ইফতেখার ইসলাম: শীতকাল মানে বাঙালির ঘরে ঘরে পিঠা-পুলির উৎসব। যদিও সারা বছর পিঠা খেতে পছন্দ করেন বাঙালিরা। তবুও শীতকালে পিঠা উপভোগের মজাটা একটু আলাদা। তবে আজকাল রান্নার কাজ গ্যাস নির্ভর হয়ে যাওয়ার পিঠার স্বাদ আগের মতো পাওয়া যায় না। তবুও শীতকালে পিঠা খুবই সুস্বাদু হয়ে থাকে। চলুন আজকে আমরা জানবো মজাদার ১০ শীতে পিঠা ও প্রস্তুত প্রণালী সম্পর্কে।
১.খোলাপিঠা
শেষ রাতে শীত আরো খানিক ঝেঁকে বসলে ঘুমটাও খানিক গাঢ় হয়। সকালে ঘুম ভাঙ্গে রান্না ঘর থেকে ভেসে আসা আহ্বানে ‘পিঠা খেতে এসো’। চোখ মুছতে মুছতে চুলার পাশে গিয়ে দেখা হয় মাটির খোলায় খোলাজা (খোলাজালি) পিঠা। হেমন্তের শেষে শীতের আগমনে এমন আবহ বিরাজ করে গ্রামে গ্রামে।
এখন সময় পাল্টেছে, পরিবর্তন হয়েছে মানুষের জীবনধারা। যান্ত্রিকতার জীবনে কারণে শহুরে মানুষ এতটাই ব্যস্ত যে এই নেওয়ার সৌভাগ্যেটুকু আর হয়ে ওঠে না। অনেকটা পাটিসাপটার মতো দেখতে এই পিঠা খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনি হেলদি ব্রেকফাস্টও বটে। সকালের নাস্তা হিসেবে এই পিঠা খেয়ে থাকলেও অনেকে এখন কুয়াশা মোড়ানো বিকেলেও এই খাবার পছন্দ করেন।
উপকরণ: চালের গুঁড়া ৩ কাপ ; লবণ স্বাদমতো ; ডিম ৩-৪টি ; কুসুম গরম পানি।
যেভাবে বানাবেন: চালের গুঁড়ার সঙ্গে লবণ ও পানি মিশিয়ে হাত দিয়ে ভালোভাবে মেখে নিন। একবারে বেশি পানি দেওয়া যাবে না। ভালোভাবে মাখানোর পর যখন নরম ঘন একটা বেটার তৈরি হবে, তখন তাতে দিয়ে দিতে হবে আগে থেকে ফেটিয়ে রাখা ডিম।
আবারও ভালোভাবে মেখে ডিম পুরোপুরি মিশে গেলে যদি পানির প্রয়োজন হয় তাহলে আবারও কিছুটা পানি দিয়ে নেড়ে মিশিয়ে বেটার তৈরি করে ঢেকে রাখতে হবে ১-২ ঘণ্টা।
শুকনো চালের গুঁড়া হলে একটু বেশি সময় ভিজিয়ে রাখতে হবে। এই বেটার অনেকটা পোয়া বা পাটিসাপটা পিঠার বেটারের চেয়ে কিছুটা পাতলা হবে। বেটারের ঘনত্ব দেখে বুঝে নিতে হবে।
এই পিঠা মাটির পাতিল বা ননস্টিক প্যানে তৈরি করতে হবে। এজন্য চুলায় প্যান গরম করে তাতে ১ চামচ পরিমাণ (ডালের চামচের মাপে) দিয়ে প্যান ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বেটারটা ছড়িয়ে দিতে হবে।
চামচ বা কাপ দিয়ে মেপে নিলে সবগুলো পিঠার সাইজ একই হবে ও দেখতে সুন্দর লাগবে। পিঠা যখন চারপাশ থেকেই উঠে আসবে তখনই বুঝতে হবে পিঠা হয়ে গেছে।
তখনই প্যান থেকে উঠিয়ে নিতে হবে। তাহলেই তৈরি হয়ে যাবে খোলা জালি পিঠা।
প্যানে বেটার দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এই পিঠা হয়ে যায়।
প্রতিটি পিঠার বেটার প্যানে দেওয়ার আগে চামচ দিয়ে ভালোভাবে বেটারটা নেড়ে তারপর চামচ দিয়ে উঠিয়ে প্যানে দিতে হবে। এই পিঠা চালের গুঁড়া দিয়েই করতে হবে। আটা বা ময়দা দিয়ে করা যাবে না।
শুকনো ও বেশি পুরোনো চালের গুঁড়া হলে একটু বেশি পানি লাগবে। ভেজা চালের গুঁড়া হলে একটু কম পানি লাগবে। ডিম ছোট বড় হলেও পানির মাপ কম বেশি হবে। তাই পানিটা একটু দেখে বুঝে দিতে হবে।
২. পাটিসাপটা
পাটিসাপটা পিঠার জন্য প্রথমে ক্ষীরসা বানাতে হয়। এজন্য প্রয়োজন ১ লিটার দুধ, খেজুরের গুড় কিংবা চিনি পরিমাণমতো, ২ চামচ সুজি,নারিকেল বাটা বা কুড়ানো ৩ থেকে ৪ চামচ।
যেভাবে বানাবেন: একটি কড়াই বা প্যানে দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করতে হবে। এরপর সুজি, খেজুরের গুড় বা চিনি, নারিকেল বাটা বা কুড়ানো একসঙ্গে দিয়ে ঘন ঘন নাড়তে হবে।ক্ষীরসা অনেক ঘন হয়ে গেলে নামিয়ে রাখতে হবে।
এবার চালের গুড়া বা আটা নিয়ে তাতে ময়দা মেশান। এরপর গরম পানি দিয়ে খুব ভালভাবে মেশান। গোলা যেন খুব পাতলা বা ভারী না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখুন। এখন একটি ফ্রাইপ্যানে তেল দিন। তেল গরম হওয়ার পর তাতে আটার মিশ্রণ দিন পরিমাণ মত,রুটির আকৃতি তৈরি করুন।
এবার রুটিতে আগে থেকে তৈরি করে রাখা ক্ষীরসা দিন। চামচ কিংবা হাতের সাহায্যে পুরো রুটিতে ক্ষীরসা মিশিয়ে নিন। তারপর একই রকম সাইজে মোড়াতে থাকুন।ব্যস, তৈরি হয়ে গেল মজাদার পাটিসাপটা পিঠা।
৩. ভাপা পিঠা
শীতের পিঠা গুলোর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত পিঠ ভাপা পিঠা। এই পিঠার সাথে শীতের এক দারুন মেলবন্ধন রয়েছে। শীত মানেই ভাপা পিঠা। শীতের সকালে গাছ থেকে নামিয়ে আনা টাটকা রসের সাথে ভাপা পিঠা যেন অমৃত।
উপকরণ: চালের গুঁড়া ১ কেজি, নারিকেল ১ টা (কোরানো), গুড় কুচানো (২৫০ গ্রাম), সামান্য, পানি পরিমাণ মতো।
যেভাবে বানাবেন: একটি পাত্রে চালের গুঁড়া, লবণ ও অল্প অল্প করে পানি দিয়ে ভালোভাবে মাখিয়ে নিন। মিশ্রণটি যেন ঝরঝরে থাকে সেটা খেয়াল রাখুন। এবার এই চালের গুঁড়া চালনিতে হাত দিয়ে ঘষে ঘষে চালতে হবে। কোরানো নারিকেলের অর্ধেকটা চেলে নেওয়া চালের গুঁড়ার সঙ্গে মাখতে হবে। এবার হাঁড়ির অর্ধেকটা পানিতে ভরে জ্বাল দিয়ে পানি ফুটে ভাপ ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
এখন পিঠার জন্য ছোট বাটি নিন। বাড়িতে থাকা স্টিলের ছোট বাটি কিংবা দোকান থেকে কেনা মাটির পাত্রও ব্যবহার করতে পারেন। এবার বাটিতে এক ফোটা তেল মেখে কিছু মাখানো চালের গুঁড়া দিয়ে তার ওপর গুঁড় ছিটিয়ে দিন। এখন তার ওপর আবার চালের গুঁড়া দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। আলতো হাতে চেপে সমান করে ভাপা পিঠার আকার তৈরি করে নিতে হবে। বাটিটা ভেজা পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে গরম পানির হাঁড়ির উপর উপুড় করে বসিয়ে দিতে হবে।
এবার বাটিটা আস্তে করে সরিয়ে নিতে হবে। খেয়াল করতে হবে যেন পিঠা ভেঙ্গে না যায়। ৫ থেকে ৭ মিনিট ভাপে সেদ্ধ হলে ঢাকনা সরিয়ে দেখে নিন পিঠা নরম হয়েছে কিনা। নরম হলে নামিয়ে নিন।
৪. দুধ চিতই পিঠা
প্রত্যেকের ঘরে ঘরে এখনো তৈরি হচ্ছে বাহারি রকমের পিঠা। পিঠা আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী খাবার। বাংলাদেশে সারা বছর বিভিন্ন ধরনের পিঠা তৈরি হয়ে থাকে। তেমনই একটি পিঠার নাম দুধ চিতই পিঠা। এটা ছোট-বড় অনেকেরই পছন্দের পিঠা।
উপকরণ: চালের গুঁড়া ২ কাপ, ময়দা আধা কাপ, আখের গুড় ১ কাপ, চিনি আধা কাপ, ঘন দুধ ২ লিটার, লবণ সামান্য।
প্রস্তুত প্রণালি: প্রথমে গুড়, চিনি এবং দুধ দিয়ে ভালো করে জ্বাল দিয়ে ঘন করতে হবে। এরপর চালের গুঁড়ার সঙ্গে লবণ ও পরিমাণমতো পানি মিশিয়ে মোটামুটি পাতলা ডো তৈরি করে কিছুক্ষণ রাখতে হবে। এরপর পিঠার ডো দিয়ে একটা একটা করে পিঠা তৈরি করতে হবে। পিঠা তৈরি হয়ে গেলে দুধের মিশ্রণে ভিজিয়ে চুলায় দিয়ে কিছুক্ষণ জ্বাল দিতে হবে। এরপর ঠান্ডা করতে হবে। সারারাত রেখে দিলে পিঠা নরম তুলতুলে হবে।
৫.নকশি পিঠা
নকশা করা পিঠা, এক প্রকার লোকশিল্প। এটি মেয়েলি শিল্প নামেও পরিচিত। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরাঞ্চলে নানা ধরনের পিঠা তৈরি হয়। নকশি পিঠা তার অন্যতম। পিঠার গায়ে যখন বিভিন্ন ধরনের নকশা অাঁকা হয় অথবা ছাঁচে ফেলে পিঠাকে চিত্রিত করা হয় তখন তাকে বলা হয় নকশি পিঠা।
উপকরণ: চালের গুঁড়া: ৪ কাপ; পানি: ৩ কাপ; লবণ: সামান্য; ঘি: ১ টেবিল চামচ; তেল: ভাজার জন্য।
সিরা তৈরি করতে যা লাগবে: গুড়: ১ কাপ; চিনি: ১ কাপ; পানি: ২ কাপ।
যেভাবে বানাবেন: পানির সঙ্গে লবণ ও ঘি মিশিয়ে চুলায় বসান। ফুটে উঠলে তাতে চালের গুঁড়া মিশিয়ে সেদ্ধ করুন। পিঠার ডো নামিয়ে ঠান্ডা করে ভালোভাবে মথে নিন। এবার আধা ইঞ্চি পুরু করে রুটি বানিয়ে পছন্দমতো আকার দিয়ে কেটে নিন। খেজুর কাঁটা দিয়ে রুটিতে পছন্দমতো নকশা করুন। এরপর ডুবোতেলে ভেজে নিন। কিছুক্ষণ পর আবার তেলে ভেজে সিরায় দিয়ে ১ মিনিট রেখে তুলে নিন। এই পিঠা কয়েকদিন সংরক্ষণ করেও খাওয়া যায়।
৬. আলু পাকোন পিঠা
শীতের বিভিন্ন পিঠার মধ্যে আলু পাকোন পিঠার স্বাদই আলাদা। সকালের নাস্তার রেসিপিতে রাখতে পারেন আলু পাকোন পিঠা। আসুন জেনে নিই কীভাবে তৈরি করবেন আলু পাকোন পিঠা।
উপকরণ—ময়দা: ২ কাপ; তরল দুধ: ২ কাপ; গুঁড়া দুধ: সিকি কাপ; ঘি (ময়দার ডোর জন্য): ১ টেবিল চামচ; ঘি (ময়দা মাখানোর জন্য): ২ টেবিল চামচ; সয়াবিন তেল: প্রয়োজনমতো; চিনি (সিরার জন্য): ২ কাপ; পানি: ৩ কাপ; এলাচ ও দারুচিনি: ২টি; লেবুর রস: ১ চা-চামচ; আলু সিদ্ধ: আধাকাপ; লবণ: ১ চিমটি।
প্রণালি: দুধ চুলায় দিয়ে যখন ফুটে উঠবে, তখন গুঁড়ো দুধ ও ঘি দিয়ে নেড়ে ময়দা দিন। ময়দা ভালোভাবে নেড়ে সিদ্ধ করে মোলায়েম ডো বানাতে হবে। আলু সিদ্ধ গ্রেট করে মিহিভাবে ভর্তা করে নিতে হবে। এবার ময়দার ডো ভালোভাবে ময়ান দিয়ে আবার আলু দিয়ে ময়ান দিতে হবে। এই ময়ানের সময় হাতে ঘি মেখে নিতে হবে। এতে মোলায়েম ডো হবে। ২ কাপ চিনি ও ১ কাপ পানি জ্বাল দিয়ে ১ টেবিল চামচ লেবুর রস দিয়ে ময়দা কেটে নিন। ২টি এলাচ ও ১ টুকরা দারুচিনি দিয়ে রস জ্বাল দিয়ে নামিয়ে ঠাণ্ডা করে রাখুন। এবার ময়দার ডো দিয়ে মোটা রুটি বানিয়ে ছাঁচ দিয়ে কেটে নিন। এখন গরম তেলে বাদামি করে ভেজে ঠাণ্ডা সিরায় চোবান। ১০ মিনিট পর পিঠা যখন সিরার কারণে দ্বিগুণ আকারের হয়ে যাবে। ব্যাস হয়ে গেলো মজাদার আলু পাকোন। এবার পিঠাগুলো সিরা থেকে তুলে প্লেটে সাজিয়ে নিন। অল্প সিরা ছড়িয়ে দিয়ে পরিবেশন করুন।
৭. বিবিখানা পিঠা
শীতে খেজুরের রসে তৈরি হয় নানা ধরনের পিঠা। খেজুরের রসের তৈরি বিবিখানা পিঠাও তার মধ্যে একটি। চালের গুঁড়া, খেজুরের ঘন রস, ডিম, লবণ সামান্য, দুধ ও ঘি দিয়ে তৈরি করা হয় মজার স্বাদের এ পিঠা।
তৈরি করতে যা লাগবে: চালের গুঁড়া- ২ কাপ; ঘি- আধা কাপ; গুঁড়া দুধ- ১ কাপ; গুড়- ২ কাপ; ডিম- ৩টি; নারিকেল কোরানো- অর্ধেক; এলাচ গুঁড়া- আধা চা চামচ; পানি- ১ কাপ।
যেভাবে তৈরি করবেন: চালের গুঁড়া শুকনো খোলায় হালকা ভেজে নিতে হবে। গুড় পানিতে জ্বাল দিয়ে নিতে হবে। এরপর গুঁড়া দুধ ও ডিম ভালো করে মিশিয়ে নিন। এবার তার সঙ্গে মেশান চালের গুঁড়া ও নারিকেল। এবার কেক তৈরির মোল্ডে ঘি ব্রাশ করে খামির ঢেলে ১৮০ ডিগ্রিতে এক ঘণ্টা বেক করতে হবে। ওভেন না থাকলে চুলায়ও তৈরি করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে একটি মোটা তলার সসপ্যানে প্রথমে স্ট্যান্ড বসাতে হবে। এরপর তার উপরে পিঠার মোল্ডটি বসিয়ে দিয়ে হাঁড়িটি ঢেকে দিতে হবে। চুলার আঁচ কমিয়ে রাখতে হবে। এভাবে এক ঘণ্টা রেখে পিঠা চেক করে দেখতে হবে। একটি কাঠি বা টুথপিক গেঁথে দেখুন। কাঠি পরিষ্কার উঠে এলে বুঝতে হবে পিঠা তৈরি। না হলে আরও মিনিট দশেক চুলায় রাখতে হবে।
৮. তেলেভাজা বা তেলের পিঠা
অনেকেই পাকান পিঠা, তেলেভাজা পিঠা, পুয়া পিঠা, মালপোয়া পিঠা, তেলের পিঠা ইত্যাদি নাম ডাকেন। নাম যাই হোক বেশিরভাগ মানুষের পছন্দের তালিকায় এই পিঠাটি থাকে।
বানানো অন্যান্য সব পিঠার থেকে সহজ। কিন্তু সমস্যা হলো মাঝে মাঝে কেন যেন কিছুতেই এই পিঠা ফুলে না আর গপাগপ তেল শুষে নেয়। মোটামুটি তেলের শ্রাদ্ধ হয়ে যায়। তারপরও মনখারাপ তো থাকেই।
উপকরণ: ১ কাপ বাসমতী চাল ( বা যে কোনো আতপ চাল ); ১/২ কাপ সাধারণ ভাতের চাল; ১/২ কাপ বা (আন্দাজ মত) পানি; স্বাদ অনুযায়ী চিনি ও গুড়; ১ টেবিল চামচ ময়দা; ১ চিমটি লবন; ভাজার জন্য তেল
প্রস্তুত প্রণালী: চাল ২/৩ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রেখে পানি ঝড়িয়ে ব্লেন্ডারে গুড়া করে নিন। তারপর একবার চালনি দিয়ে চেলে সুজি আলাদা করে সুজিটা আবার গুড়া করে নিন। তবে ঘরে চালের গুড়া থাকলে আর এতো ঝামেলা করা লাগবে না। চালের গুড়াটাই উষ্ণ গরম পানিতে ঘন্টা খানেক নরম করে মাখিয়ে রাখুন। এতে পিঠা ফুলবে ভালো।
ভিজিয়ে রাখা চাল আন্দাজ মতো পানি দিয়ে ব্লেন্ডারে ঘন পেস্টের মতো করে নেই। তবে পেস্টটা একদম মিহি হতে হবে। তারপর এতে চিনি+গুড়, লবন, ময়দা ও পানি দিয়ে মাঝারি ঘন গোলা বানিয়ে নিতে হবে।
চিনি দিলে চিনি থেকে পানি বের হয়ে এমনিতেই গোলাটা অনেক পাতলা হবে। তাই পানি দেয়ার সময় অল্প অল্প করে দিবেন একবারে ঢেলে দিবেন না। পানির পরিমানটা নির্দিষ্ট করে বলছি না, তবে আপনাকে গোলাটা বানাতে হবে মাঝারি ঘন করে কেকের ব্যাটার থেকে কিছুটা পাতলা।
এবার ভাজার পালা। প্রথমেই কড়াই বা ফ্রাই প্যান এ সেই পরিমান তেল ঢালুন যাতে একটা পিঠা ডুবে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ছোট দেখে কড়াই বা ফ্রাই প্যান নিন তাহলে তেল কম ঢাললেও হবে। তেলটাকে বেশ ভালোমতো গরম করে নিতে হবে।
গরম তেলে ডালের চামচে করে একচামচ গোলা ছাড়ুন। কিছুক্ষনের মধ্যেই তা ফুলে উঠবে, তারপর উল্টে দিন। আঁচ বাড়তি রাখতে হবে, আঁচ কমালে কিন্তু পিঠা ভালো ফুলবে না। দুইপাশ সোনালী করে ভেজে তেল থেকে উঠিয়ে কিচেন পেপারে রেখে বাড়তি তেল ঝরিয়ে নিন।
৯. ঝিনুক পিঠা
কেউ বলে ঝিনুক পিঠা কেউবা বলে খেজুর পিঠা। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, খেতে ভীষণ সুস্বাদু এই পিঠাটি অনেকেরই প্রিয়। কিন্তু রেসিপি জানেন না বলে বানানো হয়ে ওঠে না। চলুন তবে আজ জেনে নেই ঝিনুক পিঠা তৈরির সহজ রেসিপি-
উপকরণঃ আটা বা ময়দা পরিমাণ মতো, চিনি, নারিকেল কোরানো, সয়াবিনের তেল, এলাচ ও দারুচিনি, একটি তালপাখা।
যেভাবে বানাবেন: প্রথমে একটি পাত্রে পরিমাণ মতো আটা বা ময়দার মধ্যে চিনি ও খুব অল্প পরিমাণ কোরানো নারিকেল দিয়ে পানি গরম করে সিদ্ধ করে নিন। তারপর সিদ্ধ করা ময়দা ঠাণ্ডা করে হাত দিয়ে ভালোভাবে পেস্ট করে ছোট ছোট লম্বা টুকরো করে রাখুন।
এবার তালপাখা ভালো করে ধুয়ে শুকিয়ে নিন। শুকানো হয়ে গেলে সিদ্ধ ময়দার লম্বা করা টুকরাগুলো তালপাখার গোড়ার চিকন দিকে দিয়ে হাত দিয়ে চাপ দিন। দেখবেন পিঠাগুলো দেখতে একদম ঝিনুকের মতো দেখাবে।
অন্য একটি পাত্র পানি, চিনি, এলাচ ও পরিমাণ মতো দারুচিনি নিয়ে হালকা গাঢ় করে চিনির সিরা তৈরি করুন। এবার আর একটি পাত্রে পরিমাণ মতো সয়াবিন তেল দিয়ে চুলায় আঁচ দিতে থাকুন। এবার তালপাখা দিয়ে তৈরি করা পিঠাগুলো ভাজুন।
হালকা বাদামি রং হলে নামিয়ে চিনির সিরার মধ্যে চুবিয়ে অন্য পাত্রে রাখুন।
১০. বকুল পিঠা
বাহারি সব পিঠার মধ্যে একটি হলো বকুল পিঠা। শীতকালে পিঠা খেতে ভালোবাসেন না এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এই শীতের বিকেলে বকুল পিঠা বানিয়ে নিতে পারেন সহজেই।
উপকরণ: কোড়ানো নারিকেল, গরুর দুধ, চিনি, তেজপাতা, দারুচিনি, এলাচ, কিচমিচ, লং ফড়িং ও ময়দা।
প্রণালী: প্রথমে একটা পাত্রে পরিমান মত গরুর দুধ নিন। দুধের মধ্যে দারুচিনি, তেজপাতা, এলাচ, কিচমিচ ও পরিমান মত চিনি দিয়ে সামান্য ঘন করে আঁচ দিন। দুধ ঘন হয়ে আসলে চুলার আঁচ কমিয়ে মৃদু মৃদু তাপে দুধের পাত্রটি চুলার ওপর রেখে দিন বা চুলা থেকে নামিয়েও রাখতে পারেন।
অন্য পাত্রে সামান্য তেল দিয়ে তেলের ওপর দুইটা তেজপাতা, দারুচিনি এলাচ ও লং ফড়িং ছেড়ে দিন। তারপর কোড়ানো নারিকেল ও পরিমান মত চিনি দিয়ে নাড়তে থাকুন। নারিকেল নাড়তে নাড়তে আঠা আঠা হয়ে গেলে চুলা থেকে নামিয়ে ঠান্ডা করুন। আরেকটি পাত্রে পরিমান মত ময়দা ঘন করে গুলিয়ে রাখুন।
তারপর পাত্রে পরিমান মত তেল দিয়ে চুলার আঁচ দিতে থাকুন। এখন জালানো নারিকেল হাত দিয়ে গোল গোল চ্যাপ্টা করে চপ এর মত করে গুলানো ময়দার প্রতিটি নারিকেলের চপ গুলো ময়দার মধ্যে চুবিয়ে তেলে ছেড়ে দিন বাদামী রঙ এ পিট অপিট ভেজে ঘন করা দুধের মধ্যে ছেড়ে দিন। এক ঘন্টা পর দুধের পাত্রের ঢাকনা খুলে দেখবেন পিঠাগুলো দুধে ভিজানোর জন্য ফুলে ফুলে উঠেছে। তৈরী হয়ে গেলো হয়ে গেলো দারুন স্বাদের বকুল পিঠা।
আরও যত পিঠা
বাংলাদেশে কত শত রকমের পিঠা যে তৈরি হয় তার সুনির্দিষ্ট তালিকায়ন করা আজও সম্ভব হয়নি। ধারণা করা হয়, এ দেশে শতাধিক রকমের পিঠা তৈরি হয়। এর প্রায় শতকরা নব্বই ভাগ পিঠা তৈরি হয় শীতকালে। শীতের পিঠার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পিঠাগুলো হলো চিতোই পিঠা, পাকানো পিঠা, পাকোয়ান পিঠা, পক্কন পিঠা, পাটিসাপটা, কুশলি পিঠা, ভাপা পিঠা, ভাত পিঠা, কাটা পিঠা, নকশি পিঠা, পুলি পিঠা, দুধ পিঠা, লাউ পায়েস, ছিট পিঠা, লবঙ্গ পিঠা, গোকুল পিঠা, গড়গড়া পিঠা, ম্যারা পিঠা, মুঠা পিঠা, সিদ্ধ পিঠা, পুতুল পিঠা, লরি পিঠা, চাছি পিঠা, সাগুদানা, ঝুড়িসীতা, তারাজোড়া, জামাই পিঠা, জামদানি পিঠা, হাদি পিঠা, পাটা পিঠা, তেজপাতা পিঠা, তেলেভাজা পিঠা, ঝুরি পিঠা, ফুলঝুরি পিঠা, বিবিয়ানা পিঠা, চষি পিঠা, খান্দেশা, গোলাপফুল পিঠা, পাতা পিঠা, সবুজ পিঠা, কেক পিঠা, গুলগুলা, ফুলকুচি, সেওই পিঠা, লবঙ্গ পিঠা, ক্ষীরডুবি, খাস্তা পিঠা, পেঁপের সন্দেশ, কড়ি পিঠা, সিরিনচ পিঠা, ঝিকমিক পিঠা, পয়সা পিঠা, সংসার পিঠা, শিঙাড়া পিঠা, বিবিখানা পিঠা, চান্দ পাকোড়, ঝালপোয়া পিঠা, মালপোয়া পিঠা, মালভোগ, ক্ষীরকুলি, মালাই পিঠা, নারকেল ভাজা পুলি, নারকেল সিদ্ধ পুলি, নারকেল ঝুরি পিঠা, পাকোন পিঠা, সাজ পিঠা, তেলপোয়া পিঠা, ঝাল পিঠা, বিস্কুট পিঠা, খাস্তা পিঠা, গজা, রুটি পিঠা, দুধ পায়েস, কুলি পিঠা, দুধকুলি পিঠা, জামাই কুলি পিঠা, জামদানি পিঠা, হাঁড়ি পিঠা, চাপড়ি পিঠা, চুটকি পিঠা, রসপুলি, কাটা পিঠা, মুরালি পিঠা, খান্দাশ, পয়সা পিঠা, চুষি পিঠা ইত্যাদি অন্যতম।
একই পিঠার আবার এক এক অঞ্চলে এক এক নাম। এ দেশে শুধু খাওয়ার জন্যই যে পিঠা তৈরি করা হয় তাই নয়। নানা অনুষ্ঠান উপলক্ষেও পিঠা তৈরি করা হয়। যেমন নতুন জামাইকে বরণ করে নেওয়ার জন্য বানানো হয় বিবিয়ানা পিঠা। এ জন্য এ পিঠার আরেক নাম জামাই ভুলানো পিঠা। সব পিঠার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর হলো নকশি পিঠা। গোলাকার, ডিম্বাকার, চৌকা, ত্রিকোণ ইত্যাদি নানা আকারের নকশি পিঠা এ দেশে বানানো হয়। এ দেশে এখন প্রায় সব অঞ্চলেই বানানো হয় ভাপা ও চিতোই পিঠা। চিতোই পিঠা খেজুর রসে ভেজালে হয় রস চিতোই, দুধে ভেজালে হয় দুধ চিতোই। কোথাও কোথাও চিতোই পিঠা কাচিখুচা পিঠা নামেও পরিচিত। এ দুটি পিঠা এখন শহরের মানুষদের কাছেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। শীতকালজুড়ে শহরে রাস্তার ধারে বসে এসব পিঠা বানিয়ে বিক্রি করা হয়। এ জন্য বিদেশিরা এসব পিঠার নাম দিয়েছেন স্ট্রিট কেক। শীতকালে বিভিন্ন শহরে হরেক রকম পিঠার মেলা ও পিঠা উৎসবের আয়োজন করা হয়।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করেও তা সুনির্দিষ্টকরণ করা সম্ভব হয়নি। এ দেশের কয়েকটি এলাকার উল্লেখযোগ্য পিঠার নাম তালিকা ১-এ উল্লেখ করা হলো। ১৯৯১ সালে শিশু একাডেমী প্রাঙ্গণে যে পিঠা মেলা হয়েছিল সেখানে বাংলাদেশের ১০৬ রকম পিঠা প্রদর্শিত হয়েছিল। পিঠা সাধারণত মেহমান এলে, নবান্ন, পৌষসংক্রান্তি, চৈত্রসংক্রান্তি, জামাই খাওয়া, বিয়ে, খৎনা, জামাই চাদরি ইত্যাদিতে বানানো হয়। পিঠা বানানো ও খাওয়া নিয়েও আমাদের সংস্কৃতিতে অনেক প্রচলন আছে। যেমন আদি মুসলিম ঢাকাইয়াদের মধ্যে গর্ভবতীকে সাত মাসে সাধ খাওয়ানো বা সাতশা অনুষ্ঠানের প্রচলন রয়েছে। সেদিন লম্বা ও গোলাকার পাঁচ রকমের পিঠা বানিয়ে গর্ভবতীকে একটা থালায় করে খেতে দেওয়া হয়। চোখ বন্ধ করে গর্ভবতী রমণীকে সেই পিঠা থেকে একটা পিঠা তুলতে বলা হয়। তাদের লোকসংস্কার হলো গর্ভবতী যদি লম্বা পিঠা তোলে তাহলে ছেলে হবে, গোল পিঠা তুললে মেয়ে হবে।
আরও পড়ুন: শীতের মজাদার ৭ পিঠার রেসিপি
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন