রুমান হাফিজ : দেশের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম চলছে। অনেকেই চান্স পেয়েছে কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে। কলেজ জীবনের সীমাবদ্ধ গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিস্তৃত জায়গায় নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে সময় তো লাগবেই। তবে এই সময়টাতে কিছু ভালো চর্চা গড়ে তুলবে ভবিষ্যতের জন্য সফলতার শিখরে। জাফর ইকবাল স্যার বলেছিলেন, “একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসরুমের ভেতরে একজন ছাত্র/ছাত্রী যেটুকু শিখে তার চেয়ে অনেক বেশি শিখে ক্লাসরুমের বাইরে।” সুতরাং, বিশ্ববিদ্যালয় এক বিশাল জায়গা। দেশের বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন ছেলেমেয়েরা আসে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে, সবার মতামত এবং চিন্তাধারা একরকম না-ও হতে পারে। অনেকের জন্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ে খাপ খাওয়ানো হয়ে পড়ে কঠিন। কী করা উচিত, কী করা উচিত নয়, আর সবার সাথে কীভাবে সুন্দরভাবে মিলেমিশে থাকা যায়। এসব নিয়েই আমাদের এবারের আয়োজন।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন শাহ লোকমান চৌধুরী৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুটা কেমন হবে? তার মতে, “বিশ্ববিদ্যালয় এক স্বপ্নের ঠিকানা।এখান থেকে অনেক প্রতিভা বিকশিত হয়ে বেরিয়ে যায় মানবতার সেবায় ব্রতী হতে,আবার অনেকে স্রোতের সাথে গা ভাসিয়ে হারিয়ে যায় অতল গহ্বরে। আমার পরামর্শ থাকবে যাই করনা কেন লক্ষ্য যেন ঠিক থাকে। এখানে দেশের নানান প্রান্ত থেকে নানান ধরনের শিক্ষার্থী আসে। সবার সাথে খাপ খাইয়ে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার গুণ যত তাড়াতাড়ি অর্জন করতে পারবে তত সুবিধা হবে। তবে হ্যাঁ, স্রোতের সাথে গা ভাসিয়ে আধুনিকতার নামে নিজের স্বকীয়তা হারানো ঠিক হবেনা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তুমার আচার-ব্যবহার। বিশ্ববিদ্যালয়ে তুমি একটি নির্দিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিত্ব কর। ফলে তোমার আচরণ তোমার এলাকার ভাবমূর্তিকে প্রভাবিত করবে। তাই বড়দের সাথে সৌহার্দপূর্ণ ব্যবহার এবং সহপাঠিদের সাথে অমায়িক আচরণ এর মাধ্যমে একটি উন্নত ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারাই স্বার্থকতা।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন ইব্রাহিম খলিল মুহিম। বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুটা নিয়ে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হচ্ছে অনার্স প্রথম বর্ষ। বলা হয়ে থাকে – ”প্রথমবর্ষ ভালোভাবে অভারকাম করা মানে সমাবর্তনের গাউন নিজের গায়ে জড়ানোর জন্য শুধু দিন গোনা।” এসময় শতকরা ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী তাদের বাবা মায়ের আদর যত্ন ছেড়ে, চির পরিচিত গ্রাম,আত্মীয়স্বজন,বন্ধুদের ফেলে এসে অচেনা শহরে অচেনা ক্যাম্পাসে নানাবিধ শঙ্কা আর কল্পনার প্রিয় ক্যাম্পাসে ভর্তি হয়। বিভিন্ন ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করে বছর শেষে ভাল রেজাল্ট করা এবং পরিবেশের সাথে খাপ খেয়ে চলাটাই এসময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কোন অবস্থাতেই ইয়ার ড্রপের চিন্তা মাথায় আনা যাবে না,এটা ভুলে যেতে হবে। সাবজেক্ট পরিবর্তন বা ভার্সির্টি পরিবর্তন এসব চিন্তা করে গা ছাড়া ভাব নিয়ে রেজাল্ট খারাপ করাটা কোন ভাবেই সমীচীন হবে না। এজন্য পজিটিভ মেন্টালিটির ক্লাসমেট, সিনিয়র এবং শিক্ষকদের সাথে সর্ম্পক রাখা এবং তাদের কাউন্সিলিং নেওয়া দরকার। পড়াশুনার পাশাপাশি এসময় সমমনা কয়েকজন মিলে হয়ে উঠতে পারো ছোট খাটো উদোক্তা। নিজের খরচ তো চলবেই আর চার বছরের মধ্যে দেখবে যে এটা ভালো্ই দাড়িয়ে যাচ্ছে। সময়টা হেলায় যাতে না নষ্ট না হয় সে জন্য করতে হবে প্রপার প্ল্যান অব একশন।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ফারহানা পিয়া প্রথম থেকেই ক্লাসে মনোযোগী থাকাকে অগ্রাধিকার দিয়ে বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমরা সকলেই একটি কথা শুনে এসেছি যে,”একবার বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকে গেলে আর কোনো পড়ালেখা নেই, কেবল ফুর্তি আর ফুর্তি”। কথাটা ঠিক নয়। হ্যাঁ, বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে আনন্দ ফুর্তির অফুরন্ত সুযোগ,কিন্তু এই ফুর্তির মাঝে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আসল উদ্দ্যেশ্য হারিয়ে গেলে চলবেনা। এখানে জ্ঞানের চর্চা যেমন হয় তেমনি জ্ঞানের সৃষ্টিও হয়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সাফল্য অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হলো প্রথম থেকেই ক্লাসে মনোযোগী থাকা,স্যারদের লেকচার গুলো অনুসরণ করা এবং সেই অনুযায়ী পড়ালেখা করা। আরেকটি দরকারি দিক হলো গ্রুপ স্ট্যাডি। গ্রুপ স্ট্যাডির মাধ্যমে নতুন নতুন আইডিয়া পাওয়া যায়। নিজের জানার পরিধিকে বৃদ্ধি করার পাশাপাশি মুক্তমনের চর্চা করাটাও খুব জরুরি।”
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে স্বপ্নের পথে সঠিকটাই বেছে নিতে হবে বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আলেয়া আক্তার আঁখি।তিনি বলেন, একজন ছাত্র যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় তখন থেকেই সে সম্পূর্ণ স্বাধীন হয়ে যায়। আর তা যদি হয় জাবি’র মতো আবাসিক ক্যাম্পাস,তাহলে তো কথাই নেই! কারো স্বাধীনতায় কেউ হস্তক্ষেপ করবে না। শিক্ষক, ক্লাসরুম, লাইব্রেরি আর ল্যাবরেটরি বাইরে অপার হাতছানিতে ডাকবে সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি সবুজ ক্যাম্পাসের প্রাণ-প্রকৃতি, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, সংস্কৃতি চর্চার অনেক অনেক সংগঠন- যা তরুণ কোমল প্রাণগুলোকে দেশের দক্ষ সেবক করে তুলতে প্রস্তুত করে। আছে সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চার অবরিত সুযোগ ও সংগঠন যা গবেষক ও ভিন্ন দৃষ্টির মানুষ তৈরি করবে। অপরদিকে অপরাজনৈতিকতা, অপরাধপ্রবণতার অনেক অনুষঙ্গও সহজলভ্য। এই উন্মুক্ত প্রান্তর থেকে তাকে বেছে নিতে হবে কোনটি সে করতে চায়। মনে রাখতে হবে মেধার প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়েছে। এখন নিজেকে গড়ার সাথে সাথে পরিবার,সমাজ ও দেশের দায়িত্ব নিতে হবে। তাই স্বপ্নের সুদৃঢ় ভিত্তি প্রথম বর্ষ থেকেই গড়ে তুলতে হবে।”
তবে একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি সৃজনশীল কাজে সম্পৃত্ততা বাড়ানোর ব্যাপারে আগ্রহী হওয়ার পরামর্শ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী মোঃ মুজাহিদুল ইসলাম এর। তিনি বলেন, হাজারো প্রতিকূলতা পেরিয়ে ভার্সিটি এডমিশন নামক বাদ দেওয়ার পরীক্ষায় যারা সফলভাবে টিকে গেছে তারা নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যবান এবং ব্যতিক্রম।সুবিস্তৃত এক অপার সম্ভাবনা ছড়িয়ে আছে নবাগত নবীণদের চোখেমুখজুড়ে।এটাকে ধরে রাখাটাই ফ্রেশারদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ক্যাম্পাসজীবনকে শুধু ঘুরাফিরা মজামাস্তির ক্ষেত্র হিসেবে না নিয়ে বরং জীবন স্বপ্নপূরণে বদ্ধপরিকর থাকতে হবে। পড়াশুনার সাথে অবশ্যই নিজ নিজ আগ্রহনুযায়ী বিতর্ক, আবৃত্তি, সাংস্কৃতিক,সামাজিক উন্নয়নমূলক সহশিক্ষা কার্যকর্মে নিজেকে যুক্ত করতে হবে কেননা জীবন রেলগাড়ির বহুদূরের পথ একা নয় বরং উপযুক্ত ব্যক্তি সার্কেলের বগিতে করে পেরোতে হয়। বুকের মাঝে লালিত যে অজানা স্বপ্ন এতদূরের পথ তাড়া করে এনেছে তাকে সমুজ্জ্বল রাখার আপ্রাণ চেষ্টাই হোক নবীণদের জীবনের লক্ষ্য।”
আরএইচ/সিএন
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন