শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

১৫০ দেশ ভ্রমণের মাইলফলক স্পর্শ করে দেশে ফিরলেন নাজমুন নাহার

শনিবার, ডিসেম্বর ১১, ২০২১

প্রিন্ট করুন
nazmun nahar 1

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

নাজমুন নাহার। বিশ্বের প্রথম মুসলিম নারী হিসেবে পৃথিবীর ১৫০ দেশে ভ্রমণে বাংলাদেশের পতাকা পৌঁছে দেয়ার মাইলফলক স্পর্শ করেছেন যিনি। ভ্রমণের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উপস্থাপনের জন্যে তিনি বিশ্বগণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছেন। সম্প্রতি আফ্রিকা মহাদেশের কয়েকটি দেশ ঘুরে নিউইয়র্ক হয়ে বাংলাদেশে ফিরেছেন তিনি।

নাজমুনের বিশ্ব ভ্রমণের সূচনা ২০০০ সালে। ‘ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল এডভেঞ্চার ‘প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে তাঁর বিশ্ব ভ্রমণ শুরু। সেখানে তিনি প্রথম ৮০ দেশের ছেলেমেয়ের সামনে বাংলাদেশের পতাকা তুলে ধরেন।

ভ্রমণ খুবই ব্যয়বহুল। কিন্তু যাঁর লক্ষ্য অটুট, তাঁর বিজয় নিশ্চিত। ২০০৬ সালে নাজমুন পড়াশোনার জন্য চলে যান সুইডেন। পড়াশোনার পাশাপাশি করতেন খণ্ডকালীন কাজ। সামারে তিনি ১৭-১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করে টাকা জমাতেন শুধু ভ্রমণে খরচ করার জন্য। কম খরচে থাকতেন পৃথিবীর বিভিন্ন ট্রাভেলার্স হোস্টেলে। কখনো তাঁবু করে, কখনো কোচ সার্ফিংয়ের মাধ্যমে তিনি খরচে স্বল্পতা আনতেন। কোন দেশ ভ্রমণের পূর্বে তিনি সেই দেশের ম্যাপ ও সেখানকার দর্শনীয় স্থান নিয়ে গবেষণা করতেন। বের করে নিতেন কীভাবে কম খরচে সেখানে পৌঁছানো যায়। ১জুন ২০১৮ সালে ১০০তম দেশ ভ্রমণের মাইলফলক সৃষ্টি করেন জাম্বিয়া ও জিম্বাবুয়ে সীমান্তের ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতের উপর।

বিশ্ব ভ্রমনে নাজমুনের চ্যালেঞ্জ ছিল অনেক। সেই চ্যালেঞ্জ গুলোর বর্ণনা করতে গিয়ে নাজমুন বলেন – ‘বিশ্ব ভ্রমণের সময় মৃত্যুর হাতছানি থেকে ফিরে এসেছি বহুবার। মধ্যরাতে ম্যানগ্রোভ জঙ্গলে আটকা পড়েছি। সাহারা মরুভূমিতে মরুঝড়ের মধ্যে পড়েছি, রক্তাক্ত হয়েছি। পোকা মাকড়ের কামড় খেয়েছি। অন্ধকারে অচেনা শহরে, আফ্রিকার জংলী শহরে পথ হারিয়েছি। তিনমাস আফ্রিকাতে আলু খেয়ে ছিলাম। কখনো না খেয়ে থেকেছি। কখনো কাঠ, কখনো পাথরের ওপর ঘুমিয়েছি।

কখনো আদিবাসীদের সঙ্গে মাটির ঘরে ঘুমিয়েছি। কখনো রাতের অন্ধকারে বর্ডার ক্রস করতে না পেরে অপরিচিত পরিবারের সঙ্গে থাকতে হয়েছে। ১৪২০০ ফুট উচ্চতায় পেরুর রেইনবো মাউনটেইনে অভিযাত্রায় আন্টিচুডের সমস্যার কারণে মৃত্যুর কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। মৃত্যুকে জয় করে সেই পর্বতশৃঙ্গে উঠতে সক্ষম হয়েছি। সমুদ্রের তলদেশে স্কুবা ডাইভিং-এর সময় পাইপ লিক হয়ে লবণাক্ত পানি খেয়েও বেঁচে ফিরেছি।

পশ্চিম আফ্রিকার গিনি কোনাক্রিতে ম্যানগ্রোভ জঙ্গলে ৩টার সময় আটকা পড়েছিলাম। সেসময় ২৬ ঘণ্টা অনাহারে থেকেছি। আদিবাসীদের সঙ্গে কাটানো সেই লোমহর্ষক ঘটনা মনে পড়লে আজও শিহরে উঠি।
কিরগিস্তানের আলা আরচা পর্বত আরোহন করে নামার সময় পড়ে গিয়ে ছোট্ট একটি বুনো গাছের সঙ্গে ঝুলে ছিলাম। পড়ে গেলে হয়তো সেদিনই মৃত্যু হতো। গাছে ঝুলে থাকা আমাকে আয়মেরিক ও জুলিয়ান নামক দু’জন অভিযাত্রী বাঁচিয়েছিলেন।

পশ্চিম আফ্রিকার পথে পথে আমাকে অনেক কঠিন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিন্তু সবই মানসিক শক্তি দিয়ে মোকাবিলা করেছি।সিয়েরালিওন থেকে লাইবেরিয়া যাওয়ার পথে ১১টি ভয়ঙ্কর কূপ পার হতে হয়েছিল। শুধু তাই নয়, রাস্তা কোথায় ভয়ঙ্কর উঁচু, খাড়া, কোথাও পিচ্ছিল। কোথাও রাস্তায় পড়ে থাকা গাছের ডাল সরিয়ে চলতে হয়েছিল। বিপদসংকুল ওই জায়গাগুলোতে কোনো না কোনো হৃদয়বান ব্যক্তি সাহায্য করেছেন। পথ দেখিয়েছেন। যখনই কোনো সমস্যায় পড়েছি, কেউ না কেউ এগিয়ে এসেছেন। বিভিন্ন শহরে লোকাল ফ্যামিলির সঙ্গে থেকেছি। বিশ্ব মানচিত্রের সবচেয়ে কঠিন পথ পাড়ি দিয়েছি মৌরিতানিয়ায়।

সেখানে সাহারার তপ্ত মরুঝড়ে আক্রান্ত হয়ে ধারালো বালির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছি। সেনেগালের রোজ লেকে যাওয়ার সময় তিন ঘণ্টা জঙ্গলে হেঁটেছি। সেন্ট লুইতে একাকী পথ হারিয়ে আট কিলোমিটার অন্ধকার পথ হেঁটেছি। ইথিওপিয়ার জঙ্গলে হামার আদিবাসীদের সঙ্গে গরুর কাঁচা মাংস খেয়ে বেঁচে থাকতে হয়েছে। সর্বোচ্চ আড়াই দিন না খেয়ে থেকেছি। পথে গাছ থেকে গাছের সাদা অরেঞ্জ খেয়ে দুই দিন পর আফ্রিকাতে পানির পিপাসা মিটিছি। চিলির আতাকামা যেখানে ১০০ বছরে বৃষ্টি হয়নি এমন আশ্চর্যজনক জায়গাতেও পা রেখেছি।’
সমকালীন ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ তরুণ নাজমুন নাহার। সর্বাধিক দেশ ভ্রমণকারী প্রথম বাংলাদেশি পতাকাবাহী। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের। তাঁর বিশ্ব অভিযাত্রার মধ্যে তিনি বহু প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছেন, বিভিন্ন ঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন, মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন ৫ বার। তবুও বাংলাদেশের লাল- সবুজ পতাকাকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিয়ে যাবেন, এই সংকল্পে হাল ছাড়েননি। এগিয়ে গেছেন সমস্ত প্রতিকূলতা অতিক্রম করে। নির্ভয়ে। আত্মবিশ্বাসে।

নাজমুন নাহার বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের সুনাম অক্ষুণ্ণ রেখে এভাবেই গৌরবের সঙ্গে বাংলাদেশকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন বিশ্ববাসীর কাছে! ২১ বছর ধরে তিনি পৃথিবীর এক দেশ থেকে আরেক দেশে বিভিন্ন জনপদের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা তুলে ধরছেন। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের ইতিহাস, কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকেও বিশ্বের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। বিশ্ব শান্তি, নারীর সমতা ও ক্ষমতায়নসহ সব জাতি, ধর্ম, বর্ণের মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে কঠিন চ্যালেঞ্জ তিনি নিয়েছেন। করোনাকালেও তিনি থেমে থাকেননি। ভ্রমণ করেছেন উত্তর আফ্রিকার দেশ জিবুতি সুদান সোমালি ল্যান্ড মালদ্বীপ। তিনি রেকর্ড অর্জন করেন পৃথিবীর ১৫০ দেশে বাংলাদেশের পতাকা পৌঁছে দেয়ার। বিশ্বের প্রথম মুসলিম নারী হিসেবে সৃষ্টি করেছেন ভ্রমণের মাইলফলক।


ভ্রমণের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উপস্থাপনের জন্যে তিনি বিশ্বগণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছেন। তাঁকে সংবর্ধিত করেছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী, বিখ্যাত মানুষ। অর্জন করেছেন বহু অ্যাওয়ার্ড ও সম্মাননা। বিশ্বের প্রতিটি দেশে বাংলাদেশের পতাকা পৌঁছে দিয়ে অনন্য এক রেকর্ড গড়ার মাধ্যমে পুরো বিশ্বের মানুষের কাছে বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিক এগিয়ে দিচ্ছেন নাজমুন নাহার। তাঁর এই যাত্রা চলতে থাকবে জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্ত ১৯৫ দেশ পর্যন্ত।

আরএইচ/ সিএন

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন