শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

বাংলাদেশের ৫০ বছর বনাম নারীর অগ্রযাত্রা

শুক্রবার, ডিসেম্বর ১০, ২০২১

প্রিন্ট করুন
বাংলাদেশের ৫০ বছর বনাম নারীর অগ্রযাত্রা

নাহিদ নেওয়াজ :

“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,অর্ধেক তার করিয়াছে নারী,অর্ধেক তার নর”।               

কাজী নজরুল ইসলামআদিম সাম্যবাদের ইতিহাস থেকে বর্তমান পুঁজিবাদ সমাজের এই উত্তরাধুনিক যুগে  নারীর পথযাত্রা ছিলো বন্ধুর।তবু সভ্যতা ও সমাজ বিনির্মাণে নারীর ভূমিকা মাপকাঠির তুলাদন্ডে অনির্ণীত। মাতৃতান্ত্রিক সেই সমাজ থেকে বর্তমান পুরুষতন্ত্রের এ জয়জয়কার যুগেও নারী ছাড়া সমাজ ও জীবনের অগ্রযাত্রা অচিন্তনীয়।

নারীর হাতেই আবিষ্কার  সভ্যতার চাবিকাঠি কৃষি।নারীই সেই শক্তি যা উদরে ধারণ করে নারী-পুরুষ উভয়।বিশ্বইতিহাস থেকে যদি ছোট্ট গন্ডি বাংলাদেশের আজ এই মুহুর্ত পর্যন্ত নারীদের অবদান নিয়ে বলা শুরু করি তাহলে যে লম্বা ফিরিস্তি তা অল্প কথায় শেষ হওয়ার নয়। তবুও সংক্ষেপে তুলে ধরার প্রয়াস স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই মাহেন্দ্রক্ষণে বাংলাদেশের নারীদের ভূমিকা এবং একই সাথে তাদের জীবনযাত্রার অগ্রযাত্রায় কিরূপ প্রভাব পড়েছে।

এক্ষেত্রে নারী শিক্ষায় নারীর অবদান ও অংশগ্রহণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য বিষয়।মনে পড়ে যায়,’নেপোলিয়ান বেনোপোর্ট’ এর সেই উক্তিটি,” তুমি আমাকে শিক্ষিত মা দাও,আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দেবো”।

এ কথার মর্মার্থ সুতীক্ষ্ণ চিন্তায় ধারণ করেছিলেন বেগম রোকেয়া।অধিকার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস শুরু সেই বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের হাত ধরে এবং এখনো তা বর্তমান। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৭১’এর মুক্তিযুদ্ধ এবং এই বাংলাদেশের বর্তমান সকল ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।আর এক্ষেত্রে লক্ষণীয় শিক্ষিত ও সচেতন নারীদের ভূমিকা অগ্রগণ্য  বর্তমান সরকার বাংলাদেশের মানণীয়  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাই নারী শিক্ষার প্রতি দিয়েছেন সর্বোচ্চ সহোযোগিতা।

তারই ফলাফল বাংলাদেশের নারীদের শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতি। ২০১৮ সালে তাই তিনি নারী শিক্ষার উন্নয়ন এবং ব্যবসায়িক উদ্দ্যোগে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য পেয়েছিলেন “গ্লোবাল উইমেনস লিডারসিপ এ্যাওয়ার্ড” জাতিসংঘের ‘৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ ও ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ’ এ্যাওয়ার্ডও তিনি পান।

শিক্ষা অধিদপ্তরের এ্যানুয়াল রিপোর্ট অন পাবলিক ইন্সট্রাকশন ফর দ্যা ইয়ার ১৯৭০-৭১ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, তখন মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী ছিলো ২৮ শতাংশের কিছু কম।বর্তমানে, সরকারের শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষায় মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী প্রায় ৫১ শতাংশ। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকেও সর্বমোট শিক্ষার্থীর প্রায় অর্ধেক ছাত্রী।

এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থীর ৩৮ শতাংশ ছাত্রী।এ প্রেক্ষিতে আরো একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন, মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল বা এমডিজির আটটি গোল বাংলাদেশ সফলভাবে সম্পন্ন করে। তার মধ্যে দুই নম্বর লক্ষ্য ‘সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা’  অর্জন,তিন নম্বর লক্ষ্য ‘জেন্ডার সমতা অর্জন এবং নারীর ক্ষমতায়ন’ পাঁচ নম্বর লক্ষ্য ‘মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়ন’ এর মতো সকল লক্ষ্য লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বলা হয় এমডিজির ‘রোল মডেল’।

শিক্ষার হার বৃদ্ধি ও নারীদের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে নারী ক্ষমতায়নে সরকারের সাফল্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।নারী উন্নয়ণের সার্বিক সূচকে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২৪ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয় শীর্ষস্থানীয়।বিশ্বের ৩৬ টি নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। লিঙ্গ সমতায় দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ প্রথম।জাতীয় সংসদে বর্তমানে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ৫০ এ উন্নীত করা হয়েছে যা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচনে সংরক্ষিত মহিলা আসন ছিলো ১৫ টি। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে সাংবিধানিকভাবে নারীর সমান অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করার লক্ষ্যে স্বাধীনতা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ নারীদের পুর্ণবাসন ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ১৮ ই ফেব্রুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক নারী পুণর্বাসন বোর্ড গঠনের মাধ্যমে শুরু হয় নারী উন্নয়ণের প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা।

তারই ধারাবাহিকতায়, বর্তমান বাংলাদেশে নারী শিক্ষার অগ্রগতির যে রূপ আমরা দেখতে পাই তা অধিক প্রশংসার দাবীদার। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় নারী সাংসদ রয়েছেন ৭২ জন।প্রধানমন্ত্রী,বিরোধী দলীয় নেত্রী,স্পিকারসহ বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীও নারী। শিক্ষার অগ্রযাত্রায় নারী যে সুযোগ পেলে পুরুষের পাশাপাশি একই কাতারে নানা রকম চ্যালেঞ্জিং পেশায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে করতে পারে তা আমাদের বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় নারীদের ভূমিকা থেকেই স্পষ্ট।উচ্চ আদালতের বিচারক থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন,মন্ত্রোনালয়ের সচিব,বিজিএমই এর সভাপতি এমনকি জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমেও সরব ও সফল পদচারণার মাধ্যমে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন বাংলাদেশের শিক্ষিত নারীরা।

প্রায় এক হাজার নারী সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের দায়িত্ব পালন করছেন। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, জেলা প্রশাসক, মানবাধিকার কমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে চলেছে বাংলাদেশের এ শিক্ষিত নারীগোষ্ঠী।ড. ফিরদৌস কাদরী যিনি ল’রিয়েল ইউনেস্কো ফর উইম্যান সাইন্স এ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।মাহজাবিন হক নাসায় দ্বিতীয় দফা ইন্টার্নিশিপ শেষ করে সেখানেই যোগ দিতে যাচ্ছেন।

শিখার অগ্রগতি আমাদের মাঝে যে সচেতনতা সৃষ্টি করেছে তারই উদাহরণ উচ্চ শিখরে পৌছানো, বাংলাদেশের নামকে উজ্জ্বল করার মতো কিছু উদাহরণ।যেমন এভারেস্ট বিজয়ী প্রথম নারী নিশাত মজুমদার ২০১২ সালের ১৯ মে শনিবার এবং  ওয়াসফিয়া নাজরিন এখন পর্যন্ত সর্বকনিষ্ঠ বাংলাদেশী নারী হিসেবে ২০১২ সালের ২৬ মে শনিবার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্টের চূড়ায় আরোহন করেন।ওয়াসফিয়া নাজরিনই বাংলাদেশের প্রথম পর্বত আরোহী হিসেবে সাত মহাদেশের সাতটি সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ (সেভেন সামিট) জয় করেছেন।

এ রকম বিশ্বের বুকে নাম লেখাতে সক্ষম বাংলাদেশের হাজার হাজার নারী।এমনই একজন নাজমুন নাহার। যিনি গত ২১ বছর ধরে স্বাধীনতার ৫০ বছরে ১৫০ টি দেশে পৌছে দিয়েছেন বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা।যার জন্য ২৭ নভেম্বর, ২০২১ এ অর্জন করেছেন ‘পিস রানার ‘ সম্মাননা। নারী শুধু নারী নয়,এক অসীম শক্তির অধিকারী মাতা,কন্যা,স্ত্রী যারা  সময় ও সুযোগের মাধ্যমে গড়তে পারে পরিবার,সমাজ ও দেশ।স্বাধীনতার এ ৫০ বছরে বাংলাদেশের নারীরা অভাবনীয় ভূমিকা পালন করেছেন দেশ ও জাতি গঠনে।এ ধারা অব্যাহত থাকলে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের নারীরা হয়ে উঠবো জলন্ত দৃষ্টান্ত, উজ্জ্বল আইকন।

শিক্ষিত নারীদের মতো তুলনামূলক কম শিক্ষিত নারীরাও পিছিয়ে নেই।গত ২০ বছরে বাংলাদেশে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে,এবং পোশাক শিল্পের অধিকাংশ শ্রমিকই নারী।যাদের শ্রমে রপ্তানী খাতে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম।কৃষি কাজের খাদ্য শস্য উৎপাদনে যে ২১ ধরণের কাজ তার মধ্যে ১৭ ধরনের কাজই নারীর দ্বারা সম্পন্ন হয়। তাই দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় নারীর ভূমিকা অপরিসীম।

এ উপলব্ধি থেকেই বেগম রোকেয়া বলেছেন, “যে শকটের একচক্র বড় এবং একচক্র ছোট সে কেবল একই স্থানে ঘুরিতে থাকিবে- গৃহ কোণ”।

বাংলাদেশের উন্নয়নের এ ধারাকে অব্যাহত রাখতে প্রয়োজন নারীবান্ধব নিরাপদ সমাজ যেখানে ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ,নারী নির্যাতন, বাল্য বিবাহ,যৌতুক প্রথার অবসান ঘটবে এবং নারীরা তাদের মেধা ও মননের বিকাশ ঘটিয়ে দেশ, জাতি ও আত্মোন্নয়ন করতে সক্ষম হবে।দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে নিজেকে পরিচিত করবে বিশ্বপরিচয়ে।

লেখকঃ শিক্ষক, টিভি উপস্থাপক 

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন