ডেস্ক রিপোর্ট: অম্লত্বের ভারসাম্য বজায় রাখা, বরফের স্ফটিক গঠনে প্রতিরোধ সৃষ্টি ও আর্দ্রতা ধরে রাখা; চিনির এ কার্যকারিতা শরবতসহ বিভিন্ন রকমের খাধ্যে মিষ্টি স্বাদ যোগ করে। এছাড়া, চিনির মধ্যে থাকা গ্লুকোজ মানুষের দেহের জন্য দরকারি একটি উপাদান। বিপাকের সময় কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও চর্বি জাতীয় খাবারের অণুগুলো ভেঙে শরীরের প্রয়োজনীয় গ্লুকোজের চাহিদা পূরণ হয়। তাই, আলাদা করে আর গ্লুকোজের দরকার পড়ে না। বরং, এরপরেও খাদ্যে আলাদাভাবে চিনি নেয়া হলে তা স্বাস্থ্যের জন্য উল্টো ক্ষতিকর। এ ক্ষতির কারণ যাচাইয়ের পাশাপাশি চলুন জেনে নেই, কোন খাদ্যগুলো চিনির বিকল্প হিসেবে এ ক্ষতি থেকে দূরে রাখতে পারে।
চিনি কেন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর: মিষ্টি স্বাদযুক্ত খাদ্য খাওয়ার পর খাবারে থাকা চিনি মস্তিষ্কে ডোপামিন হরমোন নিঃসরণকে উদ্দীপিত করে। এতে করে সেই ভাল লাগা স্বাদটি পুনরায় পাওয়ার অনুভূতি সৃষ্টি হয়। এভাবে মিষ্টি খাদ্য খাওয়র পুনরাবৃত্তি থেকে সৃষ্টি হয় আসক্তি। ফলে, শরীরের অভ্যন্তরে চিনির আধিক্যজনিত জটিলতাগুলো দেখা দিতে শুরু করে। এখানে সরাসরি প্রভাবক হিসেবে কাজ করে রক্তে শর্করার ভারসাম্যহীনতা। শুরুটা হয় মেজাজের অস্থিরতা, ব্রণ ওঠা, ক্লান্তি ও প্রদাহের মত বিরক্তিকর উপসর্গ দিয়ে। ধীরে ধীরে প্রচন্ড মাথাব্যথা ও ক্ষুধামন্দার মাধ্যমে দৈনন্দিন শারীরিক অবস্থা আরো বেশি খারাপের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। চরম অবস্থায় ওজন বৃদ্ধি, হৃদরোগ, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, দাঁতের ক্ষয়, ফ্যাটি লিভার, দ্রুত বার্ধক্য ও ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।
চিনির দশটি স্বাস্থ্যকর প্রাকৃতিক বিকল্প:
কাঁচা মধু: শুধুমাত্র প্রাকৃতিগত মিষ্টতার জন্যই নয়, মধু দীর্ঘকাল ধরে তার পুষ্টিগুণের জন্যও ব্যাপকভাবে সমাদৃত। এ ঘন তরল পদার্থটি মধু-মৌমাছি দ্বারা উদ্ভিদের নির্যাস থেকে পরাগায়ন প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়। তাই, স্বাভাবিকভাবেই মধু বেশ কিছু উপকারী উদ্ভিদ যৌগ ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ হয়। কাঁচা বা গাঢ় মধু কদাচিৎ প্রক্রিয়াজাত করা হয় বলে এর ফ্ল্যাভোনয়েড এবং ফেনোলিক অ্যাসিড পুরোটাই পাওয়া যায়। এগুলো রক্ত, হৃদপিন্ড, পরিপাক ও শ্বাসযন্ত্রের স্বাস্থ্যের উপর ইতিবাচক প্রভাব রাখে। এমনকি, এটি মৌসুমী অ্যালার্জি কমাতেও সক্ষম। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ভিটামিন বি এর কারণে ঠান্ডা লাগার প্রতিকার স্বরূপ মধু চায়ের সাথে মিশিয়ে পান করা হয়। মধু-চা একই সাথে ঠান্ডা লাগার প্রতিকার ও মিষ্টি পানীয় হিসেবে জনপ্রিয়। তবে, খেয়াল রাখতে হবে, এ চা পানের পরিমাণ যেন অতিরিক্ত হয়ে না যায়।
খেজুর: ফাইবার, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ভিটামিন বি-৬, ক্যারোটিনয়েড এবং পলিফেনল অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের একটি ভাল উৎস খেজুর। চিনির তুলনায় কম প্রক্রিয়াজাত করা হয় বিধায় খেজুরে থাকা পুষ্টিগুণের প্রায় সবটাই পাওয়া যায়। মিষ্টি স্বাদের জন্য কেক ও কুকিজের রেসিপিগুলোতে খেজুর চিনির একটি সেরা বিকল্প। এমনকি এগুলোকে ঘরে তৈরি বাদামের দুধ এবং জ্যুসের সাথেও মেশানো যেতে পারে। এছাড়া, পিঠা-পুলি, হালুয়া ও সন্দেশের ক্ষেত্রে খেজুরের গুড় একটি জনপ্রিয় কাঁচামাল। তবে, রক্তে শর্করার মাত্রা ঠিক রাখার তাগিদে ডায়াবেটিস রোগীদের এগুলোর সংস্পর্শে না আসাই উত্তম। খেজুরের গুড় শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাণশক্তির এক চমৎকার উৎস খেজুরের গুড়। এতে থাকা প্রাকৃতিক আয়রন শরীরে লাল রক্তকণিকা তৈরিতে সাহায্য করে। পাশাপাশি, এতে বিদ্যমান সেলেনিয়াম এবং কপার অবদান রাখে দেহের সুস্থ হাড় বজায় রাখতে। ভিটামিন বি সমৃদ্ধ এ গুড় স্নায়ুতন্ত্র ও ক্লান্তি কমানোর জন্য উপকারী। ফাইবারের রেচক প্রভাবের কারণে এটি কোষ্ঠকাঠিন্যে সহায়তা করতে পারে। শিশুদের সামগ্রিক জ্ঞানীয় কর্মক্ষমতা উন্নয়নে একটি ঐতিহ্যবাহী পথ্য এ খেজুরের গুড়।
আখের গুড়: এ উপাদেয় খাদ্যটি পাওয়া যায় মূলত আখ প্রক্রিয়াকরণের সময় উপজাত হিসেবে। কম ক্যালোরিযুক্ত হওয়ায় আখের গুড় সাধারন চিনি ও বাজারের অন্যান্য মিষ্টির তুলনায় অধিক স্বাস্থ্যকর। কাঁচা আখের গুড়ে মূলত পানি, সুক্রোজ, অল্প পরিমাণে ফ্রুক্টোজ এবং গ্লুকোজ থাকে। পরিশোধনের পর প্রাপ্ত গুড় ভিটামিন এবং আয়রন, পটাসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম ও ক্যালসিয়ামের মত খনিজ উপাদানে ভরপুর থাকে। ফলে, এ গুড়ের উপযোগিতা পাওয়া যায় চুল, ত্বক, ও হাড়ের স্বাস্থ্যে এবং হৃদপিন্ডের সুরক্ষায়। এছাড়া, এটি গর্ভবতী মহিলাদের জন্য আয়রনের একটি উৎকৃষ্ট উৎস।
পাঁকা কলা: বিভিন্ন সুস্বাদু ফলের ককটেল বা জ্যাম-জেলি যে কোন নাস্তায় সেরা সংযোজন। এমনকি মধ্যাহ্ন ভোজের সাইড ডিশ হিসেবেও ফল বেশ উপযোগী। বিশেষ করে পাঁকা কলায় প্রচুর পরিমাণে ফোলেট, ম্যাঙ্গানিজ, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন বি-৬ এবং সি রয়েছে। মিষ্টি স্বাদ ও গন্ধের পাশাপাশি পাঁকা কলা ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টেও ভরপুর। কোন রকম কৃত্রিম উপায়ে প্রক্রিয়াকরণ ছাড়াই এগুলোর প্রকৃতি প্রদত্ত স্বাদ সরাসরি আস্বাদন করা যায়। সেই সাথে পুষ্টিতেও ঘাটতি পড়ে না। এগুলো দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দীর্ঘ স্থায়ী রোগের ঝুঁকি হ্রাসে অংশ নেয়। পাঁকা কলা দই, প্যানকেক এবং বেক্ড পণ্যের মতো খাদ্যে মিষ্টি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। কেননা মসৃণতার কারণে মিশ্রণের সাথে এগুলো কার্যকরভাবে মিশে যেতে পারে।
চিনি পাতা বা মিথি তুলসী: এ ভেষজ উপাদানটি স্থানভেদে বিভিন্ন নামে পরিচিত। দক্ষিণ আমেরিকার স্টেভিয়া রেবাউডিয়ানা উদ্ভিদের পাতা থেকে সংগ্রহ করার কারণে এর নাম স্টেভিয়া। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এটি চিনি পাতা বা মিথি তুলসী নামে পরিচিত। এর পাতায় স্টেভিওল গ্লাইকোসাইড নামের এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে, যা অত্যন্ত ঘনীভূত মিষ্টি গন্ধযুক্ত। এর নির্যাস চিনির থেকে প্রায় ২০০ থেকে ৪০০ গুণ বেশি মিষ্টি। তাই, বহু জায়গায় একে মিঠা তুলসী নামেও ডাকা হয়। তবে এতে কোন কার্বোহাইড্রেট, ক্যালোরি বা কৃত্রিম উপাদান নেই। তার মানে চিনি পাতা রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়ায় না। আর এ কারণেই এটি চিনির একটি শক্তিশালী বিকল্প। এর শুকনো পাতা পিষে রান্নায় বা চা-কফিতে যোগ করা যায়। বাজারে পাউডার হিসেবেও পাওয়া যায় যেগুলো দিয়ে জ্যুস বানিয়ে খাওয়া যায়। তবে, এক্ষেত্রে অতিরিক্ত উপাদান হিসেবে কি যোগ করা হচ্ছে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। মিথি তুলসীর একটি খারাপ দিক রয়েছে, তা হচ্ছে এটিও চিনির মত মিষ্টি খাবারের প্রতি আকুলতাকে বাড়িয়ে তোলে। তাই, এর অতিরিক্ত সেবন চিনি গ্রহণের মতই নেশা তৈরি করতে পারে।
নারিকেল গুড়: প্রকৃতি প্রদত্ত চিনির উপযুক্ত একটি বিকল্প নারিকেল চিনি বা নারিকেল গুড়। নারিকেল ফুলের নির্যাস থেকে সংগৃহীত রসকে বাষ্পীভূত করার মাধ্যমে স্ফটিকাকৃতি দেয়া হয়। এভাবে গুড় তৈরির প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পদ্ধতির ভেতর দিয়ে যায়। রসের দ্রবণে ইনুলিন নামের এক ধরনের ফাইবার থাকে। এর কারণেই মূলত এর জিআই (গ্লাইসেমিক সূচক) চিনির তুলনায় কম থাকে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অল্প পরিমাণে ইনুলিন ফাইবার অন্ত্রের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। তবে, নারিকেল চিনির খারাপ দিক হচ্ছে, জিঙ্ক ও আয়রনের মত পুষ্টিগুলো তুলনায় এতে ফ্রুক্টোজের পরিমাণ প্রায় ৩৯ শতাংশ। প্রকৃতিতে পাওয়া চিনির বিভিন্ন ধরনের মধ্যে ফ্রুক্টোজ ভোজ্য সামগ্রীতে সব থেকে বেশি পাওয়া যায়।
ডেউয়া ফল: কোন ক্যালোরি ছাড়াই প্রাকৃতিক মিষ্টি স্বাদের ভান্ডার এ ডেউয়া ফল। এর মিষ্টতার পেছনে রয়েছে এর ভেতরে থাকা ফ্রুক্টোজ, গ্লুকোজ এবং মোগ্রোসাইড। নিষ্কাশনের পর প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে ফ্রুক্টোজ এবং গ্লুকোজ নির্মূল করে রসের মধ্যে শুধুমাত্র মোগ্রোসাইডকে রাখা হয়। মোগ্রোসাইড প্রদাহ-বিরোধী বৈশিষ্ট্যসহ একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। ডেউয়া ফল চিনির চেয়ে প্রায় ২৫০ গুণ বেশি মিষ্টি। এটি রক্তে শর্করার মাত্রার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না, বরং তা উন্নত করতে কাজে লাগে। তাই, ওজন কমানোর ক্ষেত্রে এটি একটি পুষ্টিকর উপাদেয় খাদ্য হতে পারে। এ ফল বহুকাল ধরেই ডায়াবেটিস ও স্থূলতার চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়ে আসছে।
তালের রস: ‘সুগার অফ লাইজ’ হিসেবে পরিচিত এ সুপেয় পানীয়টি সংগ্রহ করা হয় তাল গাছের নির্যাস থেকে। এতে থাকে উচ্চ মাত্রার বি-কমপ্লেক্স ভিটামিন, আয়রন, পটাসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম। এগুলো একই সাথে শরীরকে সতেজ করে তোলে ও চিনির ক্ষতিকর আসক্তি থেকে দূরে রাখে।
এক চামচ তালের রসে বিদ্যমান ভিটামিন বি-১২-এর পরিমাণ দৈনিক চাহিদার ১৩৩ শতাংশ। ভিটামিন বি-৬-এর ক্ষেত্রে তা ২২২ শতাংশ এবং ভিটামিন বি-১-এর ক্ষেত্রে ৬৬৫ শতাংশ। এর জিআই মাত্র ৪০ যেখানে সাদা চিনির জিআই ১০০। অর্থাৎ, তালের রস খাওয়ার সময় রক্তে শর্করার মাত্রা বিঘ্নিত হওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই।
মিছরি: রক সুগার নামে পরিচিত মিছরিতে রয়েছে ক্যালসিয়াম, আয়রন এবং ফসফরাসের মত খনিজ উপাদান। ফলে, এটি স্বাস্থ্যকর হাড় ও দাঁতের গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও, মিছরি হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়িয়ে রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে। মিছরির উপযোগিতা রয়েছে বমি বমি ভাব উপশমে, নাক দিয়ে রক্ত পড়া বন্ধে। এমনকি কিডনি জনিত জটিলতাতেও এটি প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে পারে।
পরিসংহার: চিনির এ স্বাস্থ্যকর প্রাকৃতিক বিকল্পগুলো অকপটেই গড়ে দিতে পারে সাপ্তাহিক সুষম খাদ্যতালিকা। প্রতিদিনের নাস্তায় নিমেষেই অন্তর্ভূক্ত হতে পারে খেজুর, কলা, আপেল ও ডেউয়ার মত ফলগুলো। বিশেষ মৌসুমগুলোতে মিষ্টি স্বাদের খোরাক যোগাতে রয়েছে তালের রস ও নারিকেল গুড়। একটি স্বাস্থ্যসম্মত দিন যাপনের জন্য ঐতিহ্যবাহী কাঁচা মধুর কোন জুড়ি নেই। সর্বপরি, পরিমাণ মত মিষ্টতার এ খাদ্যাভ্যাসে এক ভিন্ন স্বাদের যোগান দিতে পারে মিথি তুলসী।
সিএন/আলী
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন