ইফতেখার ইসলাম: রাত পোহালেই অনুষ্ঠিত হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। দেশটির ৬০তম প্রেসিডেন্টে হওয়ার দৌঁড়ে এগিয়ে রয়েছেন রিপাবলিকান প্রার্থী ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ডেমোক্রেটিক প্রার্থী বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। এবারের নির্বাচনে দেশটির আভ্যন্তরীণ গর্ভপাত, অভিভাসন ইস্যু এবং দেশের বাইরের গাজা-ইসরায়েল, ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যে চলমান সংঘাতের ঘটনাগুলো প্রাধান্য পাচ্ছে। এ ছাড়া দেশটির অর্থনৈতিক বিষয়াবলী ও নারী-পুরুষের লড়াই জমিয়ে তুলেছে এবারের নির্বাচন।
তবে নির্বাচনে প্রধান ভূমিকা রাখবে সুইং স্টেটগুলো। দেশটির ৭ সুইং স্টেট যে কোন মহূর্তে পাল্টে দিতে পারে নির্বাচনের ফলাফল। সেই সাথে ইলেক্টোরাল কলেজে হিসেব নির্বাচনকে বেশ রোমাঞ্চিত করে তুলেছে। যদিও নির্বাচনের শুরু থেকেই জরিপের ফলাফলগুলো কমলা হ্যারিসকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের থেকে এগিয়ে রাখছে। তবে ট্রাম্পের জোর প্রচারণা এবং বিভিন্ন আশাব্যাঞ্জক বানী দিনে দিনে তার অতীত ভুলিয়ে আশা জাগিয়েছে। যদিও মামলা, নারী কেলেঙ্কারি এবং ক্যাপিটাল হিলে দাঙ্গার মতো বিষয়গুলো ট্রাম্পকে প্রতিনিয়ত পিছু টানছে। অন্যদিকে ডেমোক্রেটিক পার্টি ক্ষমতায় থাকাকালে বিশ্বজুড়ে দাঙ্গা কমলা হ্যারিসের জন্য নেগেটিভ পয়েন্ট। সব মিলিয়ে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক এক নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছে মার্কন যুক্তরাষ্ট্র।
জরিপে এগিয়ে কমলা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পৌঁছেছে একেবারে দোরগোড়ায়।শেষ মুহূর্তে এসে রিপাবলিকান প্রার্থী ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের থেকে জনমত জরিপে এগিয়ে গেছেন বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস।
খবরে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক জরিপের ফলাফল প্রকাশের পর যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক চিত্রে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।এই জরিপে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস সম্ভাব্য ভোটারদের মধ্যে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর সামান্য এগিয়ে রয়েছেন।তবে ভোটাররা উভয় প্রার্থীকে নিয়ে অসন্তুষ্ট, এবং দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
এর ফলে আগামী নির্বাচনে প্রার্থীদের পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি এবং সমর্থনের ব্যাপারে ভোটারদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে,তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।জরিপের ফলাফলগুলো প্রকাশ পাওয়ার পর রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন,এ বছর নির্বাচনী প্রতিযোগিতা আরও উত্তেজনাপূর্ণ হতে চলেছে।
সিএনএনের খবর অনুসারে,এবিসি নিউজ/আইপসের সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, সম্ভাব্য ভোটারদের মধ্যে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের সমর্থন কিছুটা বেড়েছে।জরিপ অনুযায়ী, ৪৯% ভোটার হ্যারিসকে সমর্থন দিয়েছেন,যেখানে ৪৬% ভোটার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন করছেন।গত সপ্তাহে প্রকাশিত পূর্ববর্তী জরিপেও কমলা হ্যারিসের সমর্থন ছিল ৫১% এবং ট্রাম্পের ৪৭%।
এবিসি/আইপসের জরিপে প্রতিফলিত হয়েছে, ভোটাররা তাদের নির্বাচনী বিকল্প নিয়ে অসন্তুষ্ট।৬০% ভোটারই জানিয়েছেন, তারা প্রার্থী হিসেবে কমলা হ্যারিস এবং ট্রাম্পের নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে অতি সন্তুষ্ট নন।প্রায় তিন-চতুর্থাংশ ভোটার মনে করছেন,দেশটি ভুল পথে এগিয়ে যাচ্ছে (৭৪%)।
প্রার্থী হিসেবে কমলা হ্যারিস এবং ট্রাম্পের পরিবর্তন আনার ক্ষমতা সম্পর্কে ভোটারদের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন।৫১% ভোটার মনে করেন, ট্রাম্প নির্বাচিত হলে ‘কিছুটা খারাপভাবে পরিস্থিতি বদল করবেন,আর ৩১% ভোটার হ্যারিসের ক্ষেত্রেও একই মত প্রকাশ করেছেন।তবে ট্রাম্পের পরিবর্তনকে ৪৫% ভোটার ইতিবাচক মনে করেন,যেখানে হ্যারিসের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ৩৫%।
৩৪% ভোটার মনে করেন, হ্যারিস পরিস্থিতিকে প্রায় অপরিবর্তিত রাখবেন, আর ৪% ভোটার মনে করেন ট্রাম্প নির্বাচিত হলে পরিস্থিতি একই থাকবে।অন্যান্য জরিপে, জাতীয় পর্যায়ে বেশি ভোটার মনে করেন, হ্যারিস তাদের কাছে ভোট চেয়েছেন (৪৫% ভোটার বলেছেন হ্যারিস ভোট চেয়েছেন, ৪০% বলেছেন ট্রাম্প চেয়েছেন)।
গুরুত্বপূর্ণ সাতটি রাজ্যে ৬৭% ভোটার জানিয়েছেন,তারা হ্যারিসের প্রচারাভিযান থেকে যোগাযোগ পেয়েছেন,যেখানে ৬০% ভোটার বলেছেন ট্রাম্পের প্রচারাভিযান থেকে যোগাযোগ পেয়েছেন।
এদিকে, নতুন জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, সিএনএন জরিপের সর্বশেষ গড় দেখাচ্ছে, ৪৮% ভোটার হ্যারিসকে সমর্থন করছেন এবং ৪৭% ট্রাম্পকে, যা আগের গড়ের সাথে অপরিবর্তিত।
৭ সু্ইং স্টেট ঘুরে ঘুরে প্রচার কমলা–ট্রাম্পের
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বাকি মাত্র আর এক দিন। দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোতেই ছুটছেন দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কমলা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্প। স্থানীয় সময় গত শনিবার রাতে যখন যুক্তরাষ্ট্রবাসী ঘুমিয়ে পড়েছিল, তখন দুই প্রচারশিবিরও কিছুক্ষণের জন্য শান্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু রোববার আবার দুই দল ঝাঁপিয়ে পড়ে শেষ মুহূর্তের প্রচারে। গতকাল রোববার কমলা হ্যারিসের মিশিগান ও পেনসিলভানিয়ায় নির্বাচনী সমাবেশ করার কথা। আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের পেনসিলভানিয়া, নর্থ ক্যারোলাইনা ও জর্জিয়ায় প্রচার চালানোর কথা।
বসে নেই দুই দলের নেতা–কর্মী ও সমর্থকেরাও। মার্কিন ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেনের গতকাল পেনসিলভানিয়ায় প্রচার চালানোর কথা। সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন জর্জিয়ায় হাজির হবেন। রিপাবলিকান ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জে ডি ভ্যান্স ফ্লোরিডা, পেনসিলভানিয়া ও নিউ হ্যাম্পশায়ারে প্রচার চালাবেন। এর আগে শনিবার নর্থ ক্যারোলাইনায় সমাবেশ করেন কমলা ও ট্রাম্প।
কমলা ও ট্রাম্প কয়েক দিন ধরেই বিশেষ করে দোদুল্যমান সাতটি অঙ্গরাজ্য চষে বেড়াচ্ছেন। ব্যতিক্রম ছিল না শনিবারও। স্মরণকালের সবচেয়ে টানটান উত্তেজনার এ নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা ভোটারদের প্রতি রিপাবলিকান রাজনীতির ‘পোড়ামাটি নীতি’ উল্টে দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, নির্বাচনী প্রচারে প্রায়ই কাছাকাছি চলে আসছেন দুজন। শনিবার নর্থ ক্যারোলাইনা অঙ্গরাজ্যে শার্লট বিমানবন্দরে দুজন খুব কাছাকাছিই ছিলেন। কমলা নর্থ ক্যারোলাইনায় গিয়েছিলেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্টের জন্য নির্ধারিত উড়োজাহাজে (এয়ার ফোর্স টু)। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ছবিতে দেখা যায়, কমলা তাঁর এয়ার ফোর্স টুয়ের সিঁড়ি দিয়ে শার্লট বিমানবন্দরে নামছেন। কাছেই ছিল ট্রাম্পের ব্যক্তিগত বোয়িং ৭৫৭ উড়োজাহাজটি (ট্রাম্প ফোর্স ওয়ান) পার্ক করা। শার্লট বিমানবন্দরে ট্রাম্পের উড়োজাহাজ থাকার অর্থ, তিনিও এখানে নির্বাচনী প্রচারে এসেছেন।
নির্বাচনী প্রচার চালাতে নর্থ ক্যারোলাইনায় গিয়ে ব্যক্তি ট্রাম্পের সঙ্গে কমলার মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়নি। তবে কাকতালীয়ভাবে ট্রাম্পের উড়োজাহাজের দেখা পেয়ে গেলেন কমলা। এভাবে ‘কাছাকাছি’ আসাটা এ বিষয়ই তুলে ধরে যে উভয় প্রার্থী তাঁদের শেষ মুহূর্তের নির্বাচনী প্রচারে গুটিকয়েক অঙ্গরাজ্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাঁদের সব মনোযোগ এখন হাতে গোনা কয়েকটি অঙ্গরাজ্য ঘিরে।
এ নিয়ে টানা চার দিন দুই প্রার্থীকে একই দিন একই অঙ্গরাজ্যে নির্বাচনী প্রচার চালাতে দেখা গেল। আগামীকাল মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই নির্বাচনে সাতটি অঙ্গরাজ্যকে ‘দোদুল্যমান’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এসব অঙ্গরাজ্য নির্বাচনে জয়-পরাজয় ঠিক করে দিতে পারে। এই সাত অঙ্গরাজ্যের মধ্যে নর্থ ক্যারোলাইনাও আছে।
শেষ মুহূর্তের নির্বাচনী প্রচারে বিভিন্ন ইস্যুতে ট্রাম্প ও কমলা পরস্পরকে আক্রমণ করে চলেছেন। ট্রাম্প বলেছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে লাখ লাখ অভিবাসীকে বিতাড়িত করবেন। আর কমলা যদি জয়ী হন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি শহর বিপজ্জনক শরণার্থীশিবিরে পরিণত হবে।
কমলা বলেছেন, ট্রাম্প যদি হোয়াইট হাউসে ফিরে আসেন, তাহলে তিনি তাঁর ক্ষমতার অপব্যবহার করবেন। ট্রাম্প অস্থির, প্রতিশোধের নেশায় আচ্ছন্ন ব্যক্তি।
কী প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন ট্রাম্প ও হ্যারিস
নির্বাচনের শেষ সময়ে এসে বিভিন্ন ইস্যুতে দুই প্রার্থীর যে অবস্থান তা নীচে তুলে ধরা হলো।
মূল্যস্ফীতি: কমালা হ্যারিস বলেছেন প্রথম দিন থেকেই তার অগ্রাধিকার হবে জীবন যাত্রার ব্যয় কমানো। গ্রোসারি বা দোকানে মূল্য বৃদ্ধি ঠেকানো, ক্রেতাদের সহায়তা এবং ন্যুনতম বেতন বৃদ্ধির মতো পদক্ষেপ নিবেন তিনি। আরও অনেক পশ্চিমা দেশের মতো মূল্যস্ফীতি বাইডেন প্রশাসনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রেও বেড়েছে। অন্যদিকে ট্রাম্প ‘মূল্যস্ফীতির অবসান ঘটিয়ে আমেরিকাকে আবারো সাশ্রয়ী’ করার অঙ্গীকার করছেন। জ্বালানি খরচ কমিয়ে আনতে তিনি আরও তেল উৎপাদনের কথা বলছেন। সুদের হার কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। তিনি বলছেন অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠাতে পারলে আবাসনের চাপ কমবে।
আইন শৃঙ্খলা: হ্যারিস প্রসিকিউটর হিসেবে তার অভিজ্ঞতার সাথে ট্রাম্পের অপরাধে অভিযুক্ত হওয়ার বিষয়টিও তুলে ধরছেন। অন্যদিকে ট্রাম্প মাদক কার্টেল ও দলগত সহিংসতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। তিনি বলছেন ডেমোক্র্যাটরা যেসব শহর পরিচালনা করছে সেগুলো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ভরে গেছে। একই সাথে তিনি নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করলে তিনি ‘উগ্র বাম ও শত্রুদের’ বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী বা ন্যাশনাল গার্ড ব্যবহারের কথা বলেছেন।
গর্ভপাত: কমালা হ্যারিস গর্ভপাতের অধিকারকে তার প্রচারের কেন্দ্রে রেখেছেন এবং তিনি দেশজুড়ে প্রজনন অধিকার বিষয়ে আইনের পক্ষে তার অবস্থান অব্যাহত রেখেছেন। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প অবশ্য গর্ভপাতের বিষয়ে তার অবস্থান এক জায়গায় রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন।
মার্কিন নির্বাচনে ইলেক্টোরাল কলেজ যেভাবে নির্বাচিত হয়
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ইলেক্টোরাল কলেজ। যুক্তরাষ্ট্রে ৫০টি অঙ্গরাজ্য এবং রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি মিলে মোট ৫৩৮টি ইলেক্টোরাল ভোট রয়েছে। প্রেসিডেন্ট হতে হলে একজন প্রার্থীকে অন্তত ২৭০টি ইলেক্টোরাল ভোট পেতে হয়।
প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের ইলেক্টোরাল ভোট সংখ্যা নির্ধারিত হয় তাদের কংগ্রেসনাল ডিস্ট্রিক্ট ও সিনেট আসন অনুযায়ী। নির্বাচনের সময় সাধারণ ভোটাররা প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর দলে থাকা ইলেক্টোরাল ভোটারদের নির্বাচিত করেন। অধিকাংশ অঙ্গরাজ্যে “উইনার টেকস অল” নীতি কার্যকর হয়, তবে মাইন ও নেব্রাস্কায় এটি ভিন্ন।
ডিসেম্বরের দ্বিতীয় বুধবারের পরের প্রথম সোমবার নির্বাচিত ইলেক্টোরাল ভোটাররা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য চূড়ান্ত ভোট দেন। পরের বছরের ৬ জানুয়ারি কংগ্রেসে ভোট গণনা শেষে চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করা হয়।
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন