শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

অন্য বৈশাখ

শনিবার, এপ্রিল ১৫, ২০২৩

প্রিন্ট করুন

পুলক বড়ুয়া: এবারের পয়লা বৈশাখে আমি বাইরে যাব না। আমি বাইরে না গেলে কিছু হবে না। যেমন, কেউ আইনী নোটিশ দিলেও কিছু হবে না। আমি বাইরে না গেলে ব্যক্তিগতভাবে কারো কিছু এসে যায় না । কিন্তু, এই আইনী নোটিশ কেউ ব্যক্তিগতভাবে দিলেও জাতিগতভাবে আমাদের অস্তিত্বের মর্মমূল ধরে নাড়া দেয়। আমরা এটা মানতে পারি না। এটা আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি ও কৃষ্টি-প্রসঙ্গ। হাজার বছর ধরে বেড়ে ওঠা, দীর্ঘ গড়ে ওঠা ঐতিহ্যকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে আমাদের সংস্কৃতিকে ভূলুণ্ঠিত করার নয়া-চক্রান্ত ও নব্য অপপ্রয়াস।

এখন এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে, এত স্বাধীনতা তাদের কে দিয়েছে? স্বাধীনতা-পূর্ব ষাটের দশকের শুরুতে রবীন্দ্রনাথকে নির্বাসনে পাঠিয়ে একবার আমাদের সংস্কৃতিকে কোণঠাসা ও নস্যাৎ তথা বিকৃত করার প্রয়াস চালায় পাকিস্তানীরা। তাদের ন্যাক্কারজনক পদক্ষেপ একবার নয় বারবার পরাজিত হয়েছে। তারা রাজনৈতিক দূরভিসন্ধির মধ্য দিয়ে ধারাবাহিকভাবে ভাষা-সংস্কৃতি-শিক্ষা-অর্থনীতিকে পঙ্গু করে একটি জাতির চূড়ান্ত সর্বনাশ চেয়েছিল। আমাদেরকে সর্বস্বান্ত ও অথর্ব করে দিতে চেয়েছিল । এইজন্যে তারা শুরুতে সংস্কৃতির ওপর হাত দিয়েছিল। প্রথম আঘাতটা করেছিল বাঙালি জাতির সংস্কৃৃতিকে। আমাদের সংস্কৃৃতির প্রধানতম অঙ্গ—মোক্ষম অস্ত্র—বাংলা ভাষার ওপর হামলা করেছিল। কেড়ে নিতে চেয়েছিল তাঁর প্রাণ। আমরা জীবন দিয়ে ঠেকিয়েছিলাম। যদি তারা সেদিন আমাদেরকে নিরস্ত্র করতে পারত, কামিয়াব হত। কিন্তু, বিসমিল্লায় গলদ। সে স্বপ্ন-সাধ তাদের ভেস্তে গেল। পঞ্চাশের দশকের এ ব্যর্থতার পর ষাটের প্রথমার্ধে বাবুল-ওয়াজিউল্লাহর জীবনের বিনিময়ে শিক্ষা আন্দোলন হল। মধ্যষাটে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধের পর্যায়ে ফেলে আমাদের সংস্কৃতির এই মহাস্তম্ভকে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। কী করেনি তারা? ভাষাকে কেড়ে নিতে চেয়েছিল। শিক্ষাকে কুখ্যাত করতে চেয়েছিল। সংস্কৃতিকে দরিদ্র করতে চেয়েছিল। কিন্তু, ওদের নীল নকশা বারবার মুখ থুবড়ে পড়েছে।

আমরা বারেবারে দেখেছি, দেখছি,  একটি পতিত সময়ের ভূত-প্রেতাত্মাদের ছায়া এখনো আছর করে। সাংস্কৃতিকভাবে যেমন, রাজনৈতিকভাবে তো বটেই। আমরা পয়লা বৈশাখ উদযাপনকালে রমনা বটমূলে মুহুর্মুহু ভয়ংকর বোমা হামলার শিকার হয়েছি। মধ্যরাতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে পয়লা বৈশাখ উদযাপন-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতিকে অপমান করতে দেখেছি। আজ আবার দেখছি তার অঙ্গহানির আয়োজন। সবচেয়ে অবাক করে স্বাধীনতা-উত্তরকালের তাদের এ দুঃসাহস। ভিন্ন হাওয়া অন্য আলো আর সেইসব ঘাতক ও হায়েনার ছায়াপাত। না, শেষপর্যন্ত ধোপে টেকেনি। টেকে না। তবু, এদের স্বভাব এখনো তাই রয়ে গেছে। তাই, আমরা রুখে দাঁড়াই।

তবে, সুযোগসন্ধানী-সুবিধাবাদীদের দল কতভাবেই না জাতির ভেতরে অস্থিরতা সৃষ্টির ইন্ধনদাতা হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে, এটা এ মুহূর্তের একটি বিষ-নজির। আহত-মৃতপ্রায় সাপেরা আপাতদৃষ্টিতে লুটিয়ে পড়ে। তবে, কখনো নত নয় । সুযোগ পেলে তারা ছোবল দেবেই। ফণা তুলবেই। তার আগেই তার বিষদাঁত উপড়ে ফেলতে হয়। ভেঙে দিতে হয়। বরং উল্টো স্বাধীনতা-উত্তর নেতিবাচক রা‌‍জনৈতিক প্রক্রিয়ার অন্ধকারে-অন্তরালে—কখনোবা ওপেন-সিক্রেট—এরা নানাভাবে লালিত পালিত—বিকশিত হয়েছে। 

বিষবাস্প ছড়ানো এই বিষবৃক্ষগুলো হেলাফেলা করার বিষয় নয়। আমলে নেওয়া উচিত। সমাজদেহে বিষফোঁড়ার ব্যথা-বেদনার উৎপাত বাড়বে বৈ কমবে না। তার অত্যাচার অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারে। সময় থাকতে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। অন্যথায় মাশুল গুনতে হবে। এরা ছলেবলেকৌশলে নানাক্ষেত্রে বিদ্যমান। সময়ে এদের প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা যায়। অন্য সময়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। জাতির ইতিবাচক আবেগ অনুভূতিকে এরা লীলাখেলা মনে করে। এই যে প্রকাশ্যে আদাজল খেয়ে নেমেছে, অপ্রকাশ্যে? এদের সুপ্ত অরূপ স্বরূপ জাতির সামনে খোলাসা করা দরকার। এরা একটা জাতিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দিতে চায় না। বরং টেনে নিচে নামাতে চায়। আসুন, এই জীবন্ত আলামতগুলো জব্দ করি। 

একটা প্রতিবিধান প্রয়োজন। বারবার ঘুঘু এসে ধান খেয়ে যাবে, তা হয় না। এদেশের কৃষক, শ্রমিক, জেলে, তাঁতি, কামার, কুমোর, মজলুম তৃণমূল খেটে খাওয়া, শ্রমজীবী মানুষের ঘামের গন্ধ, রূপ, তাদের স্বকীয় সুকুমার বৃত্তির ফলশ্রুতি—যার আত্তীকৃত সমাহার-নির্যাস, শৈল্পিক শোভাযাত্রা, নান্দনিক আয়োজন, যাদের উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভালো লাগে না, আসুন, তাদের কাছ আমরা থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিই, মুখ ফিরিয়ে নিই, বিমুখ হই। এদেশের মা, মাটি, জল, হাওয়া, নীলিমার আঁচলতলে অতি আদরে লালিত—বেড়ে ওঠা, গড়ে ওঠা—আমাদের সমস্ত কাঠামো-অবকাঠামো ঘুণে ধরার হাত থেকে রক্ষা করি। বাঁচাই।

সুতরাং, এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রা হোক, অশুভ শক্তির মুখোমুখি অপ্রতিরোধ্য অভিযাত্রা। অপশক্তিকে রুখে দাঁড়ানোর প্রতি সাহসী সংহতি। অরিকে দমন করার দিকে অতি আবশ্যকীয় অবিনশ্বর কাফেলা । চিত্তপটে শুভবাদী চিত্ররূপ। হৃদয়ের গোলাঘরে চিরায়ত বাঙ্ময় উচ্চারণ। 

অতএব, এবারের পয়লা বৈশাখে রচিত হোক এক নয়া দিগন্ত। নতুন একটি প্রতিজ্ঞা। এক নয়া পণ। এক নয়া শপথ। যে নবীন অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে উদিত হবে একটি  পরিপূর্ণ নবজাগরণ। যার কাছে আশু মাথা নোয়াবে, হেরে যাবে সব অপশক্তি।

তাই, এই বৈশাখ দ্রোহী বৈশাখ। বিদ্রোহী বৈশাখ। অন্য বৈশাখ।

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন