মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫

শিরোনাম

মেধার নামে দুর্নীতি-কোটা বিরোধীদের আসল চেহারা

রবিবার, এপ্রিল ২৭, ২০২৫

প্রিন্ট করুন

মো. মনিরুজ্জামান মনির: বাংলাদেশে ২০১৮ সালের কোটা বিরোধী আন্দোলন এক প্রকার রাজনৈতিক চক্রান্তের অংশ হিসেবে পরিণত হয়েছিল। যখন আন্দোলনটি শুরু হয়েছিল, তখন দাবি করা হয়েছিল মেধা ও সাম্যের নীতির প্রতিষ্ঠা। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যে আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল এক দখরদারিত্বের অবসান ঘটিয়ে আরেক রাজনৈতিক দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করা। কোটা বিরোধী আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা, যারা বর্তমানে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন, তারা এখন রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও সুবিধার অপব্যবহার করে এক চোরাবালি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা তৈরি করেছেন। ২০১৮ সালের আন্দোলনের পর নুরুল হকের নুরের নেতৃত্বে গণঅধিকার পরিষদ প্রতিষ্ঠা হয়। যাদের বিরুদ্ধে বিকাশে মানুষের কাছে টাকা হাতিয়ে নেয়া, ঠিক মত আয়-ব্যয়ের হিসাব না দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। যার কারণে দলটি একাধিক বার ভাঙ্গনের মুখোমুখিও হয়। ২৪’র আন্দোলনের পর প্রতিষ্ঠা আরেকটি রাজনৈতিক দল এনসিপিও অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে একটি পথে যাত্রা শুরু করেছে। কারণ তাদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে আরো গুরুতর অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে।

এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়া, যিনি বর্তমান ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ও দপ্তরে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত বিশেষ ছাত্র প্রতিনিধি ও ছাত্র প্রতিনিধিরা। তাদের দুর্নীতির বিষয়ের অনুসন্ধান প্রমাণ করেছে যে, তারা শুধুমাত্র “মেধার” নামে নিজেদের ক্ষমতা বিস্তার করেছে, কিন্তু তাদের কার্যকলাপে একের পর এক রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে।

দুর্নীতি ও অবৈধ লেনদেন: এক বছর পরিণত হওয়া দুর্নীতির মহাকাব্য

গত ৯ মাসে কোটা বিরোধী আন্দোলনের নেতাদের কাছ থেকে এমন কয়েকটি তথ্য উঠে এসেছে; যা দেশের জনগণকে চমকে দিয়েছে। আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়া এবং তার সহযোদ্ধারা রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার করেছেন। সরকারী টেন্ডার, নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, এবং প্রকল্পের ব্যয়ের ব্যাপারে তাদের অবৈধ লেনদেনের পরিমাণ কয়েক শত কোটি টাকায় পৌঁছেছে। আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়ার এপিএসের বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া তার বাবার নামে ঠিকাদারী লাইসেন্স নেয়াকে তিনি ‘অন্য কারো ভুল পরামর্শে নেওয়া’ বলে দাবি করে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করলেও আসলে ঠিকাদারী লাইসেন্স নেয়ার বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে না পড়লে নিরবে এই লাইসেন্স দিয়ে প্রভাব বিস্তার করে কাজ বাগিয়ে নেয়া হতো এ ব্যাপারে জনগণ নিশ্চিত। আসিফ মাহমুদের মন্ত্রণালয়ের অধীন ক্রিকেট বোর্ড নানা কারণে খবরের শিরোনাম হচ্ছে। বিপিএলে খেলোয়ারদের পেমেন্ট না দেওয়া, ঘরোয়া ক্রিকেটে ফিক্সিং থেকে সর্বশেষ গোপনে বোর্ড প্রেসিডেন্ট ফারুক আহমেদ কর্তৃক প্রায় ২৫০ কোটি টাকা বিভিন্ন ব্যাংকে স্থানান্তর এবং এসব বিষয়ে ক্রীড়া উপদেষ্টা সাফাই প্রমাণ করে পরিবর্তনের কথা বলে ক্ষমতা গ্রহণ করলেও এ সরকার আসলে কোন ধরণের পরিবর্তনই আনতে পারেনি। সিস্টেম পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও তারা এখন সেই কুলষিত সিস্টেমের সহযাত্রীতে পরিণত হয়েছেন।

রেলপথ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান এবং তার সহকারী ছাত্র প্রতিনিধিরা বিভিন্ন রেলওয়ে প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়মের সাথে জড়িত। ফাওজুল কবির খান তার ব্যক্তিগত ইচ্ছায় ৪ জন ছাত্রকে রেলওয়েকে একটি লাভজনক ও জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার দায়িত্ব দেওয়া একদিকে যেমন প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্নবিদ্ধ তেমনি এটি আইনানুগ বৈধতার দিক থেকেও এক ধরনের কর্তৃত্ব-চ্যুতি ও নিয়ম লঙ্ঘনের প্রমাণ বহন করে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ৪ জন ছাত্র প্রতিনিধি টিকেট কালোবাজারী, চাঁদাবাজি, বদলি-পদোন্নতি-কমিশন বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছেন। যে কারণে ইতিমধ্যে ৩ জনকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তাদের অবৈধ কর্মকাণ্ডের ফলে, দেশব্যাপী রেলপথ উন্নয়নে গতি ও উন্নতি থমকে গেছে, আর জনগণের টাকা অপচয় হচ্ছে। এ ধরনের দুর্নীতি দেশের উন্নয়নকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

উপদেষ্টার ক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা:

উপদেষ্টা পদটি মূলত একটি পরামর্শক পদ। এর দায়িত্ব প্রশাসনিক নয়, বরং সুপারিশ বা পরামর্শ দেওয়া পর্যন্ত সীমিত। কোন স্থায়ী বা সাময়িক সরকারি দায়িত্ব বা সরকারি কোন দপ্তরের অভ্যন্তরীন কার্যক্রমে সরাসরি হস্তক্ষেপ করার অধিকার উপদেষ্টার নেই।

কোন ধরনের ক্ষমতা প্রয়োগকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণে উপদেষ্টাকে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হয়। যদি এমন কোন আদেশ না থাকে সেখানে কাউকে ‘ছাত্র প্রতিনিধি’ হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ার লিখিত সরকারি আদেশ বা গেজেট পাওয়া যায় তবে এটি সম্পূর্ণরূপে একটি অবৈধ প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ।

দন্ডবিধি ও দুর্নীতি দমন আইন অনুযায়ী ব্যাখ্যা: দন্ডবিধি ১৮৬০ এর ধারা ১৬৯ অনুযায়ী সরকারি পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি যদি নিজের ক্ষমতা অপব্যবহার করে কোনে প্রাইভেট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে বেআইনিভাবে সুযোগ প্রদান করে তবে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ অনুসারে, কোন অযোগ্য ব্যক্তি দ্বারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ, ক্ষমতা বা সুযোগের অপব্যবহার হলে তা দুর্নীতির আওতায় পড়ে।

এমনকি বিপ্লবের পর গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা দুর্নীতি-তদবিরে জড়িয়ে পড়ছেন। সম্প্রতি এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব গাজী সালাউদ্দিন আহমেদ তানভীরকে ডিসি নিয়োগ ও বই ছাপানোর ক্ষেত্রে ৪০০ কোটি টাকা কমিশন দুর্নীতির অভিযোগে দল থেকে সাময়িক বহিস্কার করা হয়েছে। যেই ছাত্ররা চাকরিতে সমান সুযোগের জন্য আন্দোলন করেছিলেন তারাই এখন চাকরির চিন্তা বাদ দিয়ে দুর্নীতি-চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়ছেন।

আইনানুগ ব্যাখ্যা: কোটা নীতি ও তার বৈধতা-

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, ২৮ (৪) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রকে অনগ্রসর জনগণের উন্নয়নের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। পোষ্য কোটা এই সংবিধান সম্মত নীতি হিসেবে স্বীকৃত এবং এটি এক ধরনের “এর্ফামেটিভ একশন” হিসেবে সমাজের দুর্বল অংশের জন্য সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে রয়েছে। এছাড়া, সরকারি চাকরি (নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলি) বিধিমালা, ২০১৮ অনুযায়ী, কোটা ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন বা বাতিল একতরফাভাবে করা যায় না এবং এটি সংবিধান ও আইনগতভাবে অবৈধ হবে। তাই, কোটা প্রথা বাতিলের চেষ্টা করা, বিশেষত যখন এটি এক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বা দুর্নীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা শুধু আইনের লঙ্ঘন নয়, বরং রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির চূড়ান্ত পীড়ন সৃষ্টি করছে।

কোটা বিরোধী আন্দোলনের পরিণতি: দুর্নীতির মহামারী-

কোটা বিরোধী আন্দোলনের শীর্ষ নেতা-কর্মীরা, যারা নিজেদের মেধাবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছিলেন, বর্তমানে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ভিতরে দুর্নীতি ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তারা শুধুমাত্র ‘মেধার’ নামে নিজেদের দুর্নীতি শিথিল করতে চেয়েছেন। বাস্তবে, তাদের কার্যকলাপ থেকে স্পষ্ট যে, তারা জনগণের স্বার্থের চেয়ে শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থ দেখছেন। আসিফ মাহমুদ ভূইয়া, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা, রেলপথ উপদেষ্টা এবং অন্য ছাত্র নেতারা, যারা কোটা বিরোধী আন্দোলনের নামে মেধার দাবিতে শোরগোল তুলেছিলেন, এখন মন্ত্রণালয় ও সরকারি দপ্তরে দুর্নীতি ছড়াচ্ছেন। গত কয়েক মাসে তাদের কর্মকাণ্ড থেকে যে সমস্ত দুর্নীতির খবর পাওয়া গেছে, তা দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কার্যকর পদক্ষেপ ও প্রস্তাবনা:

কোটা বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত: সরকারি পদে থাকা ছাত্র প্রতিনিধিদের দুর্নীতির তদন্ত করা প্রয়োজন, এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।

পোষ্য কোটা পুনর্বহাল: কোটা নীতি বাতিলের পরিবর্তে, তা সঠিকভাবে প্রয়োগ করা উচিত যাতে সমাজের দুর্বল অংশের উন্নয়ন নিশ্চিত হয়।

টেন্ডার ও নিয়োগ কমিটিতে স্বচ্ছতা আনা: সকল নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতিতে কোটাভিত্তিক পর্যবেক্ষণ কমিটি চালু করতে হবে যাতে কোনো ধরনের দুর্নীতি এড়ানো যায়।

সংবিধানিক নীতির প্রতি সম্মান: কোটা নীতি শুধু রাজনৈতিক বিষয় নয়, এটি একটি মানবিক এবং আইনি দায়িত্ব। তাই, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত এটি সংরক্ষণ করা এবং এর সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা।

কোটা নয়, দুর্নীতি বন্ধ করা জরুরি-

আজকের দুর্নীতির বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে, কোটা বিরোধী আন্দোলনের নেতারা শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থে জনগণের অধিকারকে বিপর্যস্ত করে রেখেছে। তাদের রাজনৈতিক চক্রান্ত, দুর্নীতি এবং অবৈধ কর্মকাণ্ডের কারণে দেশের উন্নয়ন থমকে গেছে। তাই, এখন আমাদের দাবি হল- কোটা প্রথাকে পুনর্বহাল করা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এটি যে শুধু একটি কোটা বিষয় নয়, বরং একটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব, যা জনগণের জন্য বাস্তব ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবে।

লেখক: কলামিস্ট ও সভাপতি, বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি

সিএন/আলী

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন