সোমবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৪

শিরোনাম

নবজাতক ও শিশুদের জন্ডিস: যা জানা জরুরি

শুক্রবার, অক্টোবর ১৩, ২০২৩

প্রিন্ট করুন
নবজাতক ও শিশুদের জন্ডিস: যা জানা জরুরি

ইফতেখার ইসলাম: আমাদের দেশে শিশু জন্মের পর যে কটা রোগ একেবারেই কমন তারমধ্যে জন্ডিস একটি। বিশেষ করে নির্দিষ্ট সময়ের আগে কোন শিশু জন্মগ্রহণ করলে বা শরীরের ওজন কম থাকলে শিশুরা এই রোগে আক্রান্ত হয়। জন্ডিসে আক্রান্ত নবজাতক শিশুদের মধ্যে ছেলেদের হার বেশি, তবে মেয়ে শিশুরা যে আক্রান্ত হয় না তা কিন্তু নয়। শিশুর যকৃৎ পুরোপুরি কর্মক্ষম হয়ে উঠতে একটু দেরি হলে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে গিয়ে জন্ডিস হয়। আর শিশুর জন্মের পর এই রোগে আক্রান্তের পর সঠিক চিকিৎসা না হলে নবজাতকের মারাত্বক ক্ষতি হতে পারে। তাই এর সম্পর্কে আমাদের সবার কম বেশি জেনে রাখা ভালো।

নবজাতক শিশুর জন্ডিস হওয়ার কিছু কারণ:
• কম ওজনে ভূমিষ্ঠ শিশু বা সময়ের আগে জন্ম নেওয়া শিশুরা জন্ডিসে বেশি আক্রান্ত হয়। এছাড়া জন্ডিসের কারণ হিসেবে যে বিষয়গুলো দায়ী হতে পারে, তা হলো:
• মা ও শিশুর রক্তের গ্রুপ যদি ভিন্ন হয়।
• শিশু সঠিক সময়ে পর্যাপ্ত বুকের দুধ না পেলে, অনেক সময় একে ব্রেস্ট ফিডিং জন্ডিসও বলা হয়।
• গর্ভাবস্থায় মায়ের কোনো সংক্রমণের ইতিহাস।
• শিশু জন্মগত কোনো রোগে আক্রান্ত হলে।
• জন্মের পর শিশুর রক্তে সংক্রমণ বা সেপটিসেমিয়া।
• জন্মগতভাবে শিশুর যকৃৎ বা পিত্তথলিতে কোনো সমস্যা ইত্যাদি।

যেভাবে বুঝবেন জন্ডিস
শিশুর শরীর হলুদভাব হয়ে যায়। শিশুর মুখমণ্ডলের চামড়া, হাত ও হাতের তালু হলুদ সহজে চোখে ধরা পড়ে। জন্ডিসের সঙ্গে অন্য যেসব রোগ বা যেসব রোগের কারণে জন্ডিস হয়, সেগুলোর উপসর্গও থাকতে পারে। যেমন: শিশুর নড়াচড়া কমে যাওয়া, তীব্র জ্বর, খেতে না পারা, শরীর বেশি ঠাণ্ডা হওয়া, কখনো খিঁচুনি।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা: রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা এবং প্রত্যক্ষ না পরোক্ষ তা নির্ণয়, মা ও নবজাতকের রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা, কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট, কুম্বস টেস্ট, রেটিকুলোসাইট কাউন্টসহ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা।

নবজাতকের যত ধরণের জন্ডিস হতে পারে
নবজাতকের জন্ডিস সাধারণত ২ ভাগে ভাগ করা যায়।

১) ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস বা সাধারণ জন্ডিস।

২) ক্লিনিক্যাল জিন্ডিস

এই ক্লিনিক্যাল জন্ডিসের আবার প্রকারভেদ আছে। যেমন-

জন্মের ২৪ ঘন্টার মধ্যে হলে বুঝতে হবে, মা ও নবজাতকের রক্তের ভিন্নতাজনিত সমস্যা, মায়ের পেটে থাকাকালীন সময়ে কোন ইনফেকশন (পক্স, রুবেলা, সিফিলিস), গ্লুকোজ সিক্স ফসফেট ডিহাইড্রোজিনেস ডেফিসিয়েন্সি বা স্বল্পতা ইত্যাদি কারণে হতে পারে।

জন্মের ২৪-৭২ ঘন্টার মধ্যে হলে বুঝতে হবে যদি প্রিম্যাচিওর বা অপরিণত শিশু হয়, জন্মকালীন শ্বাসকষ্ট, এসিডেসিস, হাইপোথারমিয়া বা শরীরের তাপমাত্রা অতিরিক্ত কমে যাওয়া, হাইপোগ্লাইসেমিয়া বা রক্তে গ্লুকোজের স্বল্পতা, শিশুর কোন ইনফেকশন ইত্যাদি হতে পারে।

আর যদি জন্মের ৭২ ঘন্টা পর হয় তবে বুঝতে হবে, সেপ্টিসেমিয়া বা রক্তের ইনফেকশন, নিওন্যাটাল হেপাটাইটিস, ব্রেস্ট মিল্ক জন্ডিস বা মায়ের বুকের দুধের মাধ্যমে জন্ডিস, হাইপোথাইরয়েড, বিলিয়ারি এন্ট্রিসিয়া, গ্যালাকটোসিমিয়া, সিস্টিক ফাইব্রোসিস, কনজেনিটাল হাইপারট্রফিক পাইলোরিক স্টেনোসিস ইত্যাদি কারণে হয়েছে। এগুলো জন্মগত ত্রুটি ও রোগের নাম যার চিকিৎসা রয়েছে।

জন্ডিস হলে কি বুকের দুধ খাওয়ানো যাবে?

কোনো অবস্থায়ই নবজাতককে বুকের দুধ খাওয়ানো থেকে বিরত রাখা যাবে না। শিশুকে নিয়মিত দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর পর বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। বিশেষ করে ফিজিওলজিক্যাল বা স্বাভাবিক জন্ডিসের মূল চিকিৎসাই হচ্ছে শিশুকে ঠিকমতো বুকের দুধ খাওয়ানো।

রোদ চিকিৎসা বা আলো চিকিৎসা

বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে গেলে সাধারণত শিশুকে ফটোথেরাপি বা আলোক চিকিৎসা দেওয়া হয়। এর উপকারিতা ও কার্যকারিতা নিয়ে মতভেদ থাকলেও এখন পর্যন্ত এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া প্রতিদিন সকালে নবজাতককে আধা ঘণ্টা রোদ পোহাতেও বলা হয়। তবে সূর্যের কড়া রোদ ও অতিবেগুনি রশ্মি ত্বকের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

চিকিৎসা


সাধারণত জন্মগত কারণে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ জন্ডিস পরিলক্ষিত হয়। এসবের বেশির ভাগই ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস বা সাধারণ জন্ডিস। ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস-এর ক্ষেত্রে নবজাতককে প্রতিদিন আধা ঘণ্টা করে ১০ দিন সূর্যের আলোতে রাখলেই ভালো হয়ে যায়। তবে জন্ডিস-এর মাত্রা বেশি মনে হলে (বিলিরুবিন ১৪ বা তার বেশি হলে) হাসপাতালে এনে ফটোথেরাপি দিতে হয়। নবজাতকের রক্তে বিলিরুবিন-এর মাত্রা কেমন, শিশু কত সপ্তাহে জন্ম গ্রহণ করেছে, বিলিরুবিন কী পরিমাণে বাড়ছে তার ওপর চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা নির্ভর করে। ফটোথেরাপি হল এক ধরনের বেগুনি আলোর মধ্যে, হালকা গরম আবহাওয়ায় শিশুটিকে কিছু সময়ের জন্য রাখা। বেশির ভাগ শিশু এক থেকে দুই দিন ফটোথেরাপি পেলেই ভালো হয়ে যায়। তবে নবজাতকের বিলিরুবিন যদি অতিমাত্রায় বাড়তে থাকে, তবে হাসপাতালে চিকিৎসা করানো উচিত। এ সময় শিশুকে রক্ত দেওয়ারও প্রয়োজন হতে পারে।

কখন সতর্ক হবেন?


স্বাভাবিক জন্ডিস সাত দিনের মধ্যেই সেরে ওঠার কথা। এর পরও কিছু ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরি। জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই জন্ডিস দেখা দিলে, সাত বা দশ দিনের পরও না সারলে, শিশু খাওয়া বন্ধ করে দিলে বা কমিয়ে দিলে, জ্বর বা সংক্রমণের লক্ষণ থাকলে, বিলিরুবিনের মাত্রা দ্রুত বাড়তে থাকলে বা আগের শিশু জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে থাকলে অবশ্যই শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করুন। শিশুরোগ বিভাগ, বারডেম হাসপাতাল।

জন্ডিসকে অনেকে গুরুত্ব দেন না। টোটকা বা মামুলি কবিরাজি চিকিৎসা করান। কিন্তু চিকিৎসক হিসেবে কারও জন্ডিস হলে আমরা একটু চিন্তিতই হই। জন্ডিস যে ধরনের বা যে কারণেই হোক, এটি সব সময়ই একটি গুরুতর উপসর্গ।

রোগ প্রতিরোধ


হেপাটাইটিস ‘এ’ ভাইরাসের প্রতিরোধে জন্য শিশুকে টিকা দেয়া নিরাপদ। এক বছরে ঊর্ধ্বে যে কোনো শিশুকে মাংসপেশিতে এ টিকা দেওয়া যায়। প্রথম টিকার ছয় মাস থেকে এক বছর পর দ্বিতীয় টিকা নিতে হয়। তবে আমাদের জোর দিতে হবে হেপাটাইটিসসহ অন্যান্য পানিবাহিত রোগ প্রতিরোধের দিকে। পাশাপাশি সমাজে প্রচলিত কিছু কুসংস্কার দূর করা জরুরি।

 রাস্তার পাশে থাকা আচার, ফুচকা, চটপটি, হোটেলের অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে তৈরি খাবার এসব জীবাণুর বড় উৎস। এসব অনিরাপদ খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।

 মলত্যাগের পর, রান্নার আগে হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। সবজি, থালাবাসন ধোয়ার সময় পরিষ্কার, জীবাণুমুক্ত পানি ব্যবহার করতে হবে। ফোটানো বা ফিল্টার করা নিরাপদ পানি পান করতে হবে। 

 আমাদের দেশে রেস্টুরেন্ট, মার্কেটে তথাকথিত ‘ফিল্টার করা পানি’ গ্লাসে পরিবেশন করা হয়, যেগুলো ভাইরাসের বিরুদ্ধে তেমন কার্যকর নয়।

 জন্ডিস প্রকাশের সাত দিন পর্যন্ত রোগী মলের মাধ্যমে ভাইরাস ছড়াতে পারে। তাই এ সময় শিশু স্কুলে যেতে পারবে না এবং বড় রোগীরা খাবার তৈরির কাজ করবে না। শিশুদের ডায়াপার পরিবর্তন এবং শুচি করার পর অবশ্যই সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হবে।

 ডাবের পানি, আখের রস জন্ডিস কমাতে কোনো সাহায্য করে না। বরং রাস্তার আখের রস ভাইরাসের উৎস হতে পারে। স্বাস্থ্যকর তরল খেতে হবে তবে অতিরিক্ত পরিমানে নয়।

 তরকারির হলুদের সঙ্গে শরীর হলুদ হওয়ার সম্পর্ক নেই। তবে এ সময় গুরুপাকের, ভাজাপোড়া খাবার খাওয়া যাবে না।

 কবিরাজি চিকিৎসা যেমন—মাথা ধোয়ানো, বনাজি বা ঝারানো শুধু অপচিকিৎসাই নয়, প্রতারণা। ভুল ওষুধ বা চিকিৎসা যকৃতের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে।

শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. নাঈমা সুলতানা বলেন, জন্ডিস নিজে কোনো রোগ নয় বরং অন্য কোনো রোগের লক্ষণ। ভাইরাস সংক্রমণ থেকে শুরু করে সিরোসিস বা ক্যানসারের মতো রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে দেখা দিতে পারে এই জন্ডিস। মানুষের রক্তে অনেক উপাদানের মধ্যে বিলিরুবিন একটি। এটির উৎপত্তি রক্তের লোহিত কণিকা থেকে। রক্তের লোহিত কণিকা স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিকভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে লিভারে বিলিরুবিন তৈরি হয় এবং পরবর্তী সময়ে রক্তে প্রবাহিত হয়ে মল ও প্রস্রাবের সঙ্গে বের হয়ে যায়।


তিনি বলেন, বিলিরুবিনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হলে এটি জমা হতে থাকে শরীরের বিভিন্ন কোষকলায়। আর তখন কোষকলার স্বাভাবিক রং পরিবর্তন হয়ে হলুদাভ হয়ে যায়। ত্বক ও চোখের ঝিল্লি হলুদ রং ধারণ করলে তা দৃশ্যমান হয় এবং জন্ডিস হয়েছে বলে শনাক্ত করা হয়।


তিনি আরও বলেন, শিশুর জন্মের ১৪ দিনের দিনের বেশি এই জন্ডিস থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে সঠিক চিকিৎসা নিতে হবে। শিশুর জন্মের দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিন জন্ডিস হয়, ওজন আড়াই কেজি হয় এবং শিশু মাতৃগর্ভে ৩৭ সপ্তাহ পর্যন্ত থাকে, এ জন্ডিস নিয়ে আমরা চিন্তিত হব না। এটি ৮-১০ দিনের মধ্যেই চলে যায়। এ ধরনের জন্ডিসকে আমরা বলি ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস, এক্ষেত্রে দুশ্চিন্তা করার কোনো কারণ নেই।

Views: 10

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন