শাহাবুদ্দিন শুভ
সিলেট এক সময় ছিল বাংলাদেশের প্রকৃতির স্বর্গভূমি। পাহাড় থেকে গড়িয়ে আসা স্বচ্ছ জলধারা, সবুজ বাগান আর সীমান্ত অঞ্চলের অদ্ভুত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মানুষকে মুগ্ধ করত। শ্রীমঙ্গল, মাধবকুণ্ড, লালা খাল, জাফলং কিংবা ভোলাগঞ্জ—প্রতিটি স্থানই ছিল প্রকৃতির নিজ হাতে আঁকা এক অনন্য সৃষ্টি। স্কুল-কলেজ জীবনে যখন পর্যটন কেন্দ্রের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা, তখন বন্ধুবান্ধবদের আড্ডা, ভ্রমণ ও স্মৃতিচারণের শেষ আশ্রয় ছিল এই স্থানগুলো। বিশেষ করে জাফলং অনেকের কাছে যেন প্রথম প্রেমের মতো।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আজ সেই সৌন্দর্য দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। অতিমাত্রায় পাথর উত্তোলন এবং অব্যবস্থাপনার কারণে জাফলং ও আশপাশের পর্যটনকেন্দ্রগুলো তাদের শ্রী হারিয়েছে। একসময় বারকি নৌকা দিয়ে ভেসে আসা পাথর সংগ্রহই ছিল স্থানীয়দের জীবিকার অংশ। কিন্তু যখন মেশিন ব্যবহার শুরু হলো, তখনই প্রকৃতির ওপর নেমে এলো ধ্বংসযজ্ঞ। এক্সক্যাভেটর দিয়ে পাহাড় খোঁড়া, বোমা মেশিন দিয়ে নদীর তলদেশ ভাঙা—এ যেন প্রকৃতিকে নির্মমভাবে হত্যা করার মতো।
২০২৪ সালের আগস্টের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর এই লুটপাট নতুন মাত্রা পেয়েছে। সিলেটের কোয়ারিগুলোতে দিনরাত প্রকাশ্যে চলছে পাথর উত্তোলনের মহোৎসব। গত এক বছরে এ মাত্রা বেড়েছে বহুগুণ। নদীর বুক চিরে, পাহাড় ভেঙে চলছে সীমাহীন ধ্বংসযজ্ঞ। এতে শ্রমিক মারা যাচ্ছে, নদীর গতিপথ বদলে যাচ্ছে, কখনো বা পর্যটকরা চোরাবালিতে প্রাণ হারাচ্ছেন—তবু প্রশাসন নির্বিকার দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
সবাই জানে ব্যবসায়ী ও স্থানীয় রাজনৈতিক সিন্ডিকেট এ খেলায় যুক্ত। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সত্য হলো—প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরও এখন এ লুণ্ঠনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে নাটকীয় অভিযানের নামে কিছু পাথর উদ্ধার করে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়, যেন জনগণকে দেখানোর জন্যই এ প্রদর্শনী। অথচ ভাঙা পাথর নদীতে ফেলে দিলে প্রকৃতি আগের অবস্থায় ফিরে আসবে না, বরং নদীর প্রবাহে নতুন বিপদ ডেকে আনবে।
প্রশ্ন উঠেছে—রাষ্ট্রের ভূমিকা কোথায়? প্রশাসন যদি চুপচাপ থাকে, আদালতের রায় অমান্য হয়, পরিবেশবাদীদের আন্দোলন উপেক্ষিত হয়—তাহলে প্রকৃতি রক্ষা করবে কে? রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের নীরবতা ও প্রভাবশালীদের লোভ আজ গোটা সিলেটকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
চার বছর আগে আমি সাদা পাথরে গিয়েছিলাম দু’বার। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে সিলেটপিডিয়া-র জন্য একটি লেখা লিখেছিলাম, যা এখনও পাঠকরা পড়েন। পাংথুমাইয়ের ঝরনাও দেখেছি, যদিও তা বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে নয়, তবু তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবর্ণনীয়। এসব জায়গায় দাঁড়িয়ে আজ মনে হয়—যে সৌন্দর্য একসময় মুগ্ধ করত, তা এখন ধ্বংসযজ্ঞের মুখে।
বাস্তবতা হলো—সিলেটের প্রায় প্রতিটি পর্যটনকেন্দ্রেই পাথর আছে, আর সেসব জায়গা থেকেই পাথর খেকোরা তাদের লুণ্ঠন চালাচ্ছে। এই ধ্বংসযজ্ঞ ঠেকাতে না পারলে একদিন শুধু প্রকৃতিই নয়, গোটা দেশকেই এর খেসারত দিতে হবে।
তাই এখন সময় এসেছে কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার-
অবিলম্বে সব ধরনের মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন বন্ধ করতে হবে। সিন্ডিকেটে জড়িত ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে স্থানীয়দের জন্য। পর্যটন শিল্পে বিনিয়োগ বাড়িয়ে প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হবে।
প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয়—ইতিহাস বারবার এ শিক্ষা দিয়েছে। সিলেটের পাহাড় ও নদীর এই অবাধ ধ্বংস একদিন গোটা দেশকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিতে পারে। তাই রাষ্ট্রকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে—সে কি প্রকৃতিকে রক্ষা করবে, নাকি ধ্বংসযজ্ঞের অংশ হয়ে থাকবে।
লেখক: ফ্রান্স প্রবাসী সাংবাদিক ও কলামিস্ট
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন