১২ দিনের যুদ্ধে কে কি পেলেন

ইরান ও ইসরাইলের মধ্যকার যুদ্ধকে ‘১২ দিনের যুদ্ধ’ বলছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসার পর এই ১২ দিনের যুদ্ধের জয়-পরাজয় ও বিভিন্ন পক্ষের অর্জন নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতামত এখন আলোচনার কেন্দ্রে।

সতর্ক ও সংশয়ী ইরানের অর্জন : তেহরানের সেন্টার ফর মিডল ইস্ট স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের গবেষণা ফেলো আবাস আসলানি সতর্ক করেছেন, ইরান এই যুদ্ধবিরতিকে সতর্কতার সঙ্গে দেখছে, কারণ গাজা ও লেবাননে যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে চলার ক্ষেত্রে ইসরাইলের অতীত রেকর্ড ভালো নয়।

আসলানি আলজাজিরাকে বলেন, ‘এ কারণেই তেহরান সতর্ক এবং কর্মকর্তারা আনুষ্ঠানিকভাবে এটি নিশ্চিত করতে আসেননি। যদি সময়মতো কোনো লঙ্ঘন না হয়, আমি মনে করি ইরান যুদ্ধবিরতি মেনে চলবে।’ তিনি আরও বলেন, এটি ছিল ইরান এবং ইসরাইল ও তার সহযোগী যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি যুদ্ধ। দুই মিত্র তাদের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করা এবং ইরানে ‘শাসন পরিবর্তন’, যা অর্জন করা যায়নি। তিনি বলেন, ‘আমরা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর কিছু ক্ষতি দেখেছি, তবে দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচি কেবল সেই স্থাপনা এবং সরঞ্জামই নয়। ইরান তার পারমাণবিক উপাদান একটি সুরক্ষিত স্থানে সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। তাদের জ্ঞান ও দক্ষতা তো অক্ষত রয়েছে!’

আসলানি আরও বলেন, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতাও ধ্বংস হয়নি, তারা যুদ্ধবিরতি ঘোষণার ঠিক আগেও ইসরাইলে আঘাত হেনেছে। স্বল্পমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘অর্থপূর্ণ’ আলোচনা হতে পারে না, কারণ পারমাণবিক আলোচনা চলাকালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল ইরানে আক্রমণ করেছে।

ইসরাইলের লক্ষ্য অর্জন : ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকারের পক্ষে দেওয়া এক বিবৃতিতে ইসরাইল জানিয়েছে, তারা ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক সাফল্যের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নিয়েছে। যুদ্ধবিরতি সম্পর্কে ইসরাইলের প্রথম আনুষ্ঠানিক মন্তব্যে বলা হয়েছে, প্রায় দুই সপ্তাহ ইরান আক্রমণের পর ইসরাইল তার সব লক্ষ্য এবং ‘তার চেয়েও বেশি’ অর্জন করেছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইসরাইল একটি তাৎক্ষণিক এবং দ্বৈত অস্তিত্বের হুমকি দূর করেছে। পারমাণবিক এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এই দুই হুমকির দিকে ইঙ্গিত করেছে ইসরাইল। বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, যুদ্ধের মধ্যে আইডিএফ তেহরানের আকাশের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অর্জন করেছে, ইরানি সামরিক নেতৃত্বের ওপর তীব্র আঘাত হেনেছে এবং ইরানের ডজনখানেক মূল শাসন লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করেছে।

ইসরাইল ‘ইরানি পরমাণু হুমকি দূর করতে’ সামরিক সহযোগিতার জন্য ট্রাম্প এবং যুক্তরাষ্ট্রকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। অতি-ডানপন্থি অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোত্রিচ বলেছেন, ইসরাইল ‘ইরানের বিরুদ্ধে অভিযানে একটি অসাধারণ বিজয়’ অর্জন করেছে যা ইসরাইল রাষ্ট্রের ইতিহাসের পাতায় গৌরবময় অধ্যায় হিসেবে লিপিবদ্ধ থাকবে। স্মোত্রিচ বলেন, ‘একটি সম্যক হুমকি’ দূর করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘এখন আমাদের সব শক্তি দিয়ে গাজায় যেতে হবে, হামাসকে ধ্বংস করতে এবং আমাদের জিম্মিদের ফিরিয়ে আনতে হবে।’

ট্রাম্প যা পেলেন : আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের বিবাদের সবচেয়ে খারাপ সংকটকাল থেকে একটি জয় নিয়ে বেরিয়ে এসেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধবিরতি প্রায়শই ভঙ্গুর এবং ক্ষণস্থায়ী হয়। যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগেও ইসরাইল এবং ইরান উভয় পক্ষের ভয়াবহ হামলা সেদিকেই ইঙ্গিত করে। কিন্তু মার্কিন স্টিলথ বোমারু বিমানগুলো ইরানে আঘাত করার মাত্র ৪৮ ঘণ্টা পরেই প্রেসিডেন্ট নিজেকে একজন শান্তি স্থাপনকারী এবং দক্ষ চুক্তি সম্পাদনকারী হিসেবে জাহির করতে শুরু করেন।

সোমবার রাতে এনবিসি নিউজকে ট্রাম্প বলেন, ‘আমি মনে করি যুদ্ধবিরতি অনির্দিষ্টকাল থাকবে। এটি চিরকাল চলবে।’ তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন, ইসরাইল এবং ইরান আর কখনো পরস্পরের দিকে গোলা ছুড়বে না।

মধ্যপ্রাচ্যকে ‘আমেরিকান প্রেসিডেন্টের জন্য কবরস্থান’ বলা হয়। যেই অঞ্চলের এমন কুখ্যাতি আছে, সেখানে ট্রাম্পের এমন দাবি সত্যিই সাহসী! ট্রাম্পের সব বিপণন দক্ষতা সত্ত্বেও আগামী দিনের ঘটনা প্রবাহই শেষ পর্যন্ত বলে দেবে, ট্রাম্পের এই যুগান্তকারী পদক্ষেপটি বাস্তব নাকি কেবল আরেকটি বিভ্রম।