চন্দন কুমার বড়ুয়া: প্রবারণার অর্থ প্রকৃষ্টরূপে সব প্রকার অকুশলকে বারণ এবং কুশলকে বরণ। বিশুদ্ধ বিনয়াচারে জীবনকে পরিচালিত করার আদর্শ গ্রহণ করা আর ধর্মাচারের পরিপন্থী অকুশল কর্মাদি হতে বিরত থাকা। আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত- এ তিন মাস সময়কালকে বৌদ্ধ পরিভাষায় বর্ষাবাস বলা হয়। প্রবারণা পূর্ণিমা বৌদ্ধদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব। এ দিনে সব ধরনের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে পরস্পরের মধ্যে শুভেচ্ছা বিনিময় করে থাকেন।
প্রবারণা পারষ্পরিক সৌহার্দ্য, মৈত্রী ও ভালবাসার বার্তা নিয়ে আসে। এর মাধ্যমে মনের মলিনতা দুরীভূত হয় এবং নৈতিক মানবিকতার উন্মেষ ঘটে। ত্রিজগত পূজ্য ভগবান বুদ্ধ তিনমাসব্যাপী ভিক্ষু ও দায়ক সংঘের ধর্মীয় অনুশীলন শেষে পরষ্পরের মাঝে দোষত্রুটি স্বীকার পূর্বক আত্মশুদ্ধির বিধান পালনের নির্দেশ প্রদান করেছেন। তিন মাসব্যাপী বৌদ্ধগণ শীল সমাধি ও প্রজ্ঞা সাধনার অধিষ্ঠান গ্রহণের মধ্য দিয়ে ব্রত সমাপন ঘটে তাই প্রবারণার গুরুত্ব ও মর্যাদা অতি তাৎপর্যমন্ডিত। তাই প্রবারণা শুধুমাত্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী নয় সব মানব জাতির পরিশুদ্ধ জীবন লাভ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
লৌকিক অর্থে ত্রৈমাসিক বর্ষাবাস শেষে মাত্র একটি উৎসবের মাঝে সীমিত রেখে আমরা প্রবারণা উদযাপন সমাপ্ত করি। বাস্তবে আমরা প্রতিনিয়ত অকুশলকে বরণ এবং কুশলকে বারণে ব্যস্ত থাকি। এক সময় মানুষ মিথ্যা বলতে সাহস পেত না, এখন মানুষ সত্য বলতে সাহস পায় না। সমাজের সর্বত্র নিজের আমিত্ববাদ বজায় রাখতে গিয়ে মান অভিমান ও সংঘাতে লিপ্ত হয়ে মানুষ সামাজিক অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ফলে নিজ নিজ ধর্ম পালন ও অনুশীলন হতে পশ্চাতে নিপতিত হচ্ছে। নিজ নিজ আত্মশুদ্ধির অনুশীলন না করার ফলে পরস্পরের প্রতি সম্পর্কের দুরত্ব তৈরী এমনকি সম্পর্কের ছেদ ঠেকাতে আমরা ব্যর্থ হই।
প্রতি বছর প্রবারণার উৎসব করছি ঠিকই কিন্তু ছেদ হওয়া সম্পর্কের পূণর্মিলন আর হয়ে উঠে না। তাহলে সত্যিকার অর্থে প্রবারণা হলো কি? হয় না। অথচ মানব জীবনের প্রতিটি ধাপেই মৈত্রীপূর্ণতার মধ্য দিয়ে পূনর্মিলন ঘটাতে প্রবারণার গুরুত্ব অপরিসীম। ভগবান বুদ্ধের নির্দেশিত বর্ষাবাস সমাপনান্তে ভিক্ষুগণ তাদের অজ্ঞাতসারে দোষত্রুটি অপর ভিক্ষুগণের নিকট প্রকাশ করে তার প্রায়শ্চিত্ত বিধানের আহবান জানায়। এমনকি কোন অপরাধ করে থাকলে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা। এটিই প্রবারণার মূলকথা।
ক্ষমা মহত্বের একমাত্র নির্দেশক, প্রবারণা কৃত কর্মের অপরাধ স্বীকারপূর্বক ক্ষমা প্রার্থনা বিধান রয়েছে। যিনি যথাযথ বিনয় প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন তিনি সর্বত্র সমাদৃত হন। জগতে আমরা সবাই যেন এক অসম দৌড় প্রতিযোগিতায় লড়ছি। তা হচ্ছে, সর্বত্রই বলপূর্বক নিজেকে শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দেয়া। নির্দিষ্ট জায়গায় অসংখ্য দুর্বলতা থাকা সত্বেও ‘মেধায় শক্তিতে আমি আপনার চেয়ে কোন অংশে কম নই’- এ মনোভাব পোষন করা মোটেও সমীচিন নয়। ইগোর কারণে নিজের অজান্তেই প্রতিনিয়ত নিজের কাছে নৈতিক পরাজয় বরণ করছি। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) তার জীবনে প্রচুর আত্মসংযম ও ধৈর্যশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি রাগ সংবরণ করা ও ক্ষমা করা ইবাদত বলে আখ্যায়িত করেছেন। শান্তি-সম্প্রীতি ও ভালবাসার শান্তির দূত যীশু শান্তির ধর্ম প্রচার করে গেছেন। তিনি নির্যাতনকারী পরম শত্রুকে ভালবাসতে বলেছেন। আর ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’ স্বামী বিবেকানন্দের এ উক্তিটি বিশ্ব মৈত্রী প্রেমের উজ্জ্বল স্বাক্ষর হিসাবে মানব সমাজে এখনো অবিনশ্বর। উপরের উক্তিগুলো প্রবারণার গুরুত্বের সাথে অভিন্ন অন্তমিল রয়েছে।
বর্ষার বাদল ধারা শেষে শরতের শিশির স্নাত স্নিগ্ধ প্রকৃতির আনন্দময় মনোরম রূপের মত প্রবারণার উৎসব বড়ই চিত্তাকর্ষক। রাজকুমার সিদ্ধার্থ দু:খমুক্তি লাভের আশায় রাজ্যের রাজত্ব, ভোগ বিলাস ধনকুম্ভ সবকিছু ত্যাগ করে সংসার পরিত্যাগ করেছিলেন শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে। তিনি সারথি ছন্দককে সাথে নিয়ে অশ্ব কন্থকর পিঠে চড়ে অনোমা নদীর তীরে পৌঁছলেন। রাজ আবরণ ছন্দককে বুঝিয়ে দিয়ে তিনি সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করলেন। তিনি ভাবলেন, আমি এখন সন্ন্যাসী রাজকীয় বাহারি চুল কিবা প্রয়োজন। তরবারি দিয়ে চুলের গোছা কেটে নিলেন। তিনি অধিষ্ঠান করলেন, যদি বুদ্ধ হওয়ার মত গুণপ্রভাব আমার মধ্যে থাকে তাহলে এ চুল মাটিতে না পড়ে আকাশ মার্গে স্থিত থাকুক। এ সংকল্প করে তিনি চুলের গোছা উপরের দিকে নিক্ষেপ করেন। মহাপুরুষগণের সত্যক্রিয়া বৃথা যায় না। আশ্চর্য্যরে ব্যাপার একটা চুলও মাটিতে না পড়ে আকাশ মার্গেই স্থিত রইল। বৌদ্ধ মতে, স্বর্গের ইন্দ্ররাজা এ চুলগুলো মনি মানিক্য খচিত স্বর্ণ পাত্রে ধারণ করে তাবতিংস স্বর্গে ওই কেশধাতু স্থাপনপূর্বক একটি চৈত্য নির্মাণ করেন, যার নাম ‘চুলামনি চৈত্য’। স্বর্গের দেবতারা এখনো চুলামনি চৈত্যকে পূজা করেন। এ চৈত্যকে পরম শ্রদ্ধায় পূজা করার জন্য প্রতি প্রবারণায় বৌদ্ধরা ফানুসকে আকাশ প্রদীপ হিসাবে ‘ফানুষ বাতি’ উত্তোলন করে থাকেন।
প্রবারণার পূর্ণিমার রাত আকাশে যেন রঙিন ফানুসের মেলা। প্রবারণার ফানুস উৎসব আজ কেবলমাত্র বৌদ্ধ সংস্কৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এ উৎসবে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষ অংশগ্রহণ ও উপভোগ করে থাকেন। এতে করে দেশে সাম্প্রদায়ীক সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়। ফানুস এখন বিশ্বব্যাপী জাতীয় ইভেন্টগুলোর শুভ সূচনায় পবিত্র অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। প্রবারণা হলো মৈত্রী প্রেমের পূর্ণতার প্রতীক। প্রবারণার প্রত্যয় প্রদীপ্ত পূর্ণ চাঁদের আলোয় পারষ্পরিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সহযোগিতা সবার অন্তরে বিরাজ করুক, সব উপদ্রপ অন্তরায় মুক্ত হয়ে বিশ্বে শান্তি বিরাজ করুক। পবিত্র প্রবারণা পূর্ণিমায় সকলের প্রতি মৈত্রীময় শুভেচ্ছা কামনায় ‘জগতের সব প্রাণী সুখী হোক’।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন সংগঠক।
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন