নাহিদ নেওয়াজ:
মুশতারী শফী যিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৫ ই জানুয়ারি, ১৯৩৮ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুরে।স্বামী মোহাম্মদ শফী পেশায় ছিলেন ডাক্তার।১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল স্বামী ও এহসানুল হক আনসারী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে শহীদ হন পাকিস্তানীদের হাতে।তিনি দমে যাননি,হার মানেননি। ১৯৭১,১৬ ই ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শব্দসৈনিক হিসেবে কন্ঠযোদ্ধার ভূমিকা রেখে যান।এ জন্য তিনি শহীদ জায়া হিসেবেই বেশি পরিচিত। একই কারণে ২০১৬ সালে তিনি বাংলা একাডেমি ‘ফেলোশিপ’ অর্জন করেন।বাংলাদেশ ঘাতক দালাল নির্মূল আন্দোলনের একজন অন্যতম সংগঠক তিনি।’বান্ধবী’ নামে একটি মাসিক সাময়িকী বের করেন ১৯৬৩ সালে।এই সংঘকে কেন্দ্র করে ‘বান্ধবী’র প্রচারের জন্য মেয়েদের প্রেস নামে একটি ব্যতিক্রমী মুদ্রণ সংস্থাও তৈরি করেন।তিনি সাহিত্যের নানা ক্ষেত্রে তার লেখালেখির মাধ্যমে নিজের সাহসী, লড়াকু ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন।তাঁর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থ ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী’, ‘চিঠি’, ‘জাহানারা ইমামকে’, ‘স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন’ উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। ২০২০ সালে তিনি বেগম রোকেয়া পদক পান।
মুশতারী শফী যার জীবনটি পুরো একটি ইতিহাসের স্বাক্ষর বহন করে। আমি যখন প্রথম দেখি,তখন মনে হলো একজন সত্তোরোর্ধ বয়স্ক ভদ্রমহিলা যার হাঁটতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার আলোচনা শুনলাম। আশ্চর্য ব্যাপার,আমি ভুলেই গেছি তিনি একজন বয়স্ক মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা, ইতিহাস বলতে বলতে এতো তেজ্বোদ্দীপ্ত আর বলিষ্ঠ মনে হয়েছিলো যেন চাক্ষুস একজন যোদ্ধাকে দেখছি যুদ্ধের ময়দানে।বলে যাচ্ছিলেন, অনায়াসে,যুদ্ধে তাঁর স্বামী যোদ্ধাদের চিকিৎসা করেছেন,তিনি রান্না করে গেছেন একের পর এক দেশব্রতী মানুষদের জন্য।তিনি বলতে লাগলেন, চট্টগ্রামে আমার এই ছোট্ট বাড়িটি মুক্তিযুদ্ধের ঘাঁটিতে পরিণত হলো।আমার বাড়িতে জমা হতো মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র।কি অকপটে অকুতোভয়, নির্ভীক আর স্পষ্টবাদী উচ্চারণে বলে গেলেন কথাগুলো।পাক হানাদার বাহিনীর কথা বলতেই যেন, চোখে মুখে আগুন ঠিকরে উঠলো। মনে হলো স্বামী হারানোর, ভাই হারানোর যন্ত্রণা তাঁকে কুকড়ে দিলো। তারপরই আবার বলে গেলেন আমাদের মতো তরুণদের জন্য।তোমরা মুক্তিযুদ্ধ দেখোনি,কিন্তু একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছো।আমার খুব কষ্ট হয় যখন দেখি এখনও বাংলার বুকে তোমাদের মতো তরুণরা ওই হানাদার বাহিনীর মতো আচরণ করে।মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করে দেখে।আবার তোমাদের মাঝেই এমন তরুণদের সংখ্যাই বেশি যারা দেশকে ভালোবাসে। মুক্তিযুদ্ধের মর্মার্থ বোঝে।তোমাদের জিন্য অহংকার হয়।তিনি দাঁড়াতে পারছিলেন না,তবু যেন তার এই গল্প শেষ হয় না।
আমরাও খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম।আর দেখছিলাম, একটি জ্বলন্ত অগ্নিশিখাকে যিনি কি চমৎকার ভাবে শব্দের জালে ঘটনা প্রবাহকে বলছিলেন। চলে গেলেন আপনি। শ্রদ্ধা, ভক্তি ও ভালোবাসায় আগামী প্রজন্ম মনে রাখবে আপনার নাম। দীর্ঘদিন অসুস্থতার পর গত ২০ ডিসেম্বর পরলোকগমন করলেন। আমরা শোকাহত।আপনার মতো নারী নেত্রী,সাহসী যোদ্ধা,সাহিত্যিক,নারীদের আশ্রয়স্থল যেন বাংলার ঘরে ঘরে তৈরি হয় সে প্রত্যাশাই আমরা করি। আপনার আত্মার মাগফেরাত ও প্রার্থনা করি। পরপারে আপনি যেন ভালো থাকেন আমাদের শহীদজায়া মুশতারী শফী।
লেখক: গল্পকার, টিভি উপস্থাপক
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন