ইফতেখার ইসলাম: সালভাদর রামোস। বয়স সবে ১৮ বছর। টেক্সাসের ইউভালডি শহরের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটায় তার জন্ম। ইউলভাডি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন রামোস। অন্য সবার মতো নিজেরও ইচ্ছে ছিলো ঝাকঝমকপূর্ণ পোষাক আর অভিজাত জীবনযাপনের। তবে আর্থিক অনটন তার সেই আকাঙ্ক্ষা কোন দিন পূরণ হতে দেয় নি। বরং বন্ধু-বান্ধব থেকে সব সময় ‘বুলির’ শিকার হতে হতো তাকে। আর এসব সহ্য করে না পেরে স্কুল থেকে ছিটকে পড়েন এই তরুণ। পরে কাজ শুরু করেন একটি স্থানীয় রেস্টুরেন্টে। তবে তার হৃদয়ে বিঁধে থাকা রাগ-ক্ষোভ যেন কোন মতেই কমে নি। বরং তা পতিত হয় দানবরূপে। আর সেই দানবীয় কর্মকান্ড স্তব্ধ করেছে পুরো দেশকে। তার কার্যক্রম আলোড়ন সৃষ্টি করেছে বিশ্বজুড়েও।
গত ২৪ মে মঙ্গলবার। অন্যসব দিনের মতো এদিনও টেক্সাসের স্যান অ্যান্টোনিওর ইউভালডি শহরের রব এলিমেন্টারি স্কুলে যান কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। তবে এদিন মোটেও স্বভাবিক ছিলো না। বেলা বাড়ার সাথে সাথে স্কুলে বাড়ে কোলাহল।আকষ্মিকভাবে সেখানে হামলে পড়েন রামোস। এআর-১৫ রাইফেলের গুলি মুহূর্তে স্তব্ধ করে দেয় পুরো বিদ্যালয় প্রাঙ্গন। পুরো মেঝে হয়ে যায় রক্তে রঞ্জিত। আর সেদিন টেক্সাসের আকাশে বাতাসে সে কি আর্তনাদ! কারো আহাজারি সন্তান হারানোর বেদনায় আবার কেউবা বেদনায় কাতর প্রিয় সহপাঠী-শিক্ষককে হারিয়ে। খনিকের সেই গোলযোগ, বিষাদময় উপখ্যানে দাঁড়ি পড়ে রামোসের জীবনচাকায়ও। সেই সাথে থেমে যায় ১৯ শিক্ষার্থীসহ ২১ তাজা প্রাণ। যার শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি স্বজানরা।
জানা গেছে, হামলার অন্তত তিন দিন আগে নিজের ইনস্টাগ্রামে দুটি ছবি পোস্ট করেছিলেন রামোস। এছাড়া বন্ধু-বান্ধবদেরও সে জানিয়েছিলো ভয়াবহ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। ১৬ মে ১৮ বছর পূর্ণ করেন রামোস। আর ১৮তম জন্মদিনেই অস্ত্র কেনেন তিনি। রব এলিমেন্টারি স্কুলে হামলার আগে নিজের দাদিকে গুলি করেন ওই তরুণ। তবে কী কারণে নিজের পরিবারের সদস্যর ওপর গুলি চালান তা এখনো জানা যায়নি।
নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক রামোসের এক সহপাঠী বলেন, রামোসের সঙ্গে যোগাযোগ কমলেও প্রায়ই তাকে একসঙ্গে ভিডিও গেমস দেখার কথা বলত রামোস। হামলার কয়েক দিন আগেই তাকে নিজের কাছে থাকা একটি আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ ভর্তি ব্যাগের ছবি পাঠিয়েছিলেন। ওই সহপাঠীর মনে কৌতূহল জাগলে এসব নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই বলে আশ্বস্ত করেছিলেন সালভাদর রামোস।
সালভাদর রামোসের মা আদ্রিয়ানা রেয়েস বলেন,আমার ছেলে সহিংস ছিলো না। সে যা করেছে তাতে আমি বিস্মিত। সে তার দাদীর উপরও হামলা চালিয়েছে। তার সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক ছিলো। তবে তার খুব বেশি বন্ধু ছিলো না। এ ঘটনায় আমি চরমভাবে হতাশ হয়েছি।
এইদিকে রামোসের আরেক সহপাঠী ইভান আরেলানো বলেন, স্কুলে হত্যাকাণ্ডের আগে তিনি ও তার সহপাঠীরা রব ইলেমেন্টারি স্কুলের হলের ভেতরে সমবেত কণ্ঠে গান গাইছিলেন। প্রথম যে হলের ভেতর দিয়ে তারা যাচ্ছিলেন, সেখানেই পরদিন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটান তার সাবেক সহপাঠী। তিনি এইট গ্রেড থেকে রামোসের সহপাঠী ছিলেন। এই সহপাঠী বলেন, রামোস ‘অসামাজিক’ আখ্যায়িত করে প্রায়ই অন্য সহপাঠীদের ভয় দেখাতেন।
এইদিকে টেক্সাসের ওই প্রাইমারি স্কুলে ভয়াবহ বন্দুক হামলার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘটনার নিন্দা জানিয়ে আবেগতাড়িত বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বন্দুক নিয়ন্ত্রণ আইন সংস্কারে আইনপ্রণেতাদের সহায়তা চেয়েছেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শনে দুয়েক দিনের মধ্যে সস্ত্রীক টেক্সাস যাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট।
ভয়াবহ এ বন্দুক হামলায় শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, স্তম্ভিত পুরো বিশ্ব। সারা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের যে অবস্থান, বন্দুক হামলার ঘটনা তাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র। অপরদিকে, বন্দুক সহিংসতাকে যুক্তরাষ্ট্রের জনস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক হুমকি বলে জানিয়েছেন রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের পরিচালক।
সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, বন্দুক হামলা যুক্তরাষ্ট্রকে পঙ্গু করে দিয়েছে। তিনি বলেন, বাবা-মায়েরা তাদের বাচ্চাদের বিছানায় শুইয়ে দেন, গল্প শোনান, গান শোনান। কিন্তু তাদের মনের মধ্যে চিন্তা- আগামীকাল তাদের বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে আসার পর কিংবা খোলা জায়গায় নিয়ে যাওয়ার পর, তাদের সঙ্গে কী ঘটবে! তিনি বলেন, স্যান্ডি হুকের প্রায় ১০ বছর পর এবং বাফেলোর ১০ দিন পর আমাদের দেশটি পঙ্গু হয়ে গেছে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট আক্ষেপ করে বলেন, একটি বন্দুক লবি ও একটি রাজনৈতিক দল যারা এই ট্র্যাজেডিগুলো প্রতিরোধ করতে সাহায্য করতে পারে; কিন্তু তারা এতে কোনো আগ্রহই দেখায় না। তিনি মনে করেন, বন্দুক সহিংসতা বন্ধে যে কোনো ধরনের পদক্ষেপের জন্য ইতোমধ্যে দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেছে।
২০১৫ সালে ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়ার সময় ডেমোক্রেটিক এই প্রেসিডেন্ট গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, নতুন বন্দুক আইন সংস্কার করতে ব্যর্থ হয়েছে তার প্রশাসন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে এটি ছিল তার সবচেয়ে বড় হতাশা।
ঘটনার পর দিন বুধবার (২৫ মে) স্থানীয় সময় দুপুরে টেক্সাসের গভর্নর গ্রেগ অ্যাবোট ওই হত্যাকান্ডের বিষয়ে আবারও সংবাদ সম্মেলন করেন। তিনি জানান, স্কুলে ঢুকে হত্যাকান্ডের আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজের পরিকল্পনা জানিয়ে পরপর তিনটি পোস্ট দিয়েছিল হামলাকারী।
গ্রেগ অ্যাবোট বলেন, এ ঘটনায় সবাই স্তম্ভিত।হামলাকারী ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে হামলা চালাতে গেছে। সেখানে সে তার দাদিকে গুলি করতে যাচ্ছে জানিয়ে প্রথম পোস্ট দেয়। এর পরের পোস্টে সে নিশ্চিত করে যে তার দাদিকে সে গুলি করেছে। তৃতীয় পোস্টটি দেয় স্কুলে হামলা চালানোর ১৫ মিনিট আগে। সেখানে সে একটি প্রাইমারি স্কুলে বন্দুক হামলা চালাতে যাচ্ছে বলে জানায়।
পুলিশ জানায়, হামলাকারী রামোস স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির একটি ক্লাসে ঢুকে নির্বিচারে গুলি চালায়। হামলার আগে ওই শ্রেণিকক্ষে নিজেকে ব্যারিকেড দেয় বন্দুকধারী। হামলাকারী রামোসের দাদাকে জিজ্ঞেস করা হলে জানান, তার নাতি সম্পর্কে এমন কিছুই আগে টের পাননি তিনি। তার কাছে যে বন্দুক আছে এ বিষয়টিও জানতেন না বলে জানান।
যুক্তরাষ্ট্রে একের পর এক বন্দুক হামলায় বাড়ছে উদ্বেগ। টেক্সাসের এ ঘটনায় আতঙ্কে অন্য রাজ্যের গভর্নররাও। নিউইয়র্কের গভর্নর ক্যাথি হোকুল জানিয়েছেন, তিনি বন্দুক কেনার বয়সসীমা ১৮ থেকে ২১ বছর করতে চান।ক্যাথি হোকুল বলেন, আমি কোনোভাবেই ভেবে পাই না ১৮ বছর বয়সী কেউ কেন আগ্নেয়াস্ত্র কিনতে পারবে। এটা কি বন্দুক কেনার সঠিক বয়স। আমরা বাফেলো এবং টেক্সাসে যা দেখলাম তা থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। নিউইয়র্কবাসীকে রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেয়া পর্যন্ত আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারবো না।
প্রসঙ্গত, অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসে এখন নাকাল যুক্তরাষ্ট্র। এ বছর এ পর্যন্ত ২১২টি গুলির ঘটনা ঘটেছে। যেখানে প্রাণ হারিয়েছেন হাজারো মানুষ। এমন হত্যাযজ্ঞ বন্ধে এখনই অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন সংস্কার করার ওপর জোর দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, আইন কঠোর করে এর কঠিন ও কার্যকর প্রয়োগ দরকার।
আইআই/সিএন
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন