শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

বড়দিনকে ঘিরে নিউইয়র্কে উৎসবের আমেজ

শনিবার, ডিসেম্বর ২৩, ২০২৩

প্রিন্ট করুন
বড়দিন

ইফতেখার ইসলাম: আর কয়েকদিন পরেই খ্রিষ্টানধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব বড়দিন। বড়দিন মানেই ক্রিসমাস ট্রি সাজানো, কেক, কুকিজ, উপহারের মেলা; সান্তা ক্লজোর টুপি পরে আনন্দ আয়োজনে মেতে ওঠা। গত কয়েক বছর করোনার কারণে বড়দিনের উৎসব ম্লান হলেও এবার চলছে তুমুল প্রস্তুতি। উৎসবের সাজে সেজে উঠেছে পুরো নিউইয়র্ক। নগর থেকে প্রান্তিক জনপদে বইছে উৎসবের আমেজ। হরেক রকমের আলোকসজ্জ্বা আর মলে মলে চলছে শপিংয়ের হিড়িক। বিপণিকেন্দ্রগুলোতে অনবরত বাজছে, ‘ফেলিস নাভিদাদ…( হ্যাপি ক্রিসমাস বা শুভ বড়দিন ) প্রসপেরো আনিও ই ফেলিসিদাদ (নতুন বছর সাফল্যের হোক)।’

বড়দিনকে ঘিরে নভেম্বরের শেষের দিক থেকে নিউইয়র্কে শুরু হয়েছে উৎসবের প্রস্তুতি। প্রথা অনুযায়ী ক্রিসমাস ট্রি সাজানো আছে ঘরে ঘরে। সাজানো ক্রিসমাস ট্রির নিচে রাখা হচ্ছে উৎসবের মৌসুমে পাওয়া সব উপহার। ক্রিসমাসের দিন সকালে উঠে এসব উপহারের মোড়ক খোলা হবে। উপহার দেওয়া আর পাওয়ার আনন্দের মধ্যে প্রিয়জনকে নিয়ে ভোজে যোগ দেওয়াটা এখানকার ক্রিসমাস পালনের পুরোনো প্রথা।

সরজমিনে দেখা গেছে, বড়দিনকে ঘিরে শেষ সময়ের প্রস্ততি নিচ্ছেন নিউইয়র্কবাসী। শহরের প্রায় প্রত্যেক জায়গায় লেগেছে সাজের ছোঁয়া। বড় বড় শপিং কমপ্লেক্স, রেস্টুরেন্ট, বারসহ প্রায় সব জায়গা সাজানো হয়েছে। বসতবাড়িগুলোতে দেখা যাচ্ছে হরেক রকমের বাতি জ্বলার দৃশ্য। শুধু তাই নয় বড়দিনকে ঘিরে বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রগুলোতেও বেড়েছে ভিড়। তবে আবহাওয়াজনিত কারণে বড়দিনের উৎসবে কিছুটা বিঘ্ন হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

জেসি ব্রুনেট নামে নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের এক বাসিন্দা বলেন, ক্রিসমাস সকলের জন্য খুশির দিন। এইদিনে সবাই যেভাবে একত্রিত হওয়া যায় ‍ঠিক তেমনি আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠা যায়। এবার ক্রিসমাস আমার জন্য স্পেশাল কারণ আমি আমার সন্তানকে ফিরে পেয়েছি।

তিনি আরও বলেন, আমরা ইতিমধ্যে ঘর সাজিয়েছি সুন্দরভাবে। নতিুন ফার্নিচার ও ফ্রিজ এসেছে। আশা করছি খুব সুন্দরভাবে উঃসব পালিত হবে।

শুধু খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীই ক্রিসমাস এখন সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও এখন দিনটি পালন করে। খ্রিষ্টান নন এমন অনেকেই বাড়িতে ক্রিসমাস ট্রি সাজায়। নানারকম খাবার-দাবারের আয়োজন করে। নিউইয়র্ক নগরীতে বসবাসরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থী অহনা চৌধুরী বলেন, বড়দিন উপলক্ষে আমরাও ঘর সাজিয়েছি। ক্রিসমাসের প্রধান আকর্ষণ হলো নানা ধরনের কেক ও পিঠা। আমরা বাঙালি ধরনেই পিঠা বানাই। বিশেষভাবে তেলের পিঠা ও পাকন পিঠা অবশ্যই থাকে। আবার বাড়িতে পোলাও-রোস্ট রান্না করি এদিন। প্রত্যেকে এখানে নিজের সংস্কৃতি অনুযায়ী খাবার তৈরি করে। তবে কেক সব জায়গায় থাকে।

এদিকে বড়দিনকে ঘিরে নিউইয়র্কে যেমন উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে তেমনি রয়েছে শঙ্কাও। আর এই শঙ্কার পেছনে রয়েছে শহরের বন্দুক হামলা। প্রায় প্রত্যেক বছর বড়দিনের উৎসবে বয়ে যায় রক্ত বন্যা। বন্দুক হামলায় ম্লান হয়ে যায় উৎসব। এবারও তেমনটা হবে কি না সেই শঙ্কা সাধারণ মানুষের। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন শহরের নিরাপত্তা নিশ্চিতে তারা সজাগ রয়েছেন।

বড়দিনের নানা বিষয়

ক্রিসমাস ট্রি’র কাহিনী: ক্রিসমাস ট্রি যেন ক্রিসমাস উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ। এই উৎসবে ক্রিসমাস ট্রি উপহার দেওয়া বর্তমানে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির কালচারে পরিণত হয়েছে। তবে এই ক্রিসমাস ট্রি বড়দিনের উৎসবের সঙ্গে কিভাবে জড়িয়ে গেল তা নিয়ে অনেক রকম মিথ রয়েছে। একটা মিথ বলছে, ১৫৩৬ সালের এক শীতের রাতে মার্টিন লুথার নামের এ ধর্মতাত্ত্বিক তার বাড়ির কাছের পাইন বনের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় গাছের ডালে অসংখ্য তারা ঝলমল করতে দেখেন। তখন তিনি ক্রিসমাস ট্রিকে আলো দিয়ে সাজিয়ে তোলার কথা প্রথম ভাবেন।

বেশির ভাগ মানুষের দাবি, ক্রিসমাস ট্রি সাজানোর প্রথা চালু করেন খ্রিস্ট ধর্মের সংস্কারক এই মার্টিন লুথার। অন্য এক মিথে বলা হচ্ছে, রোম নগরীতে এক দরিদ্র শীতার্ত শিশু এসে হাজির হয় এক ঘরে। ঘরটি ছিল গরিব এক কাঠুরের। এই কাঠুরে এবং তার স্ত্রী ছিলেন যিশুভক্ত। তারা শিশুটিকে ঘরে নিয়ে নিজেদের খাবার খাওয়ালেন।

শিশুটিকে নরম বিছানায় শুতে দিয়ে নিজেরা শুলেন শক্ত কাঠের ওপরে। সকালে সেই শিশু দেবদূতের রূপ ধারণ করে বলল, তিনিই স্বয়ং যিশু। কাঠুরে দম্পতির আচরণে খুশি হয়ে একটি গাছের টুকরা দিয়ে শিশুরূপী যিশু বললেন তা মাটিতে পুঁতে দিতে। দম্পতিটি তাই করলেন। এরপরের ক্রিসমাসে দেখা গেল ওই ডালটি সোনালি আপেলে ভর্তি হয়ে গেছে। আবার অনেকের মতে মধ্যযুগে অনেক মানুষ ক্রিসমাস ট্রিকে সম্বোধন করতেন ট্রি অব প্যারাডাইস নামে। তখনকার মঞ্চনাটকগুলোতে স্বর্গের গাছের রূপক হিসেবে ক্রিসমাস ট্রি ব্যবহূত হতো।

যার ডালে ডালে ঝুলত আপেল। এসব নাটক মঞ্চস্থ হতো ধর্মীয় জ্ঞান বৃদ্ধির লক্ষ্যে ও বিনোদনের জন্য। পরে মানুষ ওই ধরনের ছোট ছোট গাছ ঘরে নিয়ে রাখতে শুরু করে। এরপর আপেলের জায়গা নিতে থাকে নানা রঙের চকচকে বল ও সুগারক্যান্ডি।

আমেরিকার সাহিত্যে প্রথম ক্রিসমাস ট্রি আসে ১৮৩৬ সালে। নিউ ইয়ারস ডে নামের একটি গল্পে। যার লেখক ক্যাথরিন মারিয়া। গল্পটিতে এক জার্মান গৃহপরিচারিকা মনিবের জন্য একটি ক্রিসমাস ট্রি সাজায়। আর ক্রিসমাস ট্রিতে বৈদ্যুতিক বাতি ঝোলানোর চল করেন এডিসন কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যাডওয়ার্ড জনসন ১৮৮২ সালে।

আধুনিক ক্রিসমাস ট্রির প্রচলন হয় জার্মানিতে ১৮ শতকে। আর ১৮৪১ সালের দিকে ক্রিসমাস ট্রি পুরো ব্রিটেনে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আর বছর ত্রিশেকের মধ্যে আমেরিকাতেও ক্রিসমাস ট্রি জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৮২ সালে ভ্যাটিকান সিটিতে ক্রিসমাস ট্রির প্রবর্তন করেন পোপ জন পল দ্বিতীয়। ২০০৪ সালে পোপ জন পল ক্রিসমাস ট্রিকে খ্রিস্টের প্রতীক বলে মত প্রকাশ করেন।

যিশু খ্রিস্টের জন্মদিনের উৎসব: বিশ্বজুড়ে ২৫ ডিসেম্বরকে যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন বা বাৎসরিক খ্রিস্টীয় উৎসব হিসেবে পালন করা হয়। খ্রিস্টান অনুসারিদের কাছে এটি বড়দিন বা প্রধান ধর্মীয় উৎসবের নাম। খ্রিস্টানদের বিশ্বাস অনুসারে, এই তারিখের ঠিক নয় মাস আগে মা মেরির গর্ভে অলৌকিকভাবে প্রবেশ করেন যিশু।

অপর এক মতে একটি ঐতিহাসিক রোমান উৎসব অথবা উত্তর গোলার্ধের দক্ষিণ অয়নান্ত দিবসের অনুষঙ্গেই ২৫ ডিসেম্বর তারিখে যিশুর জন্মজয়ন্তী পালনের প্রথা চালু হয়। আদি বাইবেলের ত্রাণকর্তা-সংক্রান্ত একাধিক ভবিষ্যদ্বাণীতে বলা হয়েছে, কুমারী মেরির গর্ভে তাদের ত্রাণকর্তার জন্ম হবে। আর সে নিয়মের বাস্তব রূপ যিশুর জন্ম। সংস্কারকৃত বাইবেলে বলা হয়েছে, যিশুর জন্মকাহিনী খ্রিস্টমাস উৎসবের মূলভিত্তি। এই উপাখ্যান অনুসারে, হবুস্বামী জোসেফের সাহচর্যে বেথলেহেম শহরে উপস্থিত হয়ে মেরি যিশুর জন্ম দেন।

জনপ্রিয় ধারণা অনুযায়ী, একটি আস্তাবলে গবাদি পশু পরিবৃত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন যিশু। যদিও বাইবেলের উপাখ্যানে আস্তাবল বা গবাদি পশুর কোনো উল্লেখ নেই। সেখানে একটি যাবপাত্রের উল্লেখ আছে। পরিবারের অতিথিদের জন্য নির্দিষ্ট চিলেকোঠায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন যিশু।

ঠাণ্ডার হাত থেকে বাঁচাতে তৎকালীন রেওয়াজ মেনেই খড়ের উপর সদ্যোজাতকে শোওয়ানো হয়েছিল। চিরাচরিত বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দুবছর আগে এমনই চমকপ্রদ তথ্য পেশ করেছেন যাজক আয়ান পল। অনেক খ্রিস্টানই মনে করেন, যিশুর জন্ম আদি বাইবেলের ত্রাণকর্তা-সংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণীকে পূর্ণতা দেয়।

সান্তা ক্লসের গল্প: বড়দিন এলেই সান্তা ক্লসের কাছ থেকে পাওয়া চকোলেট আর উপহার যেন বাচ্চাদের পরম আরাধ্য। বিশেষ এই দিনে সান্তা ক্লস আসে উপহারের ঝুড়িতে খুশির বারতা বয়ে। সঙ্গে ছোট-বড় সবার জন্য উপহার হিসেবে দেয় নানা রকমের মুখরোচক চকোলেট। তাই হয়তো বড়দিন মানেই যেন সান্তা ক্লসের কাছ থেকে উপহার পাওয়ার অন্যতম উপলক্ষ—সঙ্গে মণ্ডা-মিঠাই।

খ্রিস্টীয় ধর্মের অংশ না হলেও সান্তা ক্লস নামটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই নামটি এসেছে খ্রিস্টান ধর্মযাজক সেন্ট নিকোলাসের ওলন্দাজ নাম সিন্টার ক্লাস থেকে। তার জন্ম হয়েছিল আধুনিক তুরস্কের নিকটবর্তী সমুদ্রবর্তী ‘পাতারা’ নামক এক গ্রামে। মায়রার বিশপ নির্বাচিত হওয়ার অল্পদিন পরেই তাকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর সম্রাট কনস্টেনটাইন ক্ষমতায় আরোহণ করলে তিনি মুক্তি লাভ করেন।

সেন্ট নিকোলাস ছিলেন ধনাঢ্য বাবার দয়ালু ছেলে। কথিত আছে, সেন্ট নিকোলাস উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সব ধন-সম্পত্তি গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। বিপদাপন্ন মানুষের সন্ধানে সেন্ট নিকোলাস এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা, এক দেশ থেকে আরেক দেশ চষে বেড়াতেন। সেন্ট নিকোলাস পরিচিতি পেতে থাকেন বাচ্চাদের পরম বন্ধু ও সবার দুর্দিনের সাথী হিসেবে।

এভাবেই একসময় সেন্ট নিকোলাস সারা ইউরোপে সবচেয়ে জনপ্রিয় সাধু ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। তার মৃত্যুর তারিখ ৬ ডিসেম্বরকে একটি পবিত্র দিন হিসেবে পালন করা হয়। ১৭৭৩-৭৪ এর দিকে একদল ওলন্দাজ পরিবারের সেন্ট নিকোলাসের মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে সমবেত হওয়ার কথা নিউইয়র্ক পত্রিকাতে প্রথম প্রকাশিত হয়। একই সঙ্গে পরিচিতি পায় নামটি।

আইআই/সিএন

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন