নিজস্ব প্রতিবেদক: কোন এলাকা বা দেশে ব্যাপক খাদ্য ঘাটতি দেখা দিলে তাকে দুর্ভিক্ষ বলে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, ফসলহানি, যুদ্ধ, অর্থসংকটসহ নানা কারনে দুর্ভিক্ষ সংগঠিত হয়। তবে কার্যকরি ও বাস্তবত সম্মত পদক্ষেপে দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা করা সহজসাধ্য হয়ে উঠে।
ইতিহাস ঘেটে দেখা যায়, যুগে যুগে বিভিন্ন কারনে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সঠিক পদক্ষেপ না নিলে এই দুর্ভিক্ষ মাসের পর মাস এমনকি কয়েক বছরও স্থায়ী হতে দেখা যায়। তেমনি ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর ক্ষমতায় থাকা কালে মদিনা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় কঠিন দুর্ভিক্ষ নেমে আসে। অনাবৃষ্টির কারণে টানা ৯ মাসে এ দুর্ভিক্ষ চলমান থাকে। এতে মদিনায় খাদ্যসংকট প্রকট আকার ধারণ করে। অনাবৃষ্টির কারণে মাঠঘাট শুকিয়ে যায় এবং পশুপাখি এমনকি মানুষও মরতে থাকে। এমনকি মদিনার মাটি কালো হয়ে ছাইরঙা হয়ে যায়। এ কারণে বছরটিকে ইসলামের ইতিহাসে ‘আমুর রামাদাহ’ বা ‘ছাইয়ের বছর’ বলা হয়। (তবকাতে ইবনে সাআদ: ৩ / ৩১০)। তবে ইসলামের এই মহান শাসকের বেশ কিছু কার্যকরী উদ্যোগ দুর্ভিক্ষের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনে।
যে সব উদ্যোগে দুর্ভিক্ষ কমে আসে-
দামী খাবার খাওয়া বন্ধ: খলিফা ওমর (রা.) নিজেই মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে যেসব খাবার, সেগুলো খাওয়া বন্ধ করে দেন। আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, দুর্ভিক্ষের সময় ওমর (রা.) জয়তুন তেল খেতেন, তাঁর পেট গুড়গুড় করত। ঘি খাওয়া একেবারেই বন্ধ করে দেন। পেটে আঙুল দিয়ে চাপ দিয়ে বলতেন, ‘তোমার মতো করে গুড়গুড় করতে থাকো। এই যাত্রায় মানুষ বেঁচে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তোমার জন্য এ ছাড়া আর কিছুই নেই।’ (তবকাতে ইবনে সাআদ: ৩ / ৩১৩-৩১৫)
গ্রাম থেকে খাবারের ব্যবস্থা:
ওমর (রা.) মরুর মানুষের জন্য গ্রামাঞ্চল থেকে খাবার আনার ব্যবস্থা করেন এবং আল্লাহর কাছে দুর্ভিক্ষ দূর করে দেওয়ার দোয়া করেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘বছরটি খুব কঠিন ছিল। …ওমর (রা.) বেদুইনদের জন্য গ্রাম থেকে উট, গম ও তেল নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। এরপর আল্লাহর কাছে দোয়া করে বলেন, ‘হে আল্লাহ, পাহাড়ের চূড়ায় তাদের রিজিক তৈরি করে দিন।’ (আল-আদাবুল মুফরাদ: পৃ. ১৯৮; তাবকাতে ইবনে সাআদ: ৩ / ৩১৬)
তখন মানুষের দুর্ভোগের সীমা ছিল না। অনেক মানুষই মারা গেছে। ক্ষুধা নিবারণে কেউ কেউ ইঁদুর পর্যন্ত খেয়েছে। ওমর (রা.) মিসরের গভর্নর আমর ইবনুল আস, কুফার গভর্নর সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস, বসরার গভর্নর আবু মুসা আল-আশআরি এবং শামের গভর্নর মুআবিয়া ইবনে আবি সুফইয়ানকে খাদ্য-বস্ত্র পাঠানোর জন্য চিঠি লেখেন।
মানুষকে আল্লাহর পথে ফিরে আসার আহ্বান:
নামাজ, দোয়া, মোনাজাত ও তওবার মাধ্যমে গুনাহমুক্ত হয়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার আহ্বান জানান ওমর (রা.)। ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘ওমর (রা.) দুর্ভিক্ষের বছর এমন এক আমল করতেন, যা এর আগে করতেন না। মসজিদে এশার নামাজ পড়ে ঘরে আসতেন। এরপর রাতের শেষ প্রহর পর্যন্ত নামাজ আদায় করতেন। এরপর ঘর থেকে বেরিয়ে মদিনার উপকণ্ঠ ‘আনকাব’-এ এসে ঘোরাফেরা করতেন। একদিন শেষ রাতে আমি তাঁকে দোয়া করতে শুনেছি, ‘হে আল্লাহ, আমার হাতে মুহাম্মদের জাতিকে ধ্বংস কোরো না।’
আল্লাহর আজাবের ব্যাপারে সতর্ক করা:
ওমর (রা.) দুই হাত তুলে কায়মনোবাক্যে দোয়া করেন। নিজে কাঁদেন, সবাইকে কাঁদান। মোনাজাতে একটি বাক্য বারবার বলেছিলেন সেদিন, ‘আল্লাহ! দুর্ভিক্ষ দিয়ে আমাদের ধ্বংস করবেন না এবং আমাদের থেকে বিপদ উঠিয়ে নিন।’ এরপর মানুষকে তওবা করার পরামর্শ দেন।
বৃষ্টির নামাজ আদায়:
ওমর (রা.) দুর্ভিক্ষের দিনে লোকজন জড়ো করে বৃষ্টির জন্য দুই রাকাত নামাজ পড়েছিলেন এবং দোয়া করেছিলেন। দোয়ায় তিনি বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ, আমাদের সঙ্গীরা আমাদের থেকে নিরাশ হয়েছে। আমাদের সামর্থ্যে আমরা কুলিয়ে উঠতে পারিনি। আমরা অক্ষম। আপনার শক্তি ছাড়া কোনো শক্তি নেই। হে আল্লাহ, বৃষ্টি দিন। মানুষ বাঁচান, দেশ বাঁচান।’ এই দোয়ার পরেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে।
সাহায্যের জন্য গভর্নরদের চিঠি:
ওমর (রা.) দুর্ভিক্ষে সাহায্যের আকুতি জানিয়ে আঞ্চলিক প্রদেশগুলোর গভর্নরদের কাছে চিঠি লেখেন। চিঠি পেয়ে মিসর থেকে আমর ইবনুল আস (রা.) এক হাজার উট ময়দা পাঠালেন। ২০টি সামুদ্রিক জাহাজে পাঠালেন তেল। পাঁচ হাজার পোশাক পাঠালেন। ইরাক থেকে সাআদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) পাঠালেন তিন হাজার উট ময়দা। তিন হাজার চাদর। শামের গভর্নর মুআবিয়া (রা.) পাঠালেন দুই হাজার উট নিত্যপণ্য। এভাবে সব প্রদেশ এগিয়ে আসে।
এভাবেই তিনি দুর্ভিক্ষ মোকেবেলায় সচেষ্ট হন।
সিএন/এমটি
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন