আজিজুল রমিজ
“ইসলাম নারীকে দিয়েছে সর্বোচ্চ সম্মান”—এই বাক্যটি আমরা প্রায়শই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উচ্চারণ করি। কিন্তু এই সম্মান বাস্তবে নারীর জীবনের কোন কোন ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাটাই আজ সময়ের দাবি। সময় বদলেছে, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর ভূমিকা পাল্টেছে, এমনকি ধর্মীয় ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও এসেছে বিবর্তন। তবু আজও কোরআনের কিছু আয়াত ও হাদিস এমনভাবে ব্যাখ্যা করা হয়, যেন নারীর মর্যাদার চেয়ে নিয়ন্ত্রণই সেখানে মুখ্য। এই প্রবণতা ইসলামের মৌলিক মানবিক চেতনাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে নারীর জন্য যেসব বিধান এসেছিল, তা নিঃসন্দেহে সেই সময়ের তুলনায় প্রগতিশীল ছিল। কিন্তু সমাজ কি চিরকাল এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে? সূরা নিসা (৪:১১)-তে বলা হয়েছে, পুত্র পায় দ্বিগুণ, কন্যা পায় অর্ধেক সম্পত্তি। অনেকের মতে, তখন পুরুষের ভরণপোষণের দায়িত্ব থাকায় এমন ব্যবস্থা ছিল যুক্তিযুক্ত। কিন্তু আজকের সমাজে নারীরাও উপার্জন করছেন, পরিবার চালাচ্ছেন, একক অভিভাবকত্ব পালন করছেন। তাহলে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্পত্তিতে সমঅধিকারের প্রশ্ন কি অপ্রাসঙ্গিক? কেউ কেউ যুক্তি দেন, নারীরা পৈত্রিক সম্পত্তির পাশাপাশি স্বামীর দিক থেকেও কিছু পায়। বাস্তব পরিস্থিতি বলছে, অধিকাংশ নারীরই ন্যায্য অধিকার এখনো অধরাই থেকে যায়। এ নিয়ে নতুন করে ভাবার প্রয়োজন নিশ্চয়ই আছে।
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, ইসলামের বহু আগে প্রাচীন মিশরীয়, কেল্টিক ও হিন্দু সমাজেও নারী-পুরুষ সমানভাবে সম্পত্তির অধিকার পেতেন (Barbara Watterson, Women in Ancient Egypt, 1991)। ভারতে ২০০৫ সালের হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের সংশোধনে নারী-পুরুষের সমানাধিকার নিশ্চিত হয়েছে। খ্রিষ্টান সমাজেও নারীরা গির্জার নেতৃত্বে আসছেন, এমনকি পোপ নির্বাচনের দাবিও উঠেছে। ধর্মীয় ব্যাখ্যার এই বিবর্তনই প্রমাণ করে, সময়ের সঙ্গে ধর্মকে যুক্তিসঙ্গতভাবে ব্যাখ্যা করাই স্বাভাবিক।
সমকালীন ইসলামিক চিন্তাবিদদের অনেকেই এই পরিবর্তনশীল বাস্তবতায় নতুন আলোচনার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। ড. আমিনা ওয়াদুদ তাঁর Qur’an and Woman গ্রন্থে কোরআনের আয়াতগুলোকে নীতিগত নির্দেশনা হিসেবে ব্যাখ্যা করার কথা বলেন, যা সমাজ ও কালের প্রেক্ষিতে পুনঃমূল্যায়নের দাবি রাখে। ফজলুর রহমান তাঁর Islam and Modernity বইয়ে সতর্ক করেন যে, আক্ষরিক ব্যাখ্যায় কোরআনের নৈতিক বার্তা হারিয়ে যেতে পারে। ইরানি দার্শনিক মোহাম্মদ মুজতাহিদ শাবিস্তারি ও কবি-দার্শনিক মুহাম্মদ ইকবালও ইজতিহাদের পক্ষে মত দিয়েছেন—অর্থাৎ সময়ের প্রেক্ষিতে কোরআনের ব্যাখ্যা নতুনভাবে ভাবা প্রয়োজন।
একই আলোচনায় আসে সাক্ষ্যপ্রমাণের বিষয়টি। সূরা বাকারা (২:২৮২)-তে অর্থনৈতিক লেনদেনে একজন পুরুষের সমান দুই নারীর সাক্ষ্য গ্রহণের বিধান রয়েছে। সে সময় নারীরা আর্থিক কর্মকাণ্ডে খুব বেশি জড়িত ছিলেন না। কিন্তু এখন নারী হতে পারেন ব্যাংকের ব্যবস্থাপক, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট কিংবা বিচারক। তাহলে এই আয়াতেরও কি নতুন আলোকে ব্যাখ্যা হওয়া উচিত নয়?
ঋতুকাল সংক্রান্ত আয়াত (সূরা বাকারা ২:২২২)-এ বলা হয়েছে, এটি কষ্টদায়ক সময়, স্ত্রীদের বিশ্রাম দেওয়া উচিত। অথচ সমাজে এখনও অনেকে এটিকে ‘অপবিত্রতা’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন, ফলে নারীকে ধর্মীয় ও সামাজিক কার্যক্রম থেকে দূরে রাখা হয়। এ ব্যাখ্যা কোরআনের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
সম্মান তখনই অর্থবহ, যখন তা স্বাধীনতার আলোকে প্রতিষ্ঠিত হয়। যদি নারীর পোশাক, চলাফেরা, উচ্চশিক্ষা বা পেশা বেছে নেওয়ার অধিকারকে ‘সম্মান’ নামে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তাহলে তা সম্মান নয়—বরং সামাজিক শৃঙ্খল।
নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, স্ত্রীদের প্রতি সদ্ব্যবহারই একজন মুমিনের পূর্ণতার পরিচায়ক (তিরমিজি, হাদিস ১১৬২)। খাদিজা (রা.) ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী নারী, আয়েশা (রা.) ছিলেন জ্ঞানচর্চায় অগ্রগামী। উম্মে সালামা, ফাতিমা, জয়নব (রা.)—কেউই গৃহবন্দি জীবনের প্রতীক ছিলেন না। অনেকেই বলেন, খাদিজা (রা.)-এর স্বাধীনতা ছিল নবুয়তের আগের। কিন্তু প্রশ্ন হলো, নবুয়তের আগের অন্যান্য মহৎ দৃষ্টান্ত আমরা গ্রহণ করি, তাহলে এখানে দ্বৈতমান কেন?
আয়েশা (রা.) যখন জঙ্গে জামালে সক্রিয় ছিলেন, পরে মুসলিম সমাজে নারীর গৃহবন্দি অবস্থান বৃদ্ধি পায়। কেউ কেউ এটিকে রাজনৈতিক ঘটনা বলে ব্যাখ্যা করেন, তবু প্রশ্ন থেকেই যায়—এটি কি ইসলামের রাজনৈতিক দর্শনের প্রকৃত চিত্র?
আজ প্রয়োজন একটি মানবিক ও যুক্তিনির্ভর চিন্তা, যেখানে ধর্ম হবে আলো, ভয়ের উৎস নয়। সময় এসেছে প্রশ্ন করার, যুক্তির চর্চা ও পর্যালোচনার। না হলে অন্ধ অনুসরণই থাকবে, আর বিশ্বাস হারিয়ে যাবে।
এই পুনঃপাঠ আমাদের শেখাবে—কোরআনের মানবিকতা আধুনিক নারীর অভিজ্ঞতার সঙ্গে সংলাপ করতে পারে, যদি তা নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং ন্যায়ের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়।
লেখক: প্রভাষক (ভূগোল), বাজিতপুর রাজ্জাকুন্নেছা সরকারি পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কিশোরগঞ্জ।
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন