শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

চমেকের বার্ন ইউনিটে ‘আর্তনাদ-আহাজারি’

বৃহস্পতিবার, জুন ৯, ২০২২

প্রিন্ট করুন

ইফতেখার ইসলাম: কারো হাত নেই,কারো কাটা পড়েছে পা। যে চোখগুলো পৃথিবীর সৌন্দর্য অবলোকন করতো তাতেও ব্যান্ডেজের জটলা। কারো বা আবার কপালে পোড়া চিহ্ন। বাদ নেই পেট বা কোমরের কোন অংশও। যার যে অংশ পেয়েছে আঘাতে জর্জরিত করেছে ঘাতক আগুন। আর এসবের ব্যাথায় আর্তনাদে দিন পার করছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (চমেক) বার্ন ইউনিটেে ২৪,২৬,৩১,৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন সীতাকুণ্ডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আহতরা।

আজ থেকে পাঁচদিন আগেও তারা ছিলো সুস্থ। কারো হাতের নিপুণতায় মহাসড়কে চলতো মালবাহী গাড়ি। কেউবা নিয়োজিত ছিলো ডিপোর নিরাপত্তায়। কেউবা করতেন পুরো ডিপো দেখাশোনা বা প্রকৌশলের কাজ। তবে আজ তাদের ছুটি! যেটি একেবারেই বিষাদে ভরা। যে অবকাশে আছে কেবল যন্ত্রণা,কান্না আর জীবনের পথে টিকে থাকার লড়াই। প্রতিনিয়ত জীবন থেকে ছিটকে যাওয়া ভয় কুঁড়ে কুঁড়ে খায়! বেদনার শেষ নেই আত্মীয় প্রিয়জনের। কেঁদে কেঁদে শেষ পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তান।

হযরত আলী ডিপোর দারোয়ানের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। অগ্নিকাণ্ডের দিনও ডিউটিতে ছিলেন তিনি। বিভীষিকাময় সেই রাতে বিস্ফোরণে আঘাত পেয়ে ভর্তি আছেন চমেকের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে। তবে তিনি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন। কারণ তার সাথে দায়িত্বে ছিলেন আরেক সহকর্মী। যাকে নাকি খুঁজেও পাওয়া যায় নি। হযরত আলী বলেন, বিস্ফোরণে চারদিকে ভয়ার্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। প্রাণভয়ে সবাই নিরাপদে সরতে থাকে। তবে ততক্ষণে আগুনের তোপে ছিন্নভিন্ন হয়েছিলো অনেক প্রাণ। আবার তার মতো অনেকেই পোড়া দেহ নিয়ে ভর্তি হয়েছে হাসপাতালে।

নয়ন বড়ুয়া। বাড়ি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে। জীবিকা নির্বাহের জন্য ডিপোর ভেতর একটি হোটেলে কাজ করতেন। অন্যদিনের মতো অগ্নিকাণ্ডের দিনও কাজ করছিলেন হোটেলে। তবে অগুনের স্ফুলিঙ্গ থেকে পরিত্রাণ পেতে পারেন নি তিনি। অগ্নিকাণ্ডে আহত হয়ে ভর্তি আছে চমেকের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে। হযরত আলী, নয়ন বড়ুয়াদের মতো হৃদয়, মো.বাবুল, নুর আলম, আমিরুল, আব্দুল হাসিম,আলি আহামমেদ, ওমর ফারুকরাও ভর্তি আছেন চমেকের বার্ন ইউনিটে। তাদের কারো হাত হারিয়েছে, কারো পায়ে বিষ্ফোরণের আঘাত। আবার কেউ চোখে আঘাত পেয়ে লড়ছেন জীবনের সাথে। শুধু চমেক নয় অগ্নিদগ্ধ হয়ে চট্টগ্রামের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও ভর্তি আছেন অনেকে। যাদের সবারি ইচ্ছে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরা।

যা ঘটেছিলো সীতাকুণ্ডের কন্টেইনার ডিপোতে:

শনিবার (৫ জুন) রাত ৯টার দিকে চট্টগ্রাম শহর থেকে ৩০ কিলোমিটারের মতো দূরে সীতাকুণ্ডের কদমরসুল এলাকায় বিএম ডিপো নামের একটি কনটেইনার টার্মিনালে শুরুতে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়।

এর চল্লিশের মিনিটের মাথায় ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটে। মালবাহী কন্টেইনারগুলো দুমড়ে মুচড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। পরপর বেশ কটি বিস্ফোরণ হয়।

ওই ডিপোতে ৫০ হাজারের বেশি কনটেইনার রয়েছে। কেমিক্যাল কনটেইনার থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে ধারণা করা হচ্ছে। আগুন লাগার পর কনটেইনারগুলো একের পর এক বিস্ফোরিত হতে থাকে। বিস্ফোরণে ঘটনাস্থল থেকে তিন-চার কিলোমিটার এলাকা কেঁপে ওঠে। আশপাশের বাড়ি-ঘরের জানালার কাচ ভেঙে পড়ে। বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন লাগার পর সারা রাত থেমে থেমে বিস্ফোরণ হয়।

ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, কনটেইনার ডিপোটিতে ‘হাইড্রোজেন পারক্সাইড’ নামের বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক ছিল। হাইড্রোজেন পারক্সাইড একটি রাসায়নিক যৌগ। এটি যদি উত্তপ্ত করা হয়, তাহলে তাপীয় বিয়োজনে হাইড্রোজেন পারক্সাইড বিস্ফোরক হিসেবে আচরণ করে।

বিস্ফোরণে পুরো এলাকায় কেমিক্যালের বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়েছে। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যসহ ঘটনাস্থলে আসা লোকজন চোখ খুলতে পারে নি। বেশির ভাগ সদস্যের চোখ লাল হয়ে যায়। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয় তাঁদের।

ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের ৪টি উপজেলা, ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লা থেকে ফায়ার সার্ভিসের ২৩টি ইউনিটের ১৮৩ জন সদস্য কাজ করে আগুন নিভানোর কাজে। এছাড়া সেনাবাহিনীর প্রচেষ্টায় গত মঙ্গলবার ৭ জুন নিয়ন্ত্রণে আসে আগুন।

নিহত পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই, অহত চার শতাধিক:

সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণের ঘটনায় বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৪৫ জন নিহতের খবর পাওয়া গিয়েছে। যাদের মধ্যে অধিকাংশ ঘটনাস্থলেই মারা যান। আবার চিকিৎসাধীন অবস্থায়ও মারা যান কয়েকজন। এছাড়া এতে গাড়ি চালক, ডিপোর কর্মী ও দমকলকর্মীসহ চারশতাধিক মানুষ আহত হোন। যাদের মধ্যে অনেকেই চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, এ মুহুর্তে (বৃহস্পতিবার রাত) হাসপাতালে ৯৫ জন রোগী ভর্তি রয়েছে। এর মধ্যে চমেক হাসপাতালের আইসিইউতে থাকা একজনকে অর্থোপেডিক ওয়ার্ডে নেওয়া হয়েছে। তার অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। এছাড়া পার্ক ভিউ হাসপাতালে ভর্তি থাকা একজনের অবস্থা এখনও সংকটাপন্ন এবং জেনারেল হাসপাতালে থাকা রোগীটির অবস্থা স্থিতিশীল।

সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনায় আহত বেশিরভাগ রোগীই দীর্ঘমেয়াদি চোখের সমস্যায় ভুগবেন বলে জানিয়েছেন

চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ ও স্বাধীনতা চিকিৎসা পরিষদের মহাসচিব ডা. এম এ আজিজ বৃহস্পতিবার বলেন, সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণে আহত ঢাকা ও চট্টগ্রামে চিকিৎসাধীন ৬৩ জন রোগীকে দেখেছি। দেখে মনে হলো, প্রাথমিক অবস্থায় সেরে উঠলেও বেশিরভাগ রোগীই চোখের দীর্ঘমেয়াদি সমস্যায় ভুগবেন।তাদের অবশ্যই নিয়মিত চেকআপের মধ্যে থাকতে হবে।

দূর্যোগে মানবিক চট্টগ্রামবাসী:

শনিবার রাত বিষ্ফোরণের পর চমেকসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভিড় জমাতে থাকে রোগীরা। দগ্ধ শরীরে জ্বালা নিয়ে কাতর রোগীদের সেবায় সেদিন নিয়োজিত হয়েছিলো চট্টগ্রামবাসী। ঘটনাস্থল থেকে হাসপাতালে রোগী আনা থেকে ভর্তি করা ও তার পরবর্তী চিকিৎসা দেওয়া সব কাজেই হতাহতদের পাশে দাঁড়ায় চট্টগ্রামের মানুষ। সেদিন রাতে দলবেঁধে রক্ত দিতে চমেকে ছুটে যায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। অনেক সিনজি চালক বিনা ভাড়ায় পৌঁছে দিয়েছে ছুটে চলা মানুষদের। ফ্রি ওষধের জোগান দিয়েছে দোকানগুলো। প্রাইভেট হাসপাতালগুলোও চিকিৎসা দিয়েছে ফ্রিতে। এছাড়া ঘটনার পরে প্রায় প্রতিদিন খাবার,পানীয় অর্থ সরবরাহ করেছে বিভিন্ন মহলের মানুষ।

বৃহস্পতিবার সরজমিনে দেখা গেছে, হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে রোগীদের সেবা দিচ্ছেন সেচ্ছাসেবীরা। রোগীতের পৌঁছে দিচ্ছেন খাবার। আবার কেউবা তুলে দিচ্ছেন আর্থিক সাহায্য। কয়েকজন তরুণ রোগীদের জন্য এনেছিলো বালিশ,পাখা। এছাড়া রোগীদের সহায়তা এগিয়ে এসেছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও।

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন