ইফতেখার ইসলাম:
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ছাত্র রাজনীতি বিভিন্ন কারণে পুরো দেশজুড়ে আলোচিত-সমালোচিত। এক সময় সবুজ এই ক্যাম্পাসে দাপিয়ে বেড়াতো ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা। ২০১৫ সালের পূর্ব পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে অবস্থান নেয়ার পাশাপাশি ক্যাম্পাসের আশেপাশে কটেজ ও বিভিন্ন বাড়িতে গৃহশিক্ষক হিসেবে থেকে শেকড় গাড়ে ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা। তখন চবি ক্যাম্পাস পরিচিত ছিলো ছাত্রশিবিরের ‘আঁতুড়ঘর’ হিসেবে।
তবে সেই সবকিছু এখন হারিয়ে যাওয়া গল্প বা কোন রূপকথার মতো। সময়ের পরিবর্তনে এসেছে দেশের শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন ; বদলে গেছে চবি ক্যাম্পাসের রাজনীতির হাওয়া৷ মূলত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্রশিবির ও বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর রাজনীতি পরিলক্ষিত হয়। তার মধ্যে বর্তমানে একক আধিপত্য বিস্তার করে ক্যাম্পাসের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে ছাত্রলীগ। আর ছাত্রশিবির ও ছাত্রদল অস্ত্বিত্ব রক্ষার লড়াইয়েও যেন অনেক মাইল পেছনে! তবে নিজেদের গতিশীলতা ধরে রেখেছে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো। ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, দলীয় কর্মসূচিতে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছাত্রলীগ। আবাসিক হলগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে তারা। হলগুলোতে সিট বরাদ্দের ব্যাপারেও বড় ভূমিকা পালন করে ছাত্রলীগ।
এইদিকে দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগের রাজনীতি একক আধিপত্য বিস্তার করার বেড়েছে অন্ত:কোন্দল ও বিভক্তি; জন্ম নিয়েছে সামাজিক সংগঠনের ‘ছদ্মবেশ’ রাজনৈতিক গ্রুপ, উপ-গ্রুপ। জানা গেছে, একটি দুটি নয় বর্তমানে চবি ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নয়টি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। আবার এ গ্রুপগুলো দুই ভাগে বিভক্ত। একপক্ষ শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী, অন্যপক্ষ সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী। গ্রুপগুলো ‘সিক্সটি নাইন’, ‘সিএফসি’, ‘বিজয়’, “বাংলার মুখ’ ‘একাকার’, ‘কনকর্ড’, ‘ভার্সিটি এক্সপ্রেসে (ভিএক্স)’, ‘আরএসে’ ‘উল্কা’ হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত। আর নিজেদের পেশিশক্তি প্রদর্শনে তুচ্ছ ঘটনায় এইসব গ্রুপ, উপ-গ্রুপ জড়িয়ে পড়ে সংঘাতে। সেসব সংঘাতে পার হয়ে যায় কয়েক দিন। আর এতে রক্তাক্ত হয়ে অনেককে দিনের পর দিন পার করতে হয় হাসপাতালের বিছানায়। আবার কাউকে পোহাতে হয় মামলার ঝামেলাও। এ যেন তিলে তাল!
অস্তিত্ব সংকটে চবি ছাত্রদল:
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা দাপিয়ে বেড়ালেও মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভেঙ্গে যায় তাদের মেরুদণ্ড। বিক্ষিপ্তভাবে মাঝে মধ্যে তাদের ক্যাম্পাসে দেখা গেলেও ছাত্রলীগের ভয়ে প্রকাশ্যে কোনো কর্মসূচি পালন করেননি। ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগের প্রভাবে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে চবি শাখা জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। গত ৮ বছরের বেশি সময় ধরে ছাত্রদলের কোনো কার্যক্রমই নেই চবি ক্যাম্পাসে। বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচিগুলো পালিত হয় লুকোচুরি করে।ক্যাম্পাসের বাহিরে চট্টগ্রাম বা চবির এক নম্বর গেইট এলাকায় হুটহাট করে কর্মসূচী শেষ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হচ্ছে চবি ছাত্রদলকে। এছাড়া শাখা ছাত্রদলের দুর্বলতার কারণে বিভিন্ন সময় সংগঠনের স্বার্থে একনিষ্ঠভাবে আন্দোলন সংগ্রামে নিয়মিত উপস্থিত থাকার কারণে অনেকে ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন। অথচ, সংগঠনের পক্ষ থেকে কঠোর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। শুধুমাত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস ও প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দায় সারে সংগঠনটি। যা সংগঠনটির ভঙুর অবস্থার প্রমাণ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
ক্যাম্পাস সূত্রে জানা যায়, ছাত্রদলের কোনো কর্মীকে হল থেকে বের করে দিলে অথবা ক্যাম্পাস মারধর করা হলেও দলের পক্ষ থেকে কঠোর কোনো প্রতিবাদ করার শক্তি নেই। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, এমন ছাত্রদলই চায় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ। কারণ, ভয় দেখানোর আগেই প্রতিপক্ষ ভীত। ছাত্রলীগের একাধিক নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে এমন মন্তব্যই পাওয়া যায়। এছাড়া ২০১৬ সালের অক্টোবরে দীর্ঘ ছয় বছর পর খোরশেদ আলমকে সভাপতি ও শহীদুল ইসলামকে সাধারণ সম্পাদক করে শাখা ছাত্রদলের ৬৯ সদস্য বিশিষ্ট আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। পরে ২০১৭ সালের ১৮ মে ২৪৩ জনের একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় সংসদ। আর তা নিয়েও আছে নানান তর্ক-বিতর্ক।
অধিকার আদায়ে সোচ্চার বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো:
চবিতে বামপন্থি চারটি ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্রফ্রন্ট (জাসদ) ও ছাত্র ফ্রন্টের (মার্কসবাদী) তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। এই চার ছাত্র সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সমস্যা এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ে সোচ্চার হলেও নিজেদের এককভাবে কোনো কর্মসূচি নেই। প্রগতিশীল ছাত্রজোটের ব্যানারে তাদের আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে। এসব বাম সংগঠনের হাত ধরে বড় ধরনের আন্দোলনও হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্ধিত ফি প্রত্যাহার, শাটলের বগি বাড়ানোর দাবি, শিক্ষার মানোন্নয়ন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রতিবাদ, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদ ও ছাত্রসংসদ নির্বাচনের দাবিতেও আন্দোলন করেছে বাম ছাত্রসংগঠন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব সংগঠনের দাবিতে কর্ণপাত করে না বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আবার এই ছাত্র সংগঠনগুলোতে কর্মীর সংখ্যাও খুব বেশি নয়। কিন্তু প্রতিবাদ করতে, রাস্তায় নামতে কার্পণ্য করেন না বাম নেতাকর্মীরা। আর এই সব আন্দোলন সংগ্রামে মাঝে মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় পুলিশ ও ছাত্রলীগ।
চবি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি গৌঁরচাঁদ ঠাকুর বলেন, দীর্ঘদিন ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় সবক্ষেত্রে একধরনের স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। আমরা চাচ্ছি অতীতের ন্যায় শিক্ষার্থী ও দেশের স্বার্থরক্ষায় কাজ করে যেতে। এক প্রশ্নের জবাবে ছাত্র ইউনিয়নের এ নেতা বলেন, আমাদের এখানে কেউ বিশেষ ফায়দা লুটতে আসে না। সবাই আসে ছাত্রদের অধিকার আদায়ে কাজ করে যেতে। সেজন্য আমাদের কর্মীর সংখ্যা কম।
চবি শাখা ছাত্রদলের সভাপতি খোরশেদ আলম বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিতে সচল রয়েছি। ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষার সময় আমরা কর্মসূচী পালন করেছি। তিনি বলেন, ক্যাম্পাসে কোন কর্মসূচী পালন করতে আমাদের প্রতিনিয়ত নানান বাঁধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে৷ ছাত্রলীগ আমাদের উপর জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠান করার সময় হামলা করেছে। আমাদের ছেলেদের পরীক্ষা দিতে দেয় নি। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ বরাবর অভিযোগ দিলেও তারা নিরব ছিলো। তিনি বলেন, আমাদের নতুন কমিটি শিঘ্রই আসছে। আশা করছি আমাদের কার্যক্রম আরও প্রাণবন্ত হবে।
এবিষয়ে চবি ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেল বলেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ একটি গৌরবোজ্জ্বল ছাত্র সংগঠন৷ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক সময় আমাদের অবস্থান কিছুটা খারাপ থাকলেও এখন আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছি। আর এসবের পেছনে একমাত্র অবদান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তিনি বলেন, আমরা আগেও ছাত্রদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট ছিলাম এখনো আছি।
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন