শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

চতুর্থ দফায় নিষিদ্ধ জামায়াত

বৃহস্পতিবার, আগস্ট ১, ২০২৪

প্রিন্ট করুন
জামায়াত

নিজস্ব প্রতিবেদক: জামায়াত ইসলামী ও তাদের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবিরকে ৪র্থ দফায় নিষিদ্ধ করা হলো। চলমান বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরকারের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলার ঘটনার দোষী সাব্যস্ত করে সরকারের নির্বাহী আদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলটি নিষিদ্ধ করা হলো।

বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। এতে সই করেছেন মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব জাহাংগীর আলম।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, যেহেতু, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত কয়েকটি মামলার রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (পূর্বনাম জামায়াত-ই- ইসলামী/জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ) এবং তার অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির (পূর্বনাম ইসলামী ছাত্রসংঘ)-কে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দায়ী হিসেবে গণ্য করা হইয়াছে;

এবং যেহেতু, বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ রিট পিটিশন নং-৬৩০/২০০৯-এ ১ আগস্ট ২০১৩ তারিখের প্রদত্ত রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এর রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত/প্রাপ্ত নিবন্ধন বাতিল করিয়া দিয়াছে এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ, হাইকোর্ট বিভাগের ওই রায়কে বহাল রাখিয়াছে; এবং যেহেতু, সরকারের নিকট যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ রহিয়াছে যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং তার অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সাম্প্রতিককালে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সরাসরি এবং উসকানির মাধ্যমে জড়িত ছিল।

জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপনের পর ঢাকায় নিরাপত্তা জোরদার

এতে আরও বলা হয়েছে, যেহেতু সরকার বিশ্বাস করে যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ উহার সব অঙ্গ সংগঠন সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সহিত জড়িত রহিয়াছে সেহেতু, সরকার, সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯ এর ধারা ১৮(১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ তার সব অঙ্গ সংগঠনকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করিল এবং উক্ত আইনের তফসিল-২ এ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ তার সব অঙ্গ সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্ত্বা হিসেবে তালিকাভুক্ত করিল। ইহা অবিলম্বে কার্যকর হইবে।

এর আগে সকালে সচিবালয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর কক্ষের সামনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ করার একটা আইনি প্রক্রিয়া আছে, সেটা আমরা গত পরশু শুরু করে দিয়েছিলাম। এর মধ্যে এই নিষিদ্ধের যে গেজেট প্রকাশ করা হবে, সেটারও কিছু আইনি বাধ্যবাধকতা আছে, সেগুলো পূরণ করতে হবে।

‘যে কারণে গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় সেই আইনি বাধ্যবাধকতা পূরণ করে আমার মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ বিভাগে পাঠিয়েছে, এরপর সেটিকে ভেটিং করে আবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি, আমার মনে হয়ে, কিছুক্ষণের মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই গেজেট প্রকাশ করে দেবে।’

তিনি বলেন, সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮/১ ধারায় জামায়াত-শিবির ও অন্যান্য যে অঙ্গ সংগঠন নিষিদ্ধ, এটা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের যে দ্বিতীয় তফসিল আছে, সেখানে এগুলো তালিকাভুক্ত হবে। এটাই আমাদের সিদ্ধান্ত, আপনারা মনে হয় কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রজ্ঞাপন পেয়ে যাবেন। এটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।

আগেও ৩ বার নিষিদ্ধ হয়েছিল জামায়াতে ইসলামী

১৯৭২ সালে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহারের’ কারণে। সে সময় সংবিধানর ৩৮ ধারা অনুযায়ী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। কেবল স্বাধীন বাংলাদেশেই নয় যে পাকিস্তান নামক দেশে জামায়াতে ইসলামীর জন্ম সেদেশেও তাদের দুবার নিষিদ্ধ করা হয়। প্রথমবার ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়। সে বার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উসকানির অভিযোগে দলটি নিষিদ্ধ হয়। তবে অল্পদিন পরেই তারা আবার রাজনীতি করার সুযোগ পায়। এরপর ১৯৬৪ সালে আবারও নিষিদ্ধ করা হয় জামায়াতকে। এবার কারণ হিসেবে বলা হয় মুসলিম পরিবার আইনের বিরোধিতা। তবে এই নিষেধাজ্ঞাও বেশিদিন ছিল না।

পাকিস্তানে যেমন নিষিদ্ধ ঘোষণার পরও জামায়াতে ইসলামী রাজনীতিতে ফিরে আসে একইভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতেও তারা ফিরত এসেছিল। ৭৫ এর ১৫ ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার আগ পর্যন্ত দেশের রাজনীতিতে জামায়াতের অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সময় ১৯৭৬ সালে ধর্মীয় রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। ফলে রাজনীতিতে পুনরায় ফিরে আসে দলটি।

১৯৭৬ সালের ৩ মে রাষ্ট্রপতি এ.এস.এম সায়েম একটি অধ্যাদেশ জারি করে বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। রাষ্ট্রপতি সায়েম অধ্যাদেশ জারি করে থাকলেও এর নেপথ্যে ছিলেন জিয়াউর রহমান।

২০১৩ সালের ১ অগাস্ট হাইকোর্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ‘অবৈধ ও বাতিল’ ঘোষণা করে রায় দেয়। সংবিধানের সঙ্গে গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক হওয়ায় আদালত এই রায় দেন। এরপর থেকে দলটি সরাসরি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ না পেলেও অন্যান্য দলের সঙ্গে জোট করে অংশ নেয়।

জামায়াতের রাজনীতির ইতিহাস

জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী

আব্বাস আলী খান রচিত ‘জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস’ বই থেকে জানা গেছে, ব্রিটিশ আমলে ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট লাহোরের ইসলামিয়া পার্কে সামাজিক-রাজনৈতিক ইসলামি আন্দোলনের অংশ হিসেবে জামায়াতে ইসলামী গঠন হয়। জামায়াত ভারতের মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধিতা করেছিল। স্বাধীনতা ও ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর দলটির প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী ভারত থেকে পাকিস্তানে চলে যান।

ধর্মের কথা বলা হলেও অনেকেই মনে করেন মূলত ভারতের কমিউনিজম বিরোধী শক্তি হিসেবেই এ সংগঠনটির জন্ম হয়েছিলো এবং তখনকার ব্রিটিশ শাসকদের আনুকূল্যও তারা পেয়েছিলো।

উনিশশো পঁয়তাল্লিশ সালে এর প্রথম কনভেনশন হয় অবিভক্ত ভারতে এবং এর দু’বছর পর দেশভাগের আগ পর্যন্ত এই সংগঠনটি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলো।

খালেদা জিয়ার সঙ্গে জামায়াত নেতারা

উল্লেখ্য, সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বহুদলীয় সংসদীয় সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি। একই বছরের ৭ জুন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাশাপাশি বিলুপ্ত করা হয়েছিল আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দল। স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ঘুণে ধরা সমাজকে বাঁচাতে সব দল নিষিদ্ধ করে সবাইকে একই প্ল্যাটফর্মে আনতে বাকশাল গঠন করেন। বাকশালকে তিনি দ্বিতীয় বিপ্লব হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। সাধারণ জনগণের পাশাপাশি সামরিক বেসামরিক আমলা ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, সাংবাদিকসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের বাকশালের অন্তর্ভুক্তির আইনগত সুযোগ ছিল। তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যার পর সেটি আর বাস্তবায়িত হয়নি।

পরে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে সামরিক ফরমান বলে আবারও বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করলে আওয়ামী লীগসহ পুরনো দলগুলো কার্যক্রম শুরু করে। পাশাপাশি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পথ তৈরি হয়।

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন