখেন। অত:পর খুশি হয়ে বিবাহের প্রস্তাব কবুল করত: ওই বৈঠকেই বিবাহের দিন তারিখ ধার্য্য করেন। যথাসময়ে দুইটি আত্মার নিকাহের কাজ সমাপ্ত করে নতুন অতিথিসহ সকলে আনন্দঘন পরিবেশে জুলদা গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।
বিবাহের কিছু দিন অতিবাহিত হওয়ার পর হযরত নজীর ভান্ডার (ক.) তার কর্মস্থল বার্মার রেঙ্গুন নগরীতে চালিযা যান। বেশ কিছু দিন পর তিনি জানিতে পারলেন, তার শ্বশুর হযরত মাওলানা ছৈয়দ আমানত উল্ল্যাহ শাহ্ (র.) মাইজভান্ডারী ত্বরীকার অনুসারী। (কিন্তু বিবাহের আগে এ বিষয়ে হযরত নজীর ভান্ডারের (ক.) জানা ছিল না।) শ্বশুর তরীকতপন্থী জানতে পেরে হযরত নজীর ভান্ডার (ক.) প্রকাশ বাবা ভান্ডারীর সাথে দেখা করে তার সাথে বাহাছ করার। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, তিনি একদা মাইজভান্ডার দরবার শরীফে যান হযরত গাউসুল আজম মাওলানা ছৈয়দ গোলামুর রহমান শাহ্ আল মাইজভান্ডারীর (ক.) হুজরা শরীফ হতে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে তাকে দেখার চেষ্টা করলেন। উপস্থিত আশেকানদের আচার আচরণে সন্তুষ্ট হতে না পেরে তিনি বাবাভান্ডারীর সাথে দেখা না করে গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন।
উল্লেখ্য, তৎকালীন যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত থাকায় অধিক পথ পায়ে হেঁটে চলতে হত। চট্টগ্রাম শহর থেকে মাইজভান্ডার দরবার শরীফ যেতে এক দিন সময় লাগত। অতএব হযরত নজীর ভান্ডার (ক.) দুই দিনের উপবাস ও ক্লান্ত। বাড়ীতে এসে গোসল শেষে আরো ক্লান্ত বোধ করলেন। তিনি রাতের আহারের পর জায়নামাজেই ঘুমিয়ে পড়েন। হযরত নজীর ভান্ডার (ক.) বর্ণনা করেছেন, ‘আমি স্বপ্নে দেখতে পেলাম, এক জ্যোতির্ময় মহাপুরুষকে। আকাশের চন্দ্রের আলোও যেন তার নূরের কাছে হার মানায়। আমি উঠে দাঁড়িয়ে তাকে ভক্তিভাবে কদমবুচি করলাম। আমাকে লক্ষ্য করে তিনি বলতে লাগলেন, ‘‘আমাকে চিন? আমি এ জামানার মুজাদ্দেদ, গাউসুল আজম মাওলানা ছৈয়দ গোলামুর রহমান শাহ (ক.)। তুমি আমার দরবারে গিয়ে আমার সাথে সাক্ষাৎ না করে কেন চলে এসেছ? আমার দরবার থেকে কেউ খালি হাতে ফিরে না। তোমার কিসমত খুবই ভাল, আমি তোমাকে ডেকে নিতে এসেছি। তোমার জন্য আল্লাহর কুদরতি শক্তির বেলায়তি একটি পরিপূর্ণ মাত্র রেখেছি। তুমি আমার কাছ হতে তা গ্রহণ করে নিয়ে আস। আমি তোমার অপেক্ষায় আছি।”
হযরত নজীর ভান্ডার (ক.) জেগে উঠেন ও ফজরের নামাজ আদায়ের পর প্রাণপ্রিয় মাশুকের দিদারের উদ্দেশ্যে মাইজভান্ডার দরবার শরীফে রওয়ানা হন। প্রথমে হযরত গাউছুল আজম মাওলানা ছৈয়দ আহমদ উল্লাহ্ আল্ মাইজ ভান্ডারীর (ক.) রওজা শরীফে জিয়ারত করেন। অত:পর হযরত গাউছুল আজম, ইউছুপে ছানী, জামাল মোস্তফা, শাহ্ ছুফী মাওলানা ছৈয়দ গোলামুর রহমান শাহ্ আলম মাইজভান্ডারী (ক.) খেদমতে হাজির হওয়া মাত্রই তার হৃদয়ে নূরানী ঝলক, শুরু হয়ে যায়। তিনি বাবা ভান্ডারীর কেবলা কাবার সামনে উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথে তাকে যেন এক বিশাল কুদরতি চুম্বক টেনে বাবা ভান্ডারীর (ক.) কদম শরীফে সেজদায়ে পড়ে থাকলেন। সেজদা হতে উঠে বাবা ভান্ডারীর (ক.) নূরানী চেহারা মোবারকের দিকে অপলক নেত্রে তাকিয়ে থাকলেন। বাবা ভান্ডার কেবলা কাবা (ক.) তার পরিধানের চাদরের ভিতর হতে একটি পাকা কলা তার নিজ হাতে হযরত নজীর ভান্ডারীকে খাওয়ালেন। কলাটি খাওয়ার পর হযরত নজীর ভান্ডারী আরো একটি সেজদা আরজ করলেন। ওেই কলারূপি তবারুকের মাধ্যমে নেয়ামতে উজমা তথা ফয়েজে এতেহাদি পেয়ে দ্বিতীয় সেজদায় খেলাফতের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন।
ওই দিন থেকে তিনি একাধারে এগার দিন বাবা ভান্ডারীর খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন। এগার দিন পরে গাউছুল আজম মাওলানা ছৈয়দ গোলামুর রহমান শাহ্ আল্ মাইজভান্ডারী (ক.) কেবলা কাবা সব খলিফাগণের উপস্থিতিতে ফরমাইয়াছেন, ‘নজীর-তু-বেনজীর হো গিয়া’ তুমি বাড়িতে চলে যাও। এখানে বাবা ভান্ডারী (ক.) হযরত নজীর ভান্ডারীকে (ক.) লক্ষ্য করে যে কালামটি পেশ করেছেন এরই মাধ্যমে ফয়েজে এতেহাদি ও খেলাফত প্রাপ্তির সাক্ষ্য বহন করে। অত:পর তিনি গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন। সেখানে কিছু দিন অবস্থানের পর ফের বার্মার রেঙ্গুন নগরিতে তার কর্মস্থলে যোগ দেন। একদা বাবা ভান্ডারি কেবলা কাবা তাকে স্বপ্ন যোগে হুকুম করলেন, ‘হে নজীর আহমদ, তুমি ত্বরীকত প্রচার কর। তোমার উপর যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তা পালন কর।’
নজীর ভান্ডারী (ক.) দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় সুদূর বার্মার রেঙ্গুন থেকে পায়ে হেঁটে স্বদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। উনার সঙ্গে অনেক ভক্ত, মুরিদান ও সাধারণ জনগণ ছিলেন। ভক্তদের মধ্যে রাউজানের কালামিয়া ফকির বর্ণনা করেন, বাবাজানসহ আমরা বর্তমানে বাংলাদেশের সীমানায় প্রবেশ করে কিছু দূর সামনে আসার পর বিশ্রামের জন্য একটি গাছতলায় সবাই বসে পড়ি। বাবাজান আমাকে বললেন, ‘কালামিয়া, আমার পা ফুলে গেছে। ওই সামনের পাহাড়ে হলুদ গাছ আছে, তুমি আমার জন্য কিছু কাঁচা হলুদ নিয়ে আস।’ আমি অনতিবিলম্বে একজন সঙ্গীসহ ওই পাহাড়ে গিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজির পরও কোন হলুদ গাছ না পেয়ে খালি হাতে ফিরে এসে বাবাজানকে আরজ করিলাম, ‘বাবাজান, ওখানে কোন হলুদ গাছ নাই। এক প্রকারের গাছ দেখতে পেলাম, যাকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ফইল্লা গাছ বলে।’ তখন বাবাজান পূনরাদেশ করলেন, ‘তোমরা আবার যাও; আমি ওখানে হলুদ গাছ দেখতে পাচ্ছি।” তারপর আমরা দুইজন সাথে সাথে ওই পাহাড়ে গিয়ে দেখি, ওই ফইল্লা গাছগুলো হলুদ গাছে পরিণত হয়েছে। ছোবহান আল্লাহ। আমরা বাবাজানের এ আশ্চর্য কেরামত দেখে বিস্মীত হলাম এবং ওখান থেকে হলুদ গাছ নিয়ে বাবাজানের খেদমতে হাজির হলাম।
চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার অন্তর্গত নোয়াজিশপুর গ্রাম নিবাসি কালামিয়া ফকির হযরত নজীর ভান্ডারীর (ক.) খেলাফত প্রাপ্ত খলিফা ছিলেন। একদা ওই ফকিরের বাড়ীতে হযরত নজীর ভান্ডার (ক.) সদলবলে সফরে গিয়েছিলেন। ফকিরের বড় ভাইয়ের স্ত্রীর বাবাজানের ভক্ত ছিলেন। ওই মহিলা বাবাজানের কাছে ফরিয়াদ করলেন, ‘বাবাজান আমি অধম একজন নিঃসন্তান, আপনি আমার জন্য দোয়া করুন। আল্লাহ যেন আপনার নজরোকরমে আমাকে সন্তান দান করেন। হযরত নজীর ভান্ডারী (ক.) এ কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলে উঠলেন, ‘হে আমার ভক্ত, আল্লাহর রহমতে তোমার গর্ভে পর পর দুইটি ছেলে সন্তান হবে এবং আমি সে সন্তানদের নামও নির্বাচন করে দিলাম।’ বড় ছেলের নাম মোহাম্মদ ফজলুল হক ও ছোট ছেলের নাম মোহাম্মদ আবদুল হক। নজীর ভান্ডারীর (ক.) কালাম অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ান্তে ওই মহিলা দুই ছেলে সন্তানের মা হন। বর্তমানে ওই ছেলেরা জীবিত আছেন।
হাদিছে কুদছী শরীফে আল্লাহ্ তায়ালা ফরমাইয়াছেন, ‘কালামুল আউলিয়ায়ে কালামুল্লাহ’। অর্থ- আউলিয়ায়ে কেরামগণের কালাম বা কথা আল্লাহ পাকের কালাম। অর্থাৎ আল্লাহ্ পাকের আউলিয়াগণের জবানে পাকে যে বাক্য উচ্চারিত হয়, তা হাকিকতান আল্লাহ্ পাকে কুদরতী জবানে উচ্চরিত কালাম। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও ২৯ শে পৌষ ১৩ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার ৬২ তম বার্ষিক ওরশ পাঠানটুলী কাপুড়িয়া পাড়া ও ছোটপোল আস্তানা শরীফে ধর্মীয় উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে ওরশ শরীফ পালিত হবে। সারা দেশ থেকে ওই দিন অসংখ্য ভক্ত ওরশে যোগ দেবেন।
লেখক: শাহ্জাদায়ে নজীর ভান্ডারী দরবার শরীফ
সিএন/এমএ
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন