শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

ক্ষতিপূরণে নতুন দিশা, কাজে লাগানোর পরামর্শ

বুধবার, মার্চ ১৭, ২০২১

প্রিন্ট করুন
prothomalo import media 2017 08 25 ed3de463d77da29f11109a2bb62f131e 599f1b946e446

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার মাদামবিবির হাটে স্বামী ও একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বেশ কাটছিল হামিদা বেগমের সংসার। স্বামী খলিল মোল্লা (৩৫) জাহাজভাঙা কারখানার শ্রমিক, বার আউলিয়ার জুমা এন্টারপ্রাইজে। সুখ কপালে সয়নি বেশি দিন। ২০১৮ সালের ৩০ মার্চ জাহাজ কাটার সময় মারা যান খলিল মোল্লা। কিছু ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন হামিদা। তা পর্যাপ্ত নয়। এরপর ঠাঁই হয় সিলেটে ভাইয়ের সংসারে। এখন কষ্টেসৃষ্টে তাঁর দিন চলে। ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে।

হামিদা বেগম বলেন, ‘টুকটাক মানুষের ঘরের কাজকর্ম করি। ক্ষতিপূরণ কিছু পেয়েছিলাম তখন। আরও ক্ষতিপূরণের আশায় যোগাযোগ করেছিলাম। কিন্তু পরে কী হয়েছে জানি না।’

জুমা এন্টারপ্রাইজে তখন যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিপিং কোম্পানি ‘মারান’-এর তিন লাখ টনের একটি অয়েল ট্যাংকার ভাঙার কাজ চলছিল। ‘এমটি একটা’ (পুরোনো নাম মারান সেঞ্চুরাস) নামে ওই ট্যাংকার কাটার সময় দুর্ঘটনার শিকার হন নওগাঁর খলিল মোল্লা। দুর্ঘটনার পর ক্ষতিপূরণ হিসেবে মালিকপক্ষ থেকে ৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছিল। এরপর যুক্তরাজ্যের একটি আইনি প্রতিষ্ঠান হামিদা বেগমের সঙ্গে যোগাযোগ করে ক্ষতিপূরণের জন্য রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলার প্রক্রিয়া শুরু করে। কিন্তু আইনি ভিত্তি না থাকায় তারা তখন সফল হয়নি।

তবে সম্প্রতি কোর্ট অব আপিল অব ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলসের এক আদেশে এ মামলা করার সুযোগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু যুক্তরাজ্যে নয়, সর্বোচ্চ পর্যায়ের আদালত থেকে আসা এমন আদেশ এই প্রথম বলে যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ব্রিটিশ আদালতের এ রায়ের ফলে লন্ডনে মারানের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করতে পারবেন হামিদা বেগম। অবশ্য এই রায় শ্রমিকদের কতটা কাজে আসবে, তা নিয়ে সন্দিহান সংশ্লিষ্টরা। তবে তারা এই রায় কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন।

হামিদা বেগম এই রায়ের খবর জানেননি। রায়ের খবর জানানোর পর হামিদা বেগম বলেন, ‘যদি আরও ক্ষতিপূরণের সুযোগ সৃষ্টি হয় তাহলে নতুন করে যোগাযোগ করে দেখব কী করা যায়।’

টুকটাক মানুষের ঘরের কাজকর্ম করি। ক্ষতিপূরণ কিছু পেয়েছিলাম তখন। আরও ক্ষতিপূরণের আশায় যোগাযোগ করেছিলাম। কিন্তু পরে কী হয়েছে জানি না।

হামিদা বেগম

শুধু হামিদার ক্ষেত্রে নয়, এখন থেকে যুক্তরাজ্যের জাহাজ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যেকোনো ভুক্তভোগী মামলা করতে পারবেন। জাহাজ আনার পর কাটার সময় দুর্ঘটনার শিকার যে কেউ বা স্বজন এই সুবিধা পাবেন।

জাহাজভাঙা কারখানায় প্রায়ই দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটে। গত তিন বছরে ৫০ জন শ্রমিক মারা যান। এর মধ্যে দুজন মারা যান চলতি বছর। তবে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) ও জাহাজভাঙা শিল্পের পরিবেশ ও নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা উন্নয়ন সংগঠন ইপসার মতে, হতাহতের অনেক ঘটনা মালিকপক্ষ প্রকাশ করে না।

হামিদা বেগমের ক্ষতিপূরণের মামলার বিষয়ে ইপসার সমন্বয়ক মোহাম্মদ আলী শাহীন তখন যুক্তরাজ্যের আইনি প্রতিষ্ঠানটিকে সহযোগিতা করেছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনার পর হতাহত নিয়ে ইয়ার্ডগুলো লুকোচুরি শুরু করে দেয়। জাহাজ ভাঙতে গিয়ে মারা গেলে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। তবে ব্রিটিশ আদালতের রায়ের পর রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

তবে যুক্তরাজ্যের আদালতের রায়ের পর শ্রমিকেরা কতটা মামলা করার সুযোগ পাবেন, তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড ট্রেড ইউনিয়ন ফোরামের আহ্বায়ক তপন দত্ত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইংল্যান্ডের আদালতে গিয়ে কোন শ্রমিক মামলা করবেন? মামলা করার জন্য শ্রমিকের পরিবার এখান থেকে ঢাকা যেতে চায় না। এটা সোনার পাথর বাটির মতো ব্যাপার আরকি। আর যদি আমদানিকারক মামলা করে, সে ক্ষতিপূরণ শ্রমিকেরা পাবেন কি না সন্দেহ। আর মালিকেরা কোনো আইনের তোয়াক্কা এখানে করেন না।’

বাংলাদেশ শিপ ব্রেকিং অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিএ) সভাপতি আবু তাহের বলেন, ‘এই রায় সম্পর্কে আমরা অবগত নই। আমাদের ক্ষতিপূরণ আমরা দিচ্ছি।’

এদিকে সম্প্রতি দুর্ঘটনার পর সীতাকুণ্ডের তিনটি জাহাজভাঙা কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। এগুলো হলো তাশিন স্টিলস, এম এ শিপ ব্রেকিং এবং এন আর শিপব্রেকিং। এর মধ্যে সীতাকুণ্ডের সাংসদ দিদারুল আলমের প্রতিষ্ঠান তাশিন স্টিল লিমিটেডে ৪ মার্চ দুর্ঘটনায় এক শ্রমিক মারা যান। এরপর শিল্প মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি ঘটনায় সুরক্ষাজনিত গাফিলতির প্রমাণ পায়।

সাংসদ দিদারুল আলম দুর্ঘটনার কারণে শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে কারখানা সাময়িক বন্ধ রয়েছে বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন।

খলিল যে জাহাজ কাটতে মারা যান

ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, কোরিয়া থেকে প্রতিবছর বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ পুরোনো জাহাজ ভাঙার জন্য কিনে আনে।

যুক্তরাজ্যের এমটি একটা (পুরোনো নাম মারান সেঞ্চুরাস) নামের জাহাজ কাটার সময় মারা যান খলিল মোল্লা। বাংলাদেশে এই জাহাজ বিক্রি করে যুক্তরাজ্যের মারান। ১ কোটি ৭১ লাখ ৯৭ হাজার ১৮৪ ডলারে কিনে নেয় জুমা এন্টারপ্রাইজ। জাহাজটি ৩ লাখ টন জ্বালানি তেল পরিবহন করতে পারত। লোহার পরিমাণ ৪০ হাজার ৮৪৯ টন। ৩৩২ মিটার লম্বা জাহাজটি বন্দরের জলসীমায় আসে ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। ওই বছরের শেষ দিক থেকে এটি সীতাকুণ্ডের বার আউলিয়ার জুমা এন্টারপ্রাইজে ভাঙা শুরু হয়।

আমদানির পাশাপাশি বেড়েছে মৃত্যু

একদিকে জাহাজ আমদানি যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে মৃত্যুর ঘটনাও। ২০২০ সালে কোভিডের কারণে কার্যক্রম সীমিত ছিল। এনজিও শিপ ব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ১৪৪টি জাহাজ ভাঙার জন্য আনা হয়েছে। সারা বিশ্বের মধ্যে জাহাজভাঙায় ওই বছর বাংলাদেশ ছিল শীর্ষে। ওই বছর সীমিত কার্যক্রমের মধ্যেও ১০ জন শ্রমিক মারা যান।

এর আগের বছর ২০১৯ সালে মারা যান ২৪ জন। সেবার আসে ২৩৬টি জাহাজ। ২০১৮ সালে ১৪ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ওই বছর আসে ১৮৭টি জাহাজ।

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন