ড. হুমায়ুন কবির
কওমি মাদরাসা মূলত ভারতের উত্তর প্রদেশের দেওবন্দ মাদরাসার আলোকে প্রণীত শিক্ষা ব্যবস্থা। এখানে কুরআন-হাদিছের মূলধারার শিক্ষার ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়। বাংলাদেশে প্রায় ২০ হাজার কওমি মাদরাসা রয়েছে। কওমি মাদরাসায় ১৫ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। ২০১৩ সালে কওমি সনদের স্বীকৃতি বাস্তবায়নে আল্লামা আহমদ শফী (রহ.) সাহেবের নেতৃত্বে কমিশন গঠন করে সরকার।
সনদের স্বীকৃতি নেওয়া কি কওমী মাদরাসার আট মূলনীতির বিপরীত?
কওমী মাদরাসার আটটি মূলনীতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তাতে চারটি মূলনীতিই (১, ৬, ৭ ও ৮) মাদরাসার আয়ের ব্যাপারে। তথা মাদরাসার আয় যেন মাদরাসার তাওক্কুল বিপরীত ও নিয়ন্ত্রণের কারণ না হয়। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই বলা হয়েছে। পূর্বের ওয়াকফ সম্পত্তির বিপরীতে সাধারণ মানুষের অনুদানকে গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে।
আর দ্বিতীয় মূলনীতিতে ছাত্রদের আবাসিকের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তৃতীয় মূলনীতিতে পরিচালক যেন আমানতদার ও ন্যায়পরায়ণ হয়, তাই শুরার মাধ্যমে মাদরাসা পরিচালনা করার জন্য বলা হয়েছে। আর চতুর্থ ও পঞ্চম মূলনীতিতে শিক্ষক ও সিলেবাসের ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তথা তারা যেন দ্বীনদার, একই সমমনা হয় ও পুরো সিলেবাস যথা সময়ে শেষ করে।
উল্লিখিত মূলনীতিতে সরকারের নির্দিষ্ট অনুদানের নিষেধ করা হয়েছে। যাতে তারা আলিয়া মাদরাসায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ২৬ জন খ্রিষ্টানকে প্রথমে প্রিন্সিপাল বানিয়ে ছিল, সেরকম করতে না পারে। তবে কোনো মূলনীতিতে সনদের সরকারী স্বীকৃতির বিরূদ্ধে নেই। কারণ তা তো মানুষের নাগরিক অধিকার। ইসলাম শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছে। আর কুরআনের শিক্ষাকে উত্তম শিক্ষা হওয়ার সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে। তাই সনদ নেওয়া দেওয়া দেওবন্দেও চালু রয়েছে। কারণ যখন কাসেম নানুতবী (রহ.) মাদরাসা চালু করেছিলেন তখন কাগজের কোনো সনদ দেওয়া হতো না। আর এখন তো প্রত্যেক মাদরাসায় একাডেমিক সনদ দেওয়া হয় তা জ্ঞানের স্বীকৃতি ও সম্মানের সার্টিফিকেট। তাই সনদ দেওয়া ও নেওয়া সেই আট মূলনীতির বিপরীত নয়। আর সনদ দিলে বা নিলে যে সরকারী নিয়ন্ত্রণ থাকে তা ভুল।
যেমন বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সরকারের টাকাও গ্রহণ করে আবার সনদও গ্রহণ করে; কিন্তু তা স্বায়ত্বশাসিত হওয়ার কারণে নিজেদের সিলেবাস নিজেরাই করে তাতে সরকারের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই। তবে কওমী মাদরাসা যদি সরকার থেকে মাসিক বেতন নেয় তখন তা আট মূলনীতির বিপরীত হবে। তখন কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণের কথা চলে আসবে। যে কোনো বিষয় ছাপিয়ে দিতে চাইবে।
কওমী মাদরাসার আরো চারটি স্তরের স্বীকৃতি যে সকল শর্তে হতে পারে:
(১) কওমী মাদরাসার কাফিয়া বা শাশুমকে দাখিল সমমান, শরহে বেকায়া বা চাহারুমকে আলিম সমমান, মিশকাত বা জামাতে উলাকে ডিগ্রি সমমান ও এক বা দুই বছর মেয়াদী তাখাসসুকে দ্বিতীয় মাষ্টার্সের মান নেওয়া প্রয়োজন। তখন সর্বস্তরে কওমী আলিমগণ উচ্চশিক্ষার সুযোগ লাভ করবে ও চাকরির বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিচরণ করে দ্বীনি খিদমাত করতে পারবে।
(২) উক্ত মানগুলি থেকে কাফিয়া ও ছাহারুমের মান স্বীকৃতি ছয় বোর্ডের তত্ত্বাবধানে হবে। বাকী মিশকাত, দাওরায়ে হাদিছ ও তাখাসসুসের মান হাইয়ার নাম পরিবর্তন করে কওমী বিশ্ববিদ্যালয় নাম দিয়ে এর তত্ত্বাবধানে হবে।
(৩) হাইয়া বা কওমী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হবে ৩৩ জনের কমিশন দ্বারা। উক্ত কমিশন গঠন প্রক্রিয়া হতে পারে এমন- প্রতি বোর্ড থেকে ৫ জন করে ৩০ জন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী-ইসলামী স্টাডিজের একজন প্রফেসর (সভাপতি কর্তৃক নির্বাচিত) ও একজন ইউজিসি সদস্য (ইউজিসি চেয়ারম্যান কর্তৃক নির্বাচিত) থাকবে। প্রতি বোর্ডের নির্বাহী কমিটি উক্ত পাঁচজন নির্ধারণ করবেন। তারাই উক্ত হাইয়া বা কওমী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি (মহাপরিচালক), প্রো-ভিসি (পরিচালক) ও অন্যান্য উপ কমিটি ও দায়িত্ববান ঠিক করবেন।
প্রতি তিন বছর পরপর কমিটি নবায়ন করা হবে। বেফাকের সভাপতি পদাধিকারবলে হাইয়া বা কওমী বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি হবেন। অন্য বোর্ডের যে কোনো সভাপতিকে সেক্রেটারী করা হবে। নবায়নকৃত কমিটি শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে প্রেরণ করবে। যাতে তা গেজেটে পরিণত হয়।
(৪) ছয়টি বোর্ডের গঠন প্রক্রিয়া: ৩৩ জনের একটি কমিশন গঠন করা হবে। অধিভুক্ত মাদরাসার মুহতামিমদের ভোটে বা পরামর্শে তা গঠন করা হবে। অধিভুক্ত মাদরাসার পরিচালক ও মুহাদ্দিছদের দ্বারা তা গঠন করা হবে। তাতে একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী-ইসলামী স্টাডিজের একজন প্রফেসর (সভাপতি কর্তৃক নির্বাচিত) ও জেলা শিক্ষা অফিসারকে সদস্য করা হবে। প্রতি তিনবছর পরপর নিজস্ব সংবিধানের আলোকে কমিটি নবায়ন করা হবে। নবায়নকৃত কমিটি শিক্ষামন্ত্রনালয়ে প্রেরণ করবে। নেসাব কমিটি নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালন করবে।
(৫) কওমি মাদরাসা নেসাব ও নেজামে তালীমে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করা চলবে না। নেসাবের পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে প্রতিটি শিক্ষাবোর্ডের ১৩ জনের নিজস্ব নেসাব কমিটি থাকবে। তাদের প্রস্তাবে কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়ে সংযোজন-বিয়োজন করবে।
(৬) চার মাযহাবের আলোকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকীদা সম্পূর্ণভাবে অক্ষুন্ন রাখতে হবে।
(৭) মাদরাসা পরিচালনা পদ্ধতিতে হস্তক্ষেপ করা চলবে না। তবে সরকারী স্বীকৃত অডিটর দ্বারা আয়-ব্যায় অডিট করতে হবে।
(৮) কওমি মাদরাসা কখনও এমপিওভুক্ত হবে না। সরকার চাইলে এককালীন চাঁদা দিতে পারবে।
(৯) কোনো মাদরাসা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সরকার কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। তবে ছয় বোর্ডের যে কোনো বোর্ডের অনুমোদন থাকতে হবে।
(১০) প্রচলিত কওমি মাদরাসা বোর্ডসমূহ তাদের স্ব-স্ব বিধান অনুযায়ী পরিচালিত হবে।
(১১) প্রত্যেক মাদরাসা কমপক্ষে ১৩ সদস্যের শুরা দ্বারা পরিচলিত হবে। তাতে প্রতিষ্ঠানের থানা থেকে পাঁচজন, জিলা থেকে পাঁচজন ও বোর্ডের প্রতিনিধি থাকবে দুইজন ও দাতা বা প্রতিষ্ঠাতার প্রতিনিধি থাকবে একজন। প্রতি তিন বছর পরপর তা নবায়ন করা হবে। বোর্ড তা নবায়ন করে দিবে।
(১২) প্লে থেকে কাফিয়া বা জামাতে শাশুম পর্যন্ত বাংলা, ইংরেজি ও অংক বাধ্যতামূলক। জামাতে পঞ্জুম ও ছাহারুমে বাংলা ও ইংরেজি বাধ্যতামূলক। বাকী সাবজেক্ট বোর্ডই ঠিক করবে। জামাতে ছুয়াম (হিদায়া), দুয়াম (জালালাইন), উলা (মিশকাত), দাওরা ও তাখাসসুসে কোনো শর্ত থাকবে না। বোর্ড যা ঠিক করবে তাই নিসাব হবে। তাখাসসুস এক বছর মেয়াদীও হতে পারে; দুবছর মেয়াদীও হতে পারে।
(১৩) কওমী সিলেবাস যতই পরিবর্তন হোক না কেন দশটি সাবজেক্টের মধ্যে সাতটি দরসে নেজামীর উপর থাকতে হবে। আর প্রতিটি বোর্ড পরীক্ষা দশ সাবজেক্টের উপর হবে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক,
আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
মোবাইল: ০১৮১৫-৯২৫৭২৭
Views: 123
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন