গত বছরের শরৎকালের কথা। ডোনাল্ড ট্রাম্প তখনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেননি। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়েও তখন কূটনৈতিক সমাধানের উদ্যোগ ছিল না যুক্তরাষ্ট্রের তরফে। অথচ তখনই ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইসরাইলকে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধের পথে এগিয়ে নিয়ে যান। গোপন বৈঠকে করা হয় হত্যা পরিকল্পনার তালিকা। মাথায় ছিল ওয়াশিংটনের সমর্থন আদায়ের বিষয়টিও। ইসরাইলের বর্তমান ও সাবেক একাধিক কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন।
ইসরাইলের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা আরও জানান, গত বছরের অক্টোবরে ইসরাইল ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে। ইরানের প্রধান মিত্র লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহকে দুর্বল করে। পরে নেতানিয়াহু সামগ্রিকভাবে ইরানে হামলার প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে ইসরাইলি গোয়েন্দা কর্মকর্তারা গোপন বৈঠক করেন। তারা ইরানের পরমাণুবিজ্ঞানী ও সামরিক নেতাদের একটি তালিকা তৈরি করতে থাকেন, যাদের ভবিষ্যতে হত্যার লক্ষ্যে নিশানা করা হতে পারে। একই সময়ে ইসরাইলি বিমানবাহিনী নিয়মিতভাবে লেবানন, সিরিয়া ও ইরাকের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করতে থাকে। উদ্দেশ্য ভবিষ্যতে ইরানবিরোধী হামলার জন্য আকাশপথ পরিষ্কার করা।
এদিকে ইসরাইলি কর্মকর্তারা যুদ্ধের প্রস্তুতির আরেকটি কৌশলগত দিক নিয়ে কাজ করছিলেন। আর তা হলো ওয়াশিংটনের সমর্থন অর্জন করা। ইসরাইলি কর্মকর্তাদের দীর্ঘদিনের বিশ্বাস হলো, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে লক্ষ্যবস্তু করে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণে সামরিক অভিযান চালানো হলে তা এককভাবে ইসরাইলের অভিযান থেকে অনেক বেশি কার্যকর হবে। শেষ পর্যন্ত গত শনিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রকে যুক্ত করেন। তার নির্দেশে মার্কিন সামরিক বাহিনী ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়।
গত শরৎকালজুড়ে ইসরাইলি কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন জো বাইডেন প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। আলোচনার বিষয় ছিল উভয় দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর গ্রীষ্মকালে সংগৃহীত তথ্য। সেইসব তথ্য অনুযায়ী, ইরানের পরমাণুবিজ্ঞানীরা আবার অস্ত্রীকরণের তাত্ত্বিক গবেষণা শুরুর জন্য একত্র হচ্ছেন। এ বিষয়ে জানাশোনা আছে, এমন তিনজন ব্যক্তি এ তথ্য জানিয়েছেন। তবে মার্কিন গোয়েন্দা বিশ্লেষকরা মনে করেননি, ইরানের শীর্ষ নেতৃত্ব এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ মূল্যায়ন বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসনের শাসনামলের বসন্তকালজুড়ে একাধিকবার পর্যালোচনা করা হয়।
ইরানে ইসরাইলের হামলা চালানোর সময় পর্যন্ত এ অবস্থানেই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। সংশ্লিষ্ট পাঁচটি সূত্র ওয়াশিংটন পোস্টকে এ তথ্য জানিয়েছে। তবে ব্যক্তিগত আলোচনায় ইসরাইলের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা বলেছেন, গত মার্চ মাসেই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্র অংশগ্রহণ করুক বা না-ই করুক, সর্বোচ্চ জুন মাসের মধ্যে ইরানে হামলা চালানো হবে। আর এ সিদ্ধান্ত হয় নেতানিয়াহুর গত ৭ এপ্রিল ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাতের আগেই। এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়, চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে ইরান তার আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠন করে ফেলত। একটি সূত্র এমনটা জানিয়েছে।
শেষ পর্যন্ত যখন নেতানিয়াহু ১৩ জুন ভোরে ইরানে আকস্মিক হামলা চালান। আর সে সময় ট্রাম্পের কূটনৈতিক আলোচনা চলছিল।
হামলার সিদ্ধান্তটি নতুন কোনো গোয়েন্দা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নেওয়া হয়নি। বরং ইসরাইল একে একটি ‘অন্যতম সুযোগ’ হিসেবে দেখে আগেই তৈরি করে রাখা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময় হিসেবে বেছে নেয়। পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচিতে ইরানের অগ্রগতির যথেষ্ট প্রমাণ নেতানিয়াহুর কাছে ছিল কি না, এ প্রশ্নে বিশ্বজুড়ে তীব্র বিতর্ক চলছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে এ হামলার বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের ভেতরে টানাপড়েন তৈরি করেছে বলে মনে হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বারবার গত মার্চ মাসে দেশটির জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসি গ্যাবার্ডের দেওয়া মূল্যায়নটি উড়িয়ে দিয়েছেন। তুলসি গ্যাবার্ডের মূল্যায়নে বলা হয়েছিল, ইরানের শীর্ষ নেতৃত্ব পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির নির্দেশ দেয়নি। ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেছেন, তার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির একেবারে কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
নেতানিয়াহু বহু বছর ধরে বলে আসছেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের দ্বারপ্রান্তে। আর সামরিক হামলার মাধ্যমেই ইরানতে থামাতে হবে। তবে সাম্প্রতিক কিছু সাক্ষাৎকারে নেতানিয়াহু স্বীকার করেছেন, পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পর্যায় থেকে ইরান এখনও কয়েক মাস কিংবা এক বছর দূরে রয়েছে। তবে যে বিষয়টি নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই, তা হলো ইরান বিপুল পরিমাণ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করেছে, যা বেসামরিক ব্যবহারের প্রয়োজনীয় মাত্রার অনেক গুণ বেশি। একই সঙ্গে ইরান বিপজ্জনক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ভান্ডার গড়ে তুলেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ইসরাইলি কর্মকর্তা বলেছেন, ইরানে হামলার সিদ্ধান্ত ইসরাইলের জন্য সুযোগ ও প্রয়োজন; এই দুই বিবেচনার একটি সমন্বয়।
ওই ইসরাইলি কর্মকর্তা বলেন, সত্যি কথা বলতে, হামলার জন্য এরচেয়ে ভালো সময় আর ছিল না। ইসরাইলি বাহিনী কখনো এতটা প্রস্তুত ছিল না। আর ইরান ও তার মিত্রশক্তিগুলোও কখনো এতটা দুর্বল ছিল না। কিন্তু শুধু এ কারণেই তারা অভিযান চালায়নি। তারা অভিযান চালিয়েছেন প্রয়োজনীয়তার তাগিদে। আর এই উপলব্ধি থেকে যে আর কোনো বিকল্প ইসরাইলের নেই। যদি ইরান হঠাৎ করে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে এগিয়ে যায়, আর তারা তা টের না পান? কোনো নিরাপত্তাবলয় আর ইসরাইলের জন্য অবশিষ্ট ছিল না। ইসরাইলের সরকারপন্থি টিভি চ্যানেল-১৪-এর এক সাক্ষাৎকারে নেতানিয়াহু বলেছেন, ইরানে হামলার নির্দিষ্ট সময় তিনি দুই সপ্তাহ আগে ঠিক করেন। তবে এ অভিযান চালানোর ‘কঠিন সিদ্ধান্ত’ তিনি কয়েক মাস আগেই নিয়ে রেখেছিলেন।
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন