শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের বন্ধু ‘থার্ড আই’

সোমবার, নভেম্বর ১৫, ২০২১

প্রিন্ট করুন
দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের বন্ধু ‘থার্ড আই

রুমান হাফিজ: 

মাসুদা আক্তার মণি। নবম শ্রেণিতে পড়াকালীন অ্যাসিড নিক্ষেপের শিকার হোন। নির্মম হৃদয়ের ক্ষোভ কেড়ে নিয়েছিল দুটো চোখ। কিন্তু কেড়ে নিতে পারেনি তার স্বপ্ন। বর্তমানে মণি পড়ছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে শ্রুতি লেখক,বই -শীট সংগ্রহ ছাড়াও শীটগুলো রেকর্ড করা নিয়ে বেশ চিন্তায় ছিলেন, মনে করছিলেন এ যেন আরও কঠিন সময় এলো। এমন দিনে মণির পাশে দাড়ালো  চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘থার্ড আই’। যারা দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীদের সহায়তায় কাজ করে আসছে। ‘থার্ড আই’ এর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর মণির কাছে মনে হলো, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটা নিয়ে আর চিন্তার কিছু নেই। শুধু মণিই নয়, তার মতো অসংখ্য দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বন্ধু হয়ে স্বপ্ন দেখাচ্ছে  ‘থার্ড আই’।

শুরুটা গল্পটা…

২০১৮ সাল। মাসরুর ইশরাক তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রথম বর্ষে। অক্টোবর মাসে ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা চলে এলো। দেখলেন, তিনিসহ অন্যান্যরা যখন পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত সেখানে কিছু দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বন্ধু শ্রুতিলেখক খোঁজা, শীট রেকর্ড করে দিবে এমন মানুষ খুঁজছে। তখন তাদের সাথে কথা বললেন মাসরুর। জানতে পারলেন, প্রতিবছরই নাকি সব দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের এসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যেহেতু সেসময় সবারই পরীক্ষা চলে তাই অনেকেই শ্রুতিলেখক পান না। ফলে কষ্টের পাশাপাশি কখনো শিক্ষাজীবনের অনেক বছর নষ্টও হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয় না। সিদ্ধান্ত নিলেন, পরীক্ষার পর এমন একটা দল গঠন করবেন যারা এই বিষয়টা নিয়ে কাজ করবে। পরিচিত এবং কিছু বন্ধু বান্ধব নিয়ে কাজ শুরু করলেন। ২০১৯ সালের ১৬ জানুয়ারী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ মিনারে প্রথম মিটিং। মাত্র ৮ জন স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে ‘থার্ড আই’ এর যাত্রা শুরু হয়।

তাদের যতো সেবা:

এখন মূলত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করছেন তারা। তবে ইচ্ছা আছে ভবিষ্যতে সকল বয়সের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সহ সকল ধরনের শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করার। বিগত দুই বছর যাবত স্বেচ্ছাসেবীরা সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে সেবা প্রদান করে আসছেন।

উল্লেখযোগ্য কিছু কাজের মধ্যে রয়েছেঃ

পাঠ্য বিষয়সমূহের অডিও রেকর্ড: তারা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ পড়ুয়া দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবিষয় সমূহ যেমন, প্রয়োজনীয় বই, শীট ইত্যাদি রেকর্ড করে দেন।

শ্রুতিলেখক হিসেবে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ: সেসব দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার সময় শ্রুতিলেখক হিসেবে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন।

দক্ষতা উন্নয়নমূলক কার্যক্রম: বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদেরকে বিতর্ক,কম্পিউটার,ব্রেইল,স্পোকেন ইংলিশ এবং
শুদ্ধ উচ্চারণ ও আবৃত্তি উপর বিনামূল্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে আসছেন।

এছাড়া সৃজনশীলতাকে সারা বাংলাদেশের নিকট উপস্থাপনের লক্ষ্যে তারা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সৃজনশীল কর্মকাণ্ড তাদের ইউটিউব চ্যানেল এবং ফেসবুক পেজের মাধ্যমে মানুষের সামনে তুলে ধরছেন।

‘থার্ড আই’ এর যাত্রা শুরু হয়েছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সেবা দেওয়ার মাধ্যমে। ধীর পায়ে সে যাত্রা শুরু  হয় চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন প্রতিবন্ধী স্কুল কলেজেও। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের নিকট সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীদের মোবাইল নাম্বার দেওয়া হয়। যেকোনো প্রয়োজনে তারা কল করলে সময়মতো তাদের কাছে পৌঁছে যান ‘থার্ড আই’ এর স্বেচ্ছাসেবকরা। ২০১৯ সালের বার্ষিক পরীক্ষায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সকল দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শ্রুতিলেখক হিসেবে তারা কাজ করেছেন এবং তাদের প্রয়োজনীয় বইপত্র রেকর্ড করে দিয়েছিলেন। ২০২০ সালে করোনা পরিস্থিতির জন্য সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। তখন তারা চট্টগ্রামের বাইরে রাজশাহী, যশোর, ফেনী এবং ঢাকায় ‘থার্ড আই’  স্বেচ্ছাসেবী সংগ্রহ করে। পাশাপাশি দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের চাকরির প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় কিছু বইও রেকর্ড করে সেগুলো ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড দিয়েছেন।

সব বাঁধা মাড়িয়ে..

প্রতিবন্ধকতার প্রধান জায়গাটা হল অর্থ। থার্ড আই তাদের স্বেচ্ছাসেবীদের কাছ থেকে কোনো চাঁদা নেন না। ফলে নিজস্ব ফান্ড বলে সত্যিকার অর্থে কিছুই নেই। ফর্মের শুভেচ্ছা মূল্য ২০ টাকার মাধ্যমে অল্প কিছু অর্থ আসে যা দিয়ে এতোদিন আর্থিক প্রয়োজন কিছুটা মিটিয়েছেন। কিন্তু এখন চট্টগ্রাম জেলার বাইরেও তাদের কার্যক্রমের বিস্তৃতি। সাংগঠনিক কার্যক্রম এবং সেবা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য কোনো ডোনেশন এবং আর্থিক সহায়তা নেই, যেটা তাদের জন্য সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা।

স্বপ্ন যতদূর...

থার্ড আই স্বপ্ন দেখতে এবং স্বপ্ন দেখাতে ভালোবাসে। তারা সেই সকল স্বপ্নের বাস্তবায়ন করতে সমন্বিত ভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে সংগঠনটি দক্ষিণ এশিয়ার সকল শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের তাদের সেবার আওতায় নিয়ে আসতে চায়। সকল শারিরীক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুস্থ স্বাভাবিক মানুষদের ন্যায় দক্ষ করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে CBT&A সিস্টেমে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সর্বপরি একটি আদর্শ এনজিও রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে দেশ এবং দেশের বাইরের শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সেবা করতে চায়।

“ডিজেবল স্টুডেন্ট এসোসিয়েশ” চবি’র সভাপতি মোঃ সাজ্জাদ হোসাইন সাজু বলেন, পরীক্ষার সময়ে আমাদের অতিরিক্ত চিন্তা করতে হতো। কারণ চাইলেই যে কেউ সহযোগিতা করতে পারতো না। থার্ড আই সংগঠন হওয়ার পর থেকে আমাদের শ্রুতি লেখা থেকে শুরু করে রেকর্ড, বইপত্র সংগ্রহ সবকিছু সহজ হয়ে যায়। এজন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা সংগঠনের প্রতি। আশাকরি আমাদের পাশে তারা সবসময়ই থাকবে এবং তাদের কার্যক্রম দেশব্যাপী ছড়িয়ে যাবে।

থার্ড আই এর প্রতিষ্ঠাতা এবং চিফ এডমিনিস্ট্রেটর মাসরুর ইশরাক বলেন, “আমরা জানি, এসডিজি- ২০৩০ এর অন্যতম একটি লক্ষ্য হল, Quality Education: Ensure inclusive and equitable quality education and promote lifelong learning opportunities for all.

শিক্ষা অর্জনে যেন লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ, প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদি কোনো কিছুই বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা- ২০৩০ অর্জনে বাংলাদেশকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যেই  ‘থার্ড আই’ এর জন্ম। আমাদের ‘থার্ড আই’ বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগ্রহনে সকল প্রকার প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে নিজেদের যেন স্বাভাবিক মানুষদের মত দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে সেই লক্ষ্যে কাজ করছে।”

প্রতিবন্ধী মানেই প্রতিভাবন্দী নয় বলে মনে করেন সংগঠনের চিফ কো-অর্ডিনেটর সাবিরা আহমেদ সারা। তিনি বলেন, ” ‘থার্ড আই’ সংগঠনের সূচনালগ্ন থেকেই আমি এর সঙ্গে যুক্ত আছি। এর মাধ্যমে আমি আমার বিশেষ বন্ধুদের পাশে দাঁড়াতে পেরে নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান মনে করি। আমি তাদের জন্য বইসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় অডিও রেকর্ড করেছি, শ্রুতিলেখক হিসেবে কাজ করেছি। কাজের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি, আমাদের এই বিশেষ বন্ধুরা অত্যন্ত মেধাবী এবং পরিশ্রমী।”

সংগঠনের উপদেষ্টা এবং চবি সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. হানিফ মিয়া বলেন, “কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গীতবিতানে লিখেছিলেন ‘অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্রাণ’। কে দেবে আলো, কে দেবে প্রাণ! নিয়তিই যার আলো কেড়ে নিয়েছে! অন্ধজনে আলো সঞ্চারিতে থার্ড-আই’এর প্রচেষ্টা। একটি মানবিক বোধের জায়গা থেকে,দ্বি-নেত্র যার অন্ধকার, সংগঠনটি সেখানে তার তৃতীয়-নয়ন হয়ে অন্ধকার বিদূরিত করার অভিপ্রায়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। সংগঠনটি উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করবে। এমন একটি মানবিক সংগঠনের অভিযাত্রায় মানবিকবোবোধ সম্পন্ন মননের সম্মিলন সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে যেমন আমাদের দায়িত্বশীল করে গড়ে তুলবে, তেমনি এই দায়িত্বশীলতা অন্ধজনে আলো দেবে, মৃতজনে দেবে প্রাণ।”
.

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন