সাইয়িদ মাহমুদ তসলিম:
ম্যাথিউস । বাফেলো থেকে দেড় ঘন্টার পথ । আমেরিকান সাদা চামড়ার কৃষকদের বসবাস । বসতি ঘর গুলো এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি কিছুটা দুরত্বে । ঘেরা জঙ্গল। অনেকটা পশ্চিমাঞ্চলের ( ওয়েস্ট নিউ ইয়র্কের ) জংঙ্গলের মত । এই অঞ্চল একদিকে মরুভূমির মত সমতল , চাষাবাদ হয় সিম, ভূট্টা। অন্যদিকে বন জংগল, পাহাড় পর্বত।
সেখানে গিয়ে দেখা হয় আমেন্ডার সাথে। আমার মেয়ের বয়সি। তার বাড়ি পাহাড়ের সমতল ভূমির উপর । পিচঢালা রাস্তা থেকে প্রায় পনেরো-কাঠের সিঁড়ি বেয়ে তার বাড়ি যেতে হয় । প্রায় একশ বছরের পুরানো বাড়ী। শক্ত কাঠ দিয়ে তৈরি বাড়ি । উপরে যাওয়ার সিঁড়ি গুলো খুব মজবুত। বাড়ীর আংঙ্গিনায় বড বড় পাথর বিছানো । দেখতে খুব সুন্দর এবং মনোরম পরিবেশ। একপাশে পাথরের ঝর্ণা। পাথরের চেহারা দেখলেই মনে হয় যেন ওরা একেকটি কালের সাক্ষী হয়ে শুয়ে আছে। একেবারে ছবির মত। বাড়ীর পেছন দিকে চেরী ফল, পিয়ার্সের বন। রাস্তা থেকে দেখা যায় টুক টুকে লালচে চেরী ফলের বাগান ।
বাড়ীটির একটি বিশেষত্ব আছে, সামনের দিকটি এত উঁচুতে হলেও পেছনের দিক সমতলে মিশে আছে। কিচেনের দরজা দিয়ে পেছনে যাওয়ার রাস্তা। পেছন দিকটায় বেশ অনেকখানি চওড়া জমি । সেখানে ভুট্টার চাষ। সবুজ বনায়ন ।
করোনা মহামারীতে ম্যাথিউসে তেমন কোন প্রাণহানি হয়নি । তবে করোনা ভাইরাসে অন্যান্য স্টেটে প্রাণহানির কথা আমেন্ডা জানে । ম্যাথিউসের কিছু এলাকা মরুভূমির মত । সেখানে গরু ও মহিষ , ছাগল- ভেড়ার খামার । পড়ে আছে অনেক পরিত্যক্ত জমি । বাংলাদেশের একটি জেলার পুরো বাসিন্দা এনে বসতি স্থাপন করলেও মানুষের ঘনবসতি বুঝা যাবেনা । আমেন্ডার বিশাল বাড়ির আশপাশ খালি। কোন সবজির বাগান করেনি। শুধু নানান জাতের ফুলের গাছ লাগানো হয়ে হয়েছে।
তবে কোন বাংলাদেশীর কাছে এই বাড়ি থাকলে অবশ্যই তারা সবজি বাগান করতো। আমেন্ডার বাডী থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দুরে ইন্ডিয়ান গ্যাস স্টেশন ও গ্রোসারী শপ । সেখান থেকে শাক-সবজি , লাউ কদু শশা টমেটো কিনতে পাওয়া যায় । তাই এত খাটুনি করে আমেন্ডা এ সবের বাগান করতে আগ্রাহী নন।
গতবছরও কোরবানীর উদ্দ্যশে ম্যাথিউস গিয়েছিলাম । এর আগেরবার যখন এসেছিলাম, একটি কমলার চারা লাগিয়ে লাগিয়ে ছিলাম। এবার দেখলাম, ওটা বেশ বড় হয়েছে। হয়ত আর দুই বছর পর কমলা ধরবে, আমি করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে যদি বেঁচে যাই তাহলে কমলা ধরার দৃশ্যপট দেখতে পাবো। আর যদি না আসতে পারি একটি কাঙ্খিত দৃশ্য দেখা থেকে বঞ্চিত হব। কমলার ভেতর দিয়ে আমেন্ডা হয়ত আমাকে দেখবে।
আমেন্ডা শুদ্ধ করে আমার নামটি উচ্চারন করতে পারে না । ওর কাছে কঠিন মনে হয় । রেল রাস্তার মত দীর্ঘ আমার নাম । জাত খান্দান চৌদ্দ পুরুষ দীর্ঘনামের অধিকারী। সেহেতু আমার নামটাও সংক্ষিপ্ত করে তাছ্লী বলে। হাই তাছলী। শুদ্ধ নাম উচ্চারণের সমস্যা হওয়ায় সংক্ষিপ্ত নাম এস এম (স্যাম)বলতে বলেছি । কিন্তু তাও পারে না । তার পর বললাম স্যাম বলতে , তা পারে ? হঠাৎ আমেন্ডা প্রশ্ন করল ?
What do you mean by SM ?
আমি বললাম ! What ?
সে বলে Nothing, just.
Oh , so you know,
সে বলল, May be S like Sam , M like marry
আমি বললাম No ,
Ok that’s fine.
কিছুক্ষন পর ঘর থেকে আমেন্ডার বড় বোন বের হল। সাথে তাঁর তিনটে বাচ্ছা । তারা নায়াগ্রা থাকে । এ সামারে বন বাঁদুরে ঘেরা জঙ্গল দেখতে স্ব পরিবারে বেড়াতে এসেছে । আমেন্ডার পাশেই খামার বাড়ি জনা পাঁচেক লোক খামারে কাজ করে । সবাই সাদা চামড়ার মানুষ , স্মার্ট ও বিনয়ী । খামার বাড়ীর কয়েকটি গরু দেখি । একটির বুকিং দিলাম । পরে দেখি এক ঝাঁক পাতি হাঁস । খামার বাড়ি তথা ভূট্টা বাগানের পাশেই পরিত্যক্ত ভূমিতে মনের আনন্দ হাঁস গুলো ঘুরছে । খোলা আকাশে উড়ছে । আমেন্ডার দিদির বাচ্চা গুলো হাঁসের পেছনে দৌড় ছুট করছে । এই অসাধারণ প্রকৃতি ও বাচ্চাদের ছোটাছুটি দেখে হারিয়ে যাই আপন ভূবনে। যেখানে আমি বড় হয়েছি।
আমার ছোটবেলা কেটেছে চট্টগ্রামে। নদী ,পাহাড় আর সমুদ্র, এই বিশাল তিন প্রকৃতির শক্তির বলয়ে আমি শৈশব কৈশর পেরিয়ে বড় হয়েছি। নদী পাহাড় ও সমতল ভূমির মাঠ জুড়েই আমরা দুর্বলতা ।
আমেন্ডার খামার বাড়ীতে আমি বেশ কয়েকবার এসেছি। বাড়ির প্রতিটি আসবাব থেকে শুরু করে ইট পাথর এমনকি বারান্দায় দড়ির দোলনা কে আমার খুব আপন মনে হয়। বাড়ীর বাইরের দিকে ফুল-লতা-পাতা কারুকাজের লোহার রেলিং দেয়া বারান্দাটি আমার সবচেয়ে পছন্দের। এই বারান্দা থেকে ভুট্টা বাগান খুব স্পষ্ট দেখা যায়। তাছাড়া ধূ ধূ পরিত্যক্ত ভূমি পাহাড় এসব কেমন জানি আমার অনেক স্মৃতিতে প্রানশক্তি সঞ্চার করে। নদী সমুদ্র পাহাড় আমার চেতনা, যখনই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকি, মায়ের কথা মনে পড়ে । চোখ বন্ধ করে বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে চলে আসি ম্যাথিউসে । যেখানে বন জঙ্গল ও সবুজ বনায়ন অপলক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছে ।
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন