শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

মায়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত উত্তেজনায় আতঙ্কিত জনগণ, সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন!

রবিবার, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২২

প্রিন্ট করুন

ইফতেখার ইসলাম: গত বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্তে চলছে চরম উত্তেজনা।সীমান্তের ওপারে রাখাইন রাজ্যে প্রায় প্রতিদিন চলে গুলিবর্ষণ। আর এতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের বাসিন্দাদের মধ্যে। বিশেষ করে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের পড়তে হচ্ছে চরম সংকটে। তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সতর্ক করেই ইতি। যার ফলে দফায় দফায় গোলাবর্ষণে সীমান্ত এলাকায় ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আর এসব বিষয়ে সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকরা।

জানা গেছে, মিয়ানমার থেকে ছোড়া একটি মর্টারশেল গত শুক্রবার বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের কোনারপাড়া এলাকার সীমান্তে পড়ে। সেটির বিস্ফোরণে মো.ইকবাল হোসেন নামে একজন ঘটনাস্থলে মারা যায়। এ ঘটনায় শিশুসহ আহত হন আরও ৬ জন। এর আগে এইদিকে বিকেলে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে আহত হন উইনু থোয়াইং তঞ্চঙ্গ্যা (২২) নামে এক তরুণ। বিস্ফোরণে তার বাঁ পায়ের গোড়ালি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

দফায় দফায় গুলিবর্ষণ ও হতাহতে সীমান্ত এলাকায় শঙ্কিত জীবনযাপন করছেন সাধারণ জনগণ। প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না। অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। ঝুঁকি এড়াতে ঘুমধুম উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের পাশের কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে পরীক্ষার্থীরা বাংলা দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষায় অংশ নেয়। তবে বাংলাদেশ যুদ্ধ চায় না।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গোলাগুলির কারণে অনেকেই বাড়ি থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছেন। তারা সীমান্ত থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকার চেষ্টা করছেন। সীমান্ত এলাকায় রাবার বাগানে যেসব শ্রমিক কাজ করেন তাদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আপাতত সেখানে শ্রমিকরা কাজ করতে যাচ্ছেন না।

সীমান্তের এলাকাবাসীরা মনে করছেন এভাবে ঘটনা ঘটতে থাকলে আবারো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা রয়েছে। যা বাংলাদেশের ঠেকানো কষ্ট হয়ে যাবে। কারণ রোহিঙ্গা ইতোমধ্যে দেশে শক্ত ঘাঁটি তৈরি করে ফেলেছে। নিয়মিতই দেশে রোহিঙ্গা সংখ্যা বাড়ছে। বহু পথ অনুসরণ করে রোহিঙ্গারা এখনো দেশে ঢুকছে। অন্যদিকে প্রতি বছর প্রায় ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্ম দিচ্ছে। দিন যতই ঘড়াচ্ছে ততই প্রত্যাবাসন অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।

ঘুমধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, সীমান্তে দুই দিন গোলাগুলি বন্ধ থাকায় মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরেছিল। কিন্তু গত মঙ্গলবার ও বুধবার সকাল থেকে আবারও গোলাগুলি শুরু হওয়ায় ভয়ে আছে সীমান্তের লোকজন। বুধবারও গোলাগুলির শব্দ পাওয়া গেছে। পরে শুক্রবার সারাদিন ও রাতে গুলির ঘটনা ঘটেছে। মনে হচ্ছে মর্টার শেল ছোড়া হচ্ছে। শব্দগুলো বিকট। দিন দিন পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। এতে লোকজনের মাঝেও ভয়ভীতি বাড়ছে। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে

এইদিকে বাংলাদেশ সরকারে পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে শান্তিপূর্ণ ও কূটনৈতিকভাবে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রয়োজনে জাতিসংঘে অভিযোগ জানানো হবে। মায়ানমার থেকে ছোঁড়া গোলায় এক বাংলাদশি নিহত প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জাতিসংঘে যাবারও এহুশিয়ারি দিয়েছেন।

গত ১৪ সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমার আর কোনো গোলা ফেলবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে৷

কিন্তু পরাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন কথার পরও দেখা গেছে মিয়ানমার থেকে ছোড়া গোলা বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ সীমান্তে পড়েছে৷

মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক সামরিক অ্যাটাশে এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক বলেন, বাংলাদেশ মিয়ানমারকে শক্ত মেসেজ দিতে পারছে না৷ ফলে বাংলাদেশকে তারা পাত্তা দিচ্ছে না৷’

তিনি বলেন, সীমান্তে আমাদের এখন অবস্থানটি এমন হতে হবে যাতে তারা বুঝতে পারে যে এসব কিছু করে পার পাওয়া যাবে না৷ সীমান্তে সেই অবস্থানটি আমরা এখনো দেখতে পাচ্ছিনা৷’

তার কথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে বললেন, আমরা যুদ্ধ চাই না এটা তো বলার কোনো কথা নয়৷ এতে তো আমাদের দুর্বলতা প্রকাশ পায়৷ আমরা কী চাই সেটা বলতে হবে৷ আমার মনে হয় আমরা বিষয়টি ঠিক মতো অ্যাড্রেস করতে পারছি না৷

তিনি বলেন, এখন ময়ানমার সেনাবাহিনী বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে৷ আর আরাকান আর্মিও শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে৷ এটা দীর্ঘস্থায়ী হবে৷ তাই আমাদের বাস্তবে শক্ত অবস্থান নিতে হবে৷

ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশেকে মায়ানমারের বিষয় নিয়ে কূটনৈতিকভাবেই কাজ করতে হবে৷ কিন্তু  মিয়ানমারকে এটাও বোঝাতে হবে যে বাংলাদেশ জবাব দিতে সক্ষম৷ তারা আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে না সত্য কিন্তু তারা যা করছে তা একরকম যুদ্ধের উসকানি ছাড়া আর কিছু না৷

তার মতে, বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতায় এখন চীন ও ভারতকে গুরুত্বের মধ্যে নিতে হবে৷ এই দুইটি দেশকে কাজে লাগাতে পারলে মায়ানমারের অবস্থার পরিবর্তন হবে৷ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রয়োজনে বিষয়টি জাতিসংঘে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন৷ কিন্তু এই বলাই যেন শেষ না হয়৷

তিনি আরও বলেন, এটাকে আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে৷ কারণ মায়ানমার এমন একটি দেশ যেখানে গণতন্ত্র, মানবাধিকার বলে কিছু নেই৷ তারা নানা নিষেধাজ্ঞার মধ্যে আছে৷ এই অঞ্চলের নিরপত্তা স্থিতিশীলতার জন্য তারা হুমকি৷

প্রসঙ্গত, গত প্রায় এক মাস ধরে প্রতিদিন ভোর হতে রাত পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে মায়ানমার সেনা বাহিনীর মর্টারশেলের গোলার শব্দ ও বিমানের বোমা বর্ষণের বিকট শব্দ। গত ২৮ আগস্ট বেলা ৩টার দিকে মিয়ানমার থেকে নিক্ষেপ করা দুটি মর্টার শেল অবিস্ফোরিত অবস্থায় বান্দরবানের ঘুমধুমের তমব্রু উত্তর মসজিদের কাছে পড়ে। এরপর ৩ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৯টায় মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া দুটি গোলা এসে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঘুমধুম এলাকায় পড়ে।

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন