ডাক্তার মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ: শুক্রবার ৪ মার্চ বিশ্ব যৌন নিপীড়ন বিরোধী দিবস ২০২২। যদিও দিবসটি ঘিরে সরকারি-বেসরকারিভাবে দেশের কোথাও কোন উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি নেয়া হয় না। বিশ্ব যৌন নিপীড়ন বিরোধী দিবসটিকে গুরুত্ব দিয়ে নানা ধরণের সচেতনমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করলে এ ধরণের অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব হত। যৌন হয়রানি নারীর ক্ষমতায়নে অন্যতম অন্তরায়। ঘরে-বাইরে সর্বত্র নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়। এটি একটি সামাজিক ব্যাধি।
শিশু থেকে বৃদ্ধা কেউই রেহাই পাচ্ছে না এ ব্যাধির হাত থেকে। নারীদের অবাধ বিচরণ হলেও তারা বিভিন্ন স্থানে যেমন- বাড়ি, রাস্তাঘাট, যানবাহন, ফুটপাত কিংবা জনসমাগম হয় এমন স্থানগুলোতে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। যৌন হয়রানির শিকার হওয়া নারীই উল্টো সামাজিকতার ভয়ে গুটিয়ে নেয় নিজেকে। এ ঘটনার শিকার ব্যক্তি ও তার পরিবারের সদ্যসের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়, তাদের জীবনে নেমে আসে দুবির্ষহ পরিস্থিতি। প্রতিবাদ করলে উল্টো হামলার শিকার হতে হয়, তাই অনেক নিরুপায় অভিভাবক বখাটেদের ভয়ে সন্তানের স্কুল-কলেজে যাওয়া বন্ধ করে গৃহবন্ধী করে রাখে। বখাটেদের উৎপাতে শৈশব- কৈশোর গৃহবন্ধী অবস্থায় কাটায় অনেক মেয়ে। একইভাবে কর্মস্থলে যৌন হয়রানির কারণে অনেক নারী চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয় ও অনেক অভিভাবক মেয়েদের চাকরি করাতে চায় না। সামাজিক ও পারিবারিকসহ নানা ভয়ে এ ধরনের হয়রানির বিষয়টি গোপন রাখে নারী।
বিচারহীনতার প্রবণতায় যৌন হয়রানির মত মারাত্নক অপরাধ বেড়েই চলেছে দিন দিন।
বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে অহরহ। ২০১৮ সালে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, গণপরিবহণে যাতায়াতের সময় ৯৪ শতাংশ নারী কোন না কোনভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আরো হয়রানির আশঙ্কায় নারীরা প্রতিবাদ করতেও ভয় পায়। যৌন নিপীড়ন বন্ধে সরকারি নানা উদ্যোগ থাকলেও তা কার্যকর ভূমিকা রাখছে না। ব্র্যাকের এক জরিপের তথ্যানুসারে, হেনস্থাকারীদের অধিকাংশই মধ্যবয়সী বা বয়স্ক পুরুষ (৪১-৬০ বছর)। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিশিক্ষণ, গবেষণা ও পাঠাগার উপ-পরিষদের এক জরিপে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার। এ হার ৫৩ শতাংশেরও বেশি।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ৭৬ শতাংশ ছাত্রীই কোন না কোনভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়। এর মধ্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮৭ শতাংশ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৬ শতাংশ ও মেডিকেল কলেজে ৫৪ শতাংশ ছাত্রী যৌন হয়রানির শিকার হয়। এর বাইরেও বিভিন্ন পেশায় জড়িত ১৯ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার। এ ছাড়াও বিশ্বের মোট নারীর ৭ শতাংশ জীবনের যে কোন সময় ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। দেশে যৌন হয়রানি রোধে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যতটা উদ্যোগ নেয়া দরকার, তা হয় না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে স্কুল ও কলেজে অনেক যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটলেও তা প্রকাশ পায় না। স্কুল-কলেজের গর্ভনিং বডি ধামাচাপা দেয়। কেউ অভিযোগ করলে উল্টো হেনস্তার শিকার হতে হয়। ঢাকাসহ বাংলাদেশের কোন স্কুল-কলেজেই যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি নেই।
বাংলাদেশ ২০১০ সালে উচ্চ আদালত যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে একটি নিদের্শনা দেয়। তাতে বলা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ যেসব প্রতিষ্ঠানে নারী রয়েছে, সে সব প্রতিষ্ঠানে একজন নারীর নেতৃত্বে যৌন নিপীড়ন বিরোধী কমিটি থাকতে হবে। কমিটিতে নারীদের প্রাধান্য থাকতে হবে। একটি বাক্সে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতি তিন মাস পর ওই বাক্স খুলে যদি কোন অভিযোগ পান, তাহলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে কমিটি। তদন্তর নিরপেক্ষ ফল পেতে গোপনীয়তা বজায় রাখতে হবে। কেউ চাইলে সারাসরি কমিটির কাছে অভিযোগ করতে পারবেন। কিন্তু হাইকোর্টের নিদের্শনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কিছু প্রতিষ্ঠানে এ ধরণের কমিটি থাকলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই নেই।
যৌন নিপীড়ন কী: যৌন হয়রানি ও শরীরের অবাঞ্ছিত স্থানে অনধিকার চর্চা, সে সঙ্গে অননুমোদিত যৌন কর্মকাণ্ডের চেষ্টা করাকেই বলা হয় যৌন নিপীড়ন। সহজ কথায় কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক যৌন কার্যকলাপ বা যৌন জিঘাংসা বাস্তবায়নের অভিপ্রায়কেই বলা হয় যৌন নিপীড়ন।
আক্রান্ত হয় কারা: নারী বা পুরুষ যে কেউ যৌন নিপীড়নের শিকার হতে পারেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারী, কন্যা শিশু ও ছেলে শিশুরাই অধিকমাত্রায় আক্রান্ত হয়। ফের অনেক সময় বৃদ্ধরাও শিকার হতে পারেন।
কীভাবে আক্রান্ত হয়: কন্যা ও ছেলে শিশুরা খুব সহজেই যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। ছোট হওয়ার কারণে তারা সহজে যৌন উৎপীড়ককে বাঁধা দিতে পারে না। তাই ছোট ছোট শিশুরা তাদের আশেপাশের আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতজনদের দ্বারা ব্যাপকভাবে নিগৃহীত হয়। আমাদের পরিবারে এমন কিছু সদস্য থাকে, যাদের কখনোই আমাদের সন্তানদের জন্য ক্ষতিকর মনে করি না। কিন্তু এসব আত্মীয়স্বজন দ্বারা শিশুরা বেশি নির্যাতিত হয়। অনেক সময় শিশুরা এদের বিরুদ্ধে কিছু বললেও অনভিজ্ঞতার কারণে আমরা তাদের কথা এড়িয়ে যাই।
আর ছেলে শিশুরা এভাবে আক্রান্ত হলেও আমাদের সমাজে ছেলে শিশুরা বেশিরভাগ আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। শিশুদের সাথে নারীদেরও একটি বৃহৎ অংশ যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। বিশেষ করে যেসব নারীর নিজস্ব প্রকৃত স্বাধীনতা নেই, যারা কোন না কোনভাবে অন্যের ইচ্ছার অধীনস্থ তারাই বেশি আক্রান্ত হয়। সেই সাথে নারীদের কর্মস্থলেও দুর্বলতার সুযোগে একটি অংশ যৌন নিপীড়নের শিকার হয়।
শুধু তাই নয়, আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায়ও উচ্চ শ্রেণির নারীরাও যৌন হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর কারণেও কিশোরী, নারী ও শিশুরাও যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে যে কোন দুর্বলতা নিয়ে নারীদের ব্ল্যাকমেইলের কারণেও যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয়। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ফাঁদে ফেলে যৌন নিপীড়ন করা হয় নারীদের।
সিএন/এমএ
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন