ইফতেখার ইসলাম: একটা সময় ছিলো যখন বাংলাদেশের কথা বলা হলেই মনে চোখের সামনে ভেসে আসতো জরাজীর্ণ ঘরবাড়ি, অনুন্নত অবকাঠামো। তবে এখন সময় পাল্টেছে। পরিবর্তীত পৃথিবীর সাথে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন হয়েছে এদেশের অবকাঠামো। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পর এবার দুয়ার খুলছে বঙ্গবন্ধু টানেলের। এর মাধ্যমে টানেলের যুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। আবার এত এত উন্নয়নের ফলেও যে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি খুব একটা পাল্টেছে—সে বিষয়ে আছে দ্বিমত। তবে এসব উন্নয়নকে পজেটিভভাবেই নিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।
জানা গেছে, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত টানেল উদ্বোধন ঘিরে চট্টগ্রামে সাজ সাজ রব। শনিবার (২৮ অক্টোবর) উদ্বোধনের সব প্রস্ততি শেষ। দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম এই টানেলে দুই ও তিন চাকার যান চলাচল এবং পায়ে হেঁটে প্রবেশ নিষিদ্ধ। টানেল ঘিরে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এবং আনোয়ারা দুই প্রান্তেই সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। রং তুলির আচড় আর আলোকছটায় পাল্টে গেছে পুরো এলাকার দৃশ্যপট। দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর তলদেশে টানেল এই প্রথম, ফলে সাধারণ মানুষের আগ্রহ এবং উৎসাহ উদ্দীপনারও শেষ নেই। উদ্বোধনের আগেই দুই প্রান্তে ভিড় করছেন অনেকে।
প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশিদ চৌধুরী বলেন, মোটরসাইকেল বা পায়ে হেঁটে এই টানেল দিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সেখানে নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকবে জোরালো। কারণ এটি পানির নিচের একটি প্রকল্প। বিষয়টি জনগণকে অনুধাবন করতে হবে।
আগ্নেয়াস্ত্র কিংবা বিস্ফোরক দ্রব্য বহন বন্ধে টানেলের উভয় প্রান্তে বসেছে একাধিক স্ক্যানার। দুর্ঘটনা কিংবা বৈদ্যুতিক সমস্যা সম্পর্কিত নিরাপত্তা মহড়া হয়েছে একাধিকবার। প্রকল্প পরিচালক জানান, বিস্ফোরক দ্রব্য আছে এমন সন্দেহ হলে সাথে সাথে সেই গাড়িটিকে তল্লাশি করা হবে। তাছাড়া লোডশেডিং যদি হয়, তাহলে জেনারেটর চালু করতে যে সময়টুকু লাগবে, সেই সময়ের মধ্যে ইউপিএস থাকবে। ফলে কোনোভাবে অন্ধকার হওয়ার সুযোগ নেই।
বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, প্রতিদিন ১৭ হাজার ২৬০টি যানবাহন টানেলটি ব্যবহার করতে পারবে যা বছরে প্রায় ৭.৬ মিলিয়ন যানবাহনের সমান। টানেলটি দেশের বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি ০.১৬৬ শতাংশ বাড়াতে সাহায্য করবে। টানেলটি চট্টগ্রাম শহর, সমুদ্রবন্দর এবং বিমানবন্দরের দূরত্বও কমিয়ে দেবে। কারণ এটি অর্থনীতিকে আরও প্রাণবন্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, বাংলাদেশ পানির নিচের সড়ক সুড়ঙ্গের যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে যা অবশ্যই সমগ্র জাতির জন্য গর্বের পাশাপাশি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে ব্যাপক সুবিধা দেবে। টানেলটি এই অঞ্চলে শিল্পায়নকে বাড়িয়ে তুলবে। কারণ চট্টগ্রাম-কেইপিজেড-এর আনোয়ারায় দুটি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল এবং হালিশহরে চট্টগ্রাম ইপিজেড- এবং আনোয়ারাতে চাইনিজ ইকোনমিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন (সিইআইজেড) এই টানেলের জন্য অত্যন্ত সুবিধাপ্রাপ্ত হবে। এটি প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়েকে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সাথে ৪০ কিলোমিটার দূরত্ব কমিয়ে সংযুক্ত করবে। কক্সবাজারে চলমান এবং পরিকল্পিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি হাবকেও সুবিধা দেবে, যা ইতিমধ্যেই দেশের একটি পর্যটন কেন্দ্র। এভাবে পদ্মা সেতুর মতো এই টানেল দেশের জিডিপিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে জানান এফবিসিসিআই সভাপতি।
তিনি বলেন, টানেল ছাড়াও ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ এবং কর্ণফুলী নদীর তীরে পরিকল্পিত শিল্পায়নকে স্মার্ট সিটিতে পরিণত করার জন্য একটি মাস্টার প্ল্যান করা গেলে তা দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত উপকারী হবে। পাশাপাশি এটি মিজোরাম ও মণিপুরসহ ভারতের ‘সেভেন সিস্টারস’-এর সাথে বাংলাদেশের যোগাযোগ বাড়াতে এবং এই অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি পর্যটনের প্রসার ঘটাতে পারে।
প্রকল্পের বিবরণ অনুযায়ী, পুরো রুটের দৈর্ঘ্য হল ৯.৩৯ কিলোমিটার (৫.৮৩ মাইল), টানেলটি ৩.৩২ কিলোমিটার (২.০৬ মাইল) দৈর্ঘ্য তৈরি করে এবং এর ব্যাস ১০.৮০ মিটার (৩৫.৪ ফুট)। এটি ১০,৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে এবং এর প্রায় অর্ধেক চীনের এক্সিম ব্যাংক অর্থায়ন করেছে। এতে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক নেটওয়ার্ক উন্নত হবে। চীনের একটি কোম্পানি চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এটি নির্মাণ করেছে।
বঙ্গবন্ধু টানেলে গাড়ির টোল: টানেলের রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায়ের দায়িত্ব পেয়েছে চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি)। প্রস্তাবনা অনুযায়ী, টানেলের ভেতর দিয়ে যেতে প্রাইভেট কার, জিপ ও পিকআপের জন্য দিতে হবে ২০০ টাকা, মাইক্রোবাসের জন্য দিতে হবে ২৫০ টাকা। ৩১ বা তার চেয়ে কম আসনের বাসের জন্য ৩০০ টাকা এবং ৩২ বা তার চেয়ে বেশি আসনের বাসের জন্য ৪০০ টাকা টোল দিতে হবে। ৫ টনের ট্রাক ৪০০ টাকা, ৫ থেকে ৮ টনের ট্রাকের জন্য ৫০০ টাকা, ৮ থেকে ১১ টনের ট্রাক ৬০০ টাকা, ট্রাক (তিন এক্সেল) ৮০০ টাকা, ট্রেইলর (চার এক্সেল) ১ হাজার টাকা এবং চার এক্সেলের বেশি ট্রেইলরের জন্য ১ হাজার টাকার সঙ্গে প্রতি এক্সেলের জন্য ২০০ টাকা বাড়তি টোল দিতে হবে। টানেলের দুই টিউবের চার লেন দিয়ে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চলাচল করতে পারবে। এতে কর্ণফুলী নদী পাড়ি দিতে ৩ থেকে ৪ মিনিট সময় লাগবে।
বঙ্গবন্ধু টানেলে পরীক্ষামূলক পারাপার: চট্টগ্রাম অফিস থেকে সৈয়দ আব্দুল ওয়াজেদ জানান, চট্টগ্রামে খরস্রোতা কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ গতকাল বৃহস্পতিবার অতিক্রম করেছে বিশাল গাড়ির বহর। পরীক্ষামূলক এই পারাপার শেষে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নদীর তলদেশ দিয়ে প্রথম নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেল এখন উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত। দুপুরে টানেল অতিক্রমকালে গাড়িবহরের তিনটি কোস্টারে ছিলেন দেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রোনিক সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকগণ। পুরোভাগে ছিলেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দ। গাড়িবহরে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স এবং টানেল সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাগণ। কর্মকর্তারা জানান, এটি ছিল টানেল উদ্বোধনের আগে চূড়ান্ত পরিদর্শন। গাড়িবহর দুপুরে বঙ্গবন্ধু টানেলের পতেঙ্গা প্রান্ত থেকে রওনা হয়ে আনোয়ারা প্রান্তে যায়। সেখানে প্রেস ব্রিফিং শেষে শনিবার অনুষ্ঠেয় কোরিয়া ইপিজেড মাঠের জনসভার প্রস্তুতি পরিদর্শন করেন কর্মকর্তারা।
বঙ্গবন্ধু টানেলের উদ্বোধন ঘিরে উৎসবের আমেজ: উৎসবের আমেজ কর্ণফুলীর দুই প্রান্তে। প্রধানমন্ত্রীর সফরকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে এখন সাজসাজ রূপ। জনসভাকে জনসমুদ্রে পরিণত করতে চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। আনোয়ারার জনসভার মাঠকে ঘিরে বর্ণীল তোরণ, ব্যানার, ফেস্টুন ও বিলবোর্ডে ছেয়ে গেছে পুরো চট্টগ্রাম। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে চলছে ডিজিটাল প্রচার। দলীয় প্রধানের জনসভায় নিজেদের পক্ষে শোডাউনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন নেতারা।
এদিকে টানেলকে ঘিরে উৎসবের আমেজ কর্ণফুলীর দুই প্রান্তে। সেখানে দুই দিনের উৎসব চলছে। গত কয়েক দিন সন্ধ্যায় পতেঙ্গা প্রান্তে কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়। পতেঙ্গা প্রান্ত এবং আনোয়ারা প্রান্তের সড়ক ও সড়কদ্বীপ সাজানো হয়েছে বর্ণিল সাজে। রাতে বর্ণিল আলোয় ঝলমল করছে কর্ণফুলীর দুই পাড়।
প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ১৪ অক্টোবর, ২০১৭ তারিখে কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা টানেল বোরিং ফেজও উদ্বোধন করেন। মাল্টিলেন টানেল রুটটি একদিকে নেভি কলেজ এবং অন্যদিকে কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (কেইপিজেড) এবং কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি (কাফকো) এর কাছাকাছি নদীর মধ্য দিয়ে গেছে। এতে কর্ণফুলী নদীর ওপর দুটি সেতুর যানজটও কমবে।
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন