রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫

শিরোনাম

নিবন্ধন নিয়ে উভয়সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসীরা

শুক্রবার, এপ্রিল ১৮, ২০২৫

প্রিন্ট করুন

ইফতেখার ইসলাম: যুক্তরাষ্ট্র সরকার নিবন্ধন বাধ্যতামূলকের পর আতঙ্কে দিন কাটছে লাখ লাখ অভিবাসীদের সময়। এই নিবন্ধন করলে একজনের ব্যক্তিগত সকল তথ্য সরকারের কাছে জমা পড়বে। এতে অভিবাসীদের যেকোন মুহূর্তেই ট্র্যাক বা আটক করতে পারবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। অপরদিকে নিবন্ধন না করলে ৬ মাসের জেল এবং হাজার ডলার জরিমানার বিধান করা হয়েছে। যদিও নিবন্ধন করলেই যে কেউ যুক্তরাষ্ট্রে নিরাপদে থাকতে পারবেন তেমন কোন নিশ্চয়তাও দেওয়া হয়নি। এটি কেবল একটি আইনি বাধ্যবাধকতা পূরণ করার প্রক্রিয়া। এমন পরিস্থিতিতে নিবন্ধন করা  বা না করাই দুটোই যেন বিপদ। সব মিলিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন নতুন  আইন ক্রমশই অনিরাপদ ও অনিশ্চিত করছে অভিবাসীদের জীবন।  

সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, এই নিবন্ধন কোনোভাবেই বৈধ বসবাসের অনুমতি প্রদান করে না। বরং ফর্মে দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অভিবাসন বিভাগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবস্থান নির্ধারণ করে গ্রেপ্তার ও ডিপোর্ট করার কাজ শুরু করতে পারে। এতে অনেক অভিবাসীদের শঙ্কার আরও বেড়ে যায়। ফর্মে বসবাসের ঠিকানা, পারিবারিক তথ্য, অভিবাসন অবস্থা এবং অতীত অপরাধসংক্রান্ত তথ্য দিতে হয়। যা ভবিষ্যতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক অভিবাসী হয়তো নিজের অজান্তেই ইতোমধ্যে নিবন্ধিত আছেন। যেমন, যারা গ্রিন কার্ড, কাজের অনুমতিপত্র, আই-৯৪ অথবা ইমিগ্রেশন কোর্টের নোটিশ পেয়েছেন। তারা আইনত নিবন্ধিত হিসেবে বিবেচিত হন এবং নতুন করে এই ফর্ম পূরণের দরকার নেই।

ইমিগ্রেশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন অবস্থায় অনেক অভিবাসী এই ফর্ম না পূরণ করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। যদিও এতে কিছু আইনি ঝুঁকি রয়েছে—যেমন, ইচ্ছাকৃতভাবে নিবন্ধন না করলে ৬ মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা জরিমানার মুখে পড়তে হতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অনুযায়ী, আত্ম-অপরাধ স্বীকারে বাধ্য করা যায় না। ফলে অনেকেই ফর্মে অপরাধসংক্রান্ত তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে সেটি না পূরণের পক্ষে মত দিচ্ছেন।

অভিবাসী অধিকারকর্মীরা আশঙ্কা করে বলছেন, এই নিবন্ধন প্রক্রিয়া মূলত অভিবাসীদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে তাদের চিহ্নিত ও বহিষ্কার করার একটি কৌশল। ফলে এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে অননুমোদিত অভিবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।

এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হচ্ছে সঠিক তথ্য ও আইনি পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া। অনেকেই স্থানীয় এনজিও ও আইনি সহায়তা কেন্দ্রে ভিড় করছেন ‘ইমিগ্রেশন চেকআপ’ নিতে। যাতে তারা জানতে পারেন আদৌ নিবন্ধনের প্রয়োজন আছে কী-না বা কোনো উপযুক্ত অভিবাসন সুবিধা পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন কিনা।

নতুন আইন কার্যকরের ফলে অভিবাসীদের অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে যারা সীমান্ত পেরিয়ে প্রবেশ করেছেন বা দীর্ঘদিন ধরে অনিবন্ধিত অবস্থায় আছেন তাদের জন্য এই আইন হতে পারে বড় এক বিপদের কারণ। সংশ্লিষ্টদের মতে, এর ফলে অনেকেই প্রশাসনের ভয়ে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হবেন। যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সম্ভাবনাও তৈরি করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একজন অভিজ্ঞ অভিবাসন আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করাই এখন সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।

বৈধ-অবৈধ সকলের পরিচয়পত্র বহন বাধ্যতামূলক

এই ‘এলিয়েন রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টের’ আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত সব অভিবাসীকে সব সময় তাদের বৈধ অভিবাসন-সংক্রান্ত পরিচয়পত্র বহন করার নির্দেশ দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। গত ১১ এপ্রিল থেকে কার্যকর হওয়া এই নতুন আইনটির আওতায় পড়বেন কাজ, পড়াশোনা বা স্থায়ী বসবাসের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত সব অভিবাসী।

মার্কিন নাগরিকত্ব ও অভিবাসন পরিষেবা জানিয়েছে, ১৪ বছরের ঊর্ধ্বে যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন অথচ ভিসা প্রাপ্তির সময় নিবন্ধিত হননি তাদের ৩০ দিনের মধ্যে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। এমনকি পূর্বে নিবন্ধিত হলেও, নির্ধারিত সময় পার হলে তাদের পুনরায় নিবন্ধনের আওতায় আসতে হবে এবং দিতে হবে আঙুলের ছাপসহ বায়োমেট্রিক তথ্য।

যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র দপ্তর (ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি) জানিয়েছে, এই আইনের আওতায় ১৮ বছরের বেশি বয়সী সব অভিবাসীকে সরকার নির্ধারিত ফর্ম পূরণ করে নিবন্ধন করতে হবে। ২০২৫ সালের ১১ এপ্রিলের পর যারা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছেন, তাদের জন্য নিবন্ধনের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০ দিন। এছাড়া কেউ ঠিকানা পরিবর্তন করলে ১০ দিনের মধ্যে তা জানাতে হবে। অন্যথায় উচ্চ জরিমানা কিংবা কারাদণ্ডের মুখোমুখি হতে হতে পারেন তারা।

নিবন্ধনের জন্য স্বরাষ্ট্র দপ্তর তুনভাবে ‘জি-৩২৫আর’ নামের একটি ফর্ম চালু করেছে। যার মাধ্যমে অনিবন্ধিত বিদেশিরা অনলাইনে আবেদন করে বায়োমেট্রিক তথ্য জমা দিতে পারবেন। যদিও গ্রিন কার্ডধারী বা বৈধ ভিসার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত অভিবাসীরা ইতোমধ্যে নিবন্ধিত বলে বিবেচিত হবেন। তবে তাদেরও সব সময় বৈধ পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখতে হবে। প্রশাসনের মতে, এটি দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অংশ হিসেবে কার্যকর করা হচ্ছে।

হোমল্যান্ড সিকিউরিটির সচিব ক্রিস্টি নোম বলেন, ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে সব অভিবাসীর উচিত তাদের বৈধ অবস্থানের প্রমাণ সব সময় সঙ্গে রাখা। কেউ যদি নিয়ম লঙ্ঘন করেন, তাহলে তার জন্য এই দেশে কোনো নিরাপদ স্থান থাকবে না। 

নিবন্ধন না করলে যে শাস্তি হতে পারে

বিদেশি নাগরিকেরা নতুন অভিবাসন নিয়ম না মানলে কী শাস্তি হতে পারে। কেউ যদি স্বরাষ্ট্র দপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী ৩০ দিনের মধ্যে নিবন্ধন করতে ব্যর্থ হন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগের চূড়ান্ত নির্দেশ পাওয়ার পর প্রতিদিনের জন্য ৯৯৮ ডলার করে জরিমানা দিতে হবে।

আর যদি কোনো বিদেশি নাগরিক যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করবেন—এমন ঘোষণা দেওয়ার পরও তা না করেন, তাহলে তাকে ১ হাজার থেকে ৫ হাজার ডলার জরিমানা দিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ না করলে কারাদণ্ডের সাজাও দেওয়া হতে পারে। এমনকি ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে অভিবাসনের ক্ষেত্রে তাদের আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করতে পারে মার্কিন সরকার।

হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব ক্যারোলিন লেভিট বলেন, নিবন্ধনের এই নিয়ম অমান্য করলে তা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড বা উভয় শাস্তি হতে পারে। 

আতঙ্কিত অভিবাসীরা, মানবাধিকার সংগঠনের ক্ষোভ

যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত অভিবাসীদের একটি বিশাল অংশ নথিবিহীন অবস্থায় অবস্থান করছেন। নতুন নির্দেশনার ফলে এসব অভিবাসীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে যাদের কাগজপত্রের বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে, তাদের জন্য এই আইন বড় ধরনের ঝুঁকি বয়ে আনবে বলে মনে করছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।

গ্রিন কার্ডধারী, বৈধ ভিসাধারী বা ওয়ার্ক পারমিটপ্রাপ্ত অভিবাসীদের অনেকেই ইতিমধ্যেই নিবন্ধিত। তারপরও এই আইনের কঠোর রূপ এবং তাৎক্ষণিক শাস্তির আশঙ্কায় তারা নতুন করে সতর্ক হচ্ছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও, যেকোনো সময় চেক বা তল্লাশির মুখোমুখি হলে নথিপত্র সঙ্গে না থাকলে সমস্যায় পড়তে হতে পারে।

ট্রাম্প প্রশাসনের এই পদক্ষেপকে সমালোচকেরা অভিবাসনবিরোধী অবস্থানের আরেকটি প্রতিচ্ছবি বলে মনে করছেন। তবে প্রশাসনের দাবি, এটি যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে নেওয়া একটি যৌক্তিক ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।

ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির মূল লক্ষ্য ‘অবৈধভাবে বসবাসকারীদের’ দেশ ছাড়তে বাধ্য করা। সচিব নয়েমও বলেন, যারা অবৈধভাবে থাকছেন, তাদের জন্য আমাদের বার্তা স্পষ্ট: এখনই চলে যান। তিনি আরও জানান, যদি এখন দেশ ছেড়ে যান, ভবিষ্যতে ফেরার সুযোগ থাকতে পারে, কিন্তু আইন অমান্য করলে তা আর সম্ভব নাও হতে পারে।

এদিকে এই নতুন প্রয়োগ নিয়ে একাধিক মানবাধিকার সংগঠন, যেমন ইউনাইটেড ফার্মওয়ার্কার্স অফ আমেরিকা, সিএএসএ এবং মেক দ্য রোড নিউইয়র্ক আইনি চ্যালেঞ্জ এনেছে। তবে আদালত জানিয়েছে, এসব সংগঠন আইন চ্যালেঞ্জ করার পর্যাপ্ত আইনগত অধিকার দেখাতে পারেনি।

প্রসঙ্গত, গত ২০ জানুয়ারি দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর অভিবাসন ইস্যুতে বেশ কড়াকড়ি আরোপ করে ট্রাম্প প্রশাসন। শুরুতে অবৈধ অভিবাসীদের আটক রীতিমতো টটস্থ করে তুলে। এবার সেই কড়াকড়িতে যুক্ত হলো ১৯৪০ সালের এলিয়েন রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট। যা বিদেশি নাগরিকদের নিবন্ধন ও সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড দমনের উদ্দেশ্যে প্রণীত একটি আইন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে, যুক্তরাষ্ট্রে নাৎসি, ফ্যাসিবাদ ও কমিউনিজমের মতাদর্শের বিস্তার নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়। 

এই প্রেক্ষিতে সরকার বিদেশি নাগরিকদের বাধ্যতামূলকভাবে নিবন্ধনের আওতায় আনে এবং রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণা ও কর্মকাণ্ডকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করে। এই আইনের মাধ্যমে ১৪ বছরের ঊর্ধ্বে সকল বিদেশিকে আঙ্গুলের ছাপসহ নিবন্ধন করতে বলা হয়। এছাড়া, যেসব ব্যক্তি সরকার উৎখাতের আহ্বান জানাতো, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো। 

আইনটি ব্যবহার করে অনেক রাজনৈতিক বিরোধী, বিশেষ করে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। ফলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হয় এবং অভিবাসীদের ওপর নজরদারি ও বৈষম্যের অভিযোগ ওঠে। পরবর্তীকালে এই আইনের অনেক ধারা অসাংবিধানিক ঘোষিত হয়।

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন