রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

কুরবানির পশু পরিচর্যায় ব্যস্ত খামারিরা,কেমন হবে বাজার?

বৃহস্পতিবার, জুন ২৩, ২০২২

প্রিন্ট করুন

ইফতেখার ইসলাম: মুসলমানদের সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদ। তার মধ্যে একটি ঈদুল ফিতর আর অপরটি ঈদুল আযহা। আর কয়েকদিন পরেই পুরো মুসলিম জাহান পালন করবে ঈদুল আযহা। আর সেই উপলক্ষে কুরবানির পশু প্রস্তুত করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন বাংলাদেশের খামারিরা। সময় যত ঘনিয়ে আসছে খামারিরা তত বেশি যত্নবান হচ্ছেন পশু নিয়ে। আবার পশুর দাম নিয়ে চিন্তারও শেষ নেই তাদের।

দেশের শহর গ্রাম সব স্থানে পালিত হচ্ছে কুরবানির পশু। ঢাকা,চট্টগ্রামসহ বড় বড় বিভাগীয় ও জেলা শহর ছাড়া গ্রামে গঞ্জেও পালন করা হচ্ছে পশু। অবার অনেক কৃষকও কুরবানি উপলক্ষে মোটাতাজা করছেন গরু,মহিষ,ছাগল। আর দিন বাড়ার সাথে সাথে পশুকে আরো পুষ্ট ও সুন্দর করে তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন পালনকারীরা।

রাজধানীর গাবতলী, বেড়িবাঁধসহ বেশ কয়েকটি স্থানের গরু ও ছাগলের খামার ঘুরে দেখা যায়, সবগুলো খামারেই চলছে গরু ও ছাগলের শেষ মুহুর্তের পরিচর্যা। খামারিরা ব্যস্ত তাদের খামাদের পশুদের মোটাতাজাকরণ এবং ক্রেতাদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলার নানা পরিচর্যায়। ব্যস্ত সময় পার করছেন চট্টগ্রামের খামারিরাও।

খামারিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা এক বছর আগ থেকে গরুর পরিচর্যা করে আসছেন। এক বছর আগে প্রতিটি গরুর বাচ্চা ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকায় কিনে খামারে লালনপালন করছেন। প্রতিটি গরুর পেছনে তাদের মাসে প্রায় ৯ হাজার টাকা খরচ হয়। এগুলো কোরবানির সময় দেড় লাখ টাকা থেকে শুরু করে ৩ লাখ টাকায় বিক্রি করা হবে। কিছু কিছু গরু বেশি দামে কেনা হয়। এক বছর লালনপালনের পরে গরু বিক্রি করলে লাভ বেশি হয় বলেও জানান তারা।

গাবতলীর এক খামারী রাউফুন ইসলাম বলেন, ৬০ হাজার টাকার গরুর বাচ্চাকে এক বছর লালনপালন করার পরে সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকায় বিক্রি করা যায়। প্রত্যেক গরুতে ১৫/২০ হাজার টাকা লাভ হলেই বিক্রি করে ফেলি। এছাড়া বড় গরুগুলোতে লাভ বেশি হয়।

চট্টগ্রামের তরুণ খামারি ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, গতবছর আমার খামারে প্রায় ১২০টি ষাড় গরু ছিল। সেগুলোর মধ্যে ৭০টির মতো বিক্রি হয়েছিল। কোনো কোনো গরুতে ১০/১৫ হাজার টাকা লসও হয়েছিল। তাই এ বছর আগের গরুগুলোর সাথে অল্প কিছু গরু রেখেছি যেগুলো কোরবানির জন্য বিক্রি করবো। এ বছর হাতে মূলধন আছে কিন্তু গরু কম’। ২০২০ সালের কোরবানিতে তিনি প্রায় ২ কোটি টাকার গরু বিক্রি করেন বলে জানান।

এইদিকে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় নিজ বাড়িতে ছাগল পালন করছেন স্বামীহীন জোসনা বেগম। তার পাঁচটি জবাইযোগ্য ছাগল রয়েছে। কুরবানি উপলক্ষে ছাগলগুলো মোটাতাজা করেছেন তিনি। আর এগুলো বিক্রি করে ঘরের কাজ করার প্রত্যাশা জোসনার।

খামারিরা জানান, পশুখাদ্যের দাম বেশি হওয়ায় বেড়ে গেছে খরচ। আর এর ফলে একটু বাড়তি দাম আশা করছেন তারা। তবে দেশের বাহির থেকে গরু আমদানি হলে তা দেশীয় খামারিদের জন্য বিপর্যয় ঢেকে আনবে বলে মতামত খামারিদের। তাই তারা বলছেন, দেশে পর্যাপ্ত গরু থাকলে বাইরের দেশ থেকে গরু আমদানি না করলে ন্যয্য দাম পাবেন তারা।

বাজারে পশু সংকটের সম্ভাবনা কতটুকু?

আসন্ন ঈদ-উল-আযহা উপলক্ষে দেশে চাহিদা অনুযায়ী সংকট দেখা দিতে পারে গরুর। যদিও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, সংকটের সম্ভাবনা নেই।

বিগত বছরগুলোর গরুর সংখ্যার হিসাব করলে দেখা যায়, দেশে জবাইযোগ্য গরুর থেকেও প্রতি বছর ৩ থেকে ১০ লাখ গরু বেশি জবাই হতো। যেগুলোর অধিকাংশই আসতো ভারত থেকে। এবার করোনার কারণে ভারত থেকে গরু আসা সম্পূর্ণ বন্ধ হওয়ায় গরুর সংকট হতে পারে।

তবে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম মনে করেন, গরুর সংকট হলে ক্রেতারা ছাগল বা ভেড়া কিনবেন। এর ফলে গরু ,মহিষ, ছাগল, খাসি, ভেড়া মিলিয়ে কোরবানির জন্য জবাইযোগ্য গবাদি পশুর যে ১ কোটি ১৯ লাখ রয়েছে তা দিয়ে চাহিদা মিটে যাবে। তার ধারণা এবার কোরবানিতে এক কোটির বেশি পশুর চাহিদা থাকবে না।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ বছরের কোরবানির জন্য জবাইযোগ্য গবাদি পশুর সংখ্যা মোট ১ কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি। এর মধ্যে হৃষ্টপুষ্টকৃত গরু-মহিষের সংখ্যা মাত্র ৩৮ লাখ ৫৮ হাজার ৮০০টি। গৃহপালিত গরু-মহিষের সংখ্যা ৬ লাখ ৮৮ হাজার ২০০টি- এগুলো সাধারণত অনুৎপাদনশীল বলদ, বকনা, বয়স্ক গাভী। হৃষ্টপুষ্ট গরু ও মহিষ মিলে মোট ৪৫ লাখ ৪৭ হাজারটি।

কিন্তু গত বছর শুধু গরু-মহিষই কোরবানি হয়েছে ৫০ লাখ ৫১ হাজার ৯৬৮ টি। যদি গত বছরের সাথেও তুলনা করা হয় সেক্ষেত্রেও গরু-মহিষের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ কম।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, দেশে প্রতি বছর ৫০ থেকে ৫৫ লাখ গরু কোরবানি হয়। কখনও কখনও গরু মহিষ মিলে এটা ৬০ লাখও হয়। গত দুই বছর ধরে আমাদের আমদানির উপর নির্ভরতা খুবই কম। এক লাখও গরু আসে না। আগে যেখানে ১০ থেকে ১৫ লাখ গরু আসতো এখন সেটা এক লাখেরও নিচে নেমে গেছে। আমাদের দেশে উৎপাদিত গরুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (খামার) জিনাত সুলতানা বলেন, গত চার বছর থেকে আমাদের যে পরিমাণ কোরবানির পশুর চাহিদা সে চাহিদা দেশের পশুই মেটাচ্ছে। এবারও আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাই আমাদের সংকট হবে না।

এ বছর গরু ও মহিষ আছে ৪৫ লাখ ৪৭ হাজারটি, ছাগল ও ভেড়া আছে ৭৩ লাখ ৬৫ হাজার। আর বিদেশ থেকে আনা দুম্বা বা এই ধরনের প্রাণী আছে আরও চার হাজার ৭৬৫টি। মোট এক কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি।

বাড়তে পারে কুরবানির সংখ্যা:

গতবছর করোনার কারণে স্থবির ছিলো পুরো দেশ। মানুষের যেমন ঘর থেকে বের হতে আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তেমনি পশু কিনতেও সম্মুখীন হতে হয়েছে করোনার ভয়ে। আবার করোনায় চাকরি হারিয়ে, উপার্জন কমে অনেকে অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। সংগত কারণে কুরবানির সংখ্যা ছিলো কম।

তবে এ বছর করোনার সেই ভয় নেই। মানুষের জীবন আগের থেকে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। কমে আসছে অর্থনৈতিক সংকট। এমন পরিস্থিতিতে কুরবানির সংখ্যা বাড়ার সম্ভাবনা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। আর কুরবানির সংখ্যা বাড়লে দরকার পড়বে বাড়তি পশুর।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, করোনার কারণে গতবার কোরবানি দেয়া কম হয়েছিল। কারণ অনেকে হাটে গিয়ে গরু কিনতে পারে নি। আবার দেখা গেছে একটি গরু দুই জনে মিলে ভাগ করে কোরবানি দিয়েছে। মানুষের আয়ও কম ছিল এর জন্য কিনতে পারে নি। এবার সেটা হবে না, এবার মানুষ কিনবে।

প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের গোরক্ষা নীতির ধারাবাহিকতায় দেশটি থেকে গরু আমদানি কমিয়ে দেয় বাংলাদেশ। তখন থেকে দেশীয়ভাবে গরুর খামার গড়ে তুলতে জোর দেয় সরকার। দেশে বর্তমানে খামারির সংখ্যা ছয় লাখ ৯৮ হাজার ১১৫টি। খামারে কোরবানির পশুর পালন হচ্ছে সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রাম বিভাগে। এ বিভাগে পালন হচ্ছে ১৫ লাখ ৯৮ হাজার ৩১৫টি পশু।

Views: 0

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন