বৃহস্পতিবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

বাতাসের বিষে বিপন্ন পরিবেশ হুমকির মুখে জনস্বাস্থ্য

রবিবার, সেপ্টেম্বর ৫, ২০২১

প্রিন্ট করুন
environment pollution 1

শারমিন রিমা>> ‘দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ!- কবি নজরুলের কবিতার মতই পরিবেশের কাছে দেনা বেড়েছে। তাই ঋণের বোঝা কমাতে মৃত্যুর দুয়ারে মিছিল বাড়ছে, তবে তা ধীরে ধীরে তাও বাতাসের সংস্পর্শে। বিশ্বের শীর্ষ দূষিত বায়ুর দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম প্রথমদিকে। সেইসাথে দিনকে দিন বাতাসে বাড়ছে ক্ষতিকর উপাদান, এ দূষিত বাতাস নীরব ঘাতকের মতো চুপিচুপি কেড়ে নিচ্ছে অসংখ্য প্রাণ। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন-নগরায়ন ও যানবাহনের কালো ধোঁয়া এবং নিমার্ণকাজে যথাযথ দূষণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা না নেওয়ায় বাতাসে মিশছে ক্ষতিকর সব উপাদান। যার কারণে প্রতিদিন খারাপ হচ্ছে বাতাসের মান। প্রতিবছর বাতাসে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর উপাদান পার্টিকুলেট ম্যাটার (পিএম) বা অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণার উপস্থিতি বাড়ছে ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ হারে। বাতাসে দূষিত বস্তুকণার পরিমাণ এতই বেড়ে গেছে যে, তা খুবই অস্বাস্থ্যকর। যেখানে বায়ুর মানমাত্রার সূচক ১০০-এর ওপরে উঠলে তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক হয়ে ওঠে। সেখানে বাংলাদেশের বায়ুমান কখনও কথনও ৩৫০ এর উপরে চলে যায় যা অতিমাত্রায় বিপদজ্জনক। বিশ্বের জনসংখ্যার মধ্যে ৯১ শতাশং মানুষ এমন জায়গায় বাস করে যেখানে বাতাসের গুণমান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর নির্দেশিকা সীমা ছাড়িয়ে গেছে। দূষিত বাতাসে সূক্ষ্ম কণার সংস্পর্শের ফলে প্রতিবছর সারাবিশ্বে ৭০ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু হয়।

শ্বাস নিতে কষ্ট, বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, কাশি, সাধারণ শ্বাসকষ্ট, এবং চোখ, নাক এবং গলা জ্বালা সহ ফুসফুসের টিস্যুর ক্ষতি, ক্যান্সার, প্রাথমিক মৃত্যু এবং শ্বাসকষ্টজনিত অসুস্থতা যেমন হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস এবং এমফিসেমার বিকাশ এসব হচ্ছে বায়ু দূষণের মান মাত্রাতিরিক্ত হওয়ার কারণে জনস্বাস্থ্যে স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব, যা পরবর্তীতে মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

বায়ু দূষণের প্রভাব:
১) ফুসফুসের ক্যান্সারে মৃত্যু ২৯ শতাংশ
২) শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণে মৃত্যু ৭ শতাংশ
৩) স্ট্রোকে মৃত্যু ২৪ শতাংশ
৪) করোনারি হৃদরোগে মৃত্যু ২৫ শতাংশ
৫) দীর্ঘস্থায়ী প্রতিবন্ধক পালমোনারি রোগে (সিওপিডি)মৃত্যু ৪৩ শতাংশ

পরিবেশ আইন অনুযায়ী, বাতাসে ক্ষুদ্র বস্তুকণা বা ‘পিএম ২.৫’-এর মানমাত্রা হচ্ছে প্রতি কিউবিক মিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম। ‘পিএম ১০’ বা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণার মানমাত্রা ৫০ মাইক্রোগ্রাম। বিশ্বের বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণকারী যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের পর্যবেক্ষণ (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স) অনুযায়ী, বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাসের বস্তুকণার পরিমাণ (পিপিএম) যদি শূন্য থেকে ৫০ এর মধ্যে থাকে, তাহলে ওই বাতাসকে বায়ু মানের সূচকে (একিউআই) ‘ভালো’ বলা যায়। এই মাত্রা ৫১-১০০ হলে বাতাসকে ‘মধ্যম’ মানের এবং ১০১-১৫০ হলে ‘বিপদসীমায়’ আছে বলে ধরে নেওয়া হয়। আর পিপিএম ১৫১-২০০ হলে বাতাসকে ‘অস্বাস্থ্যকর’, ২০১-৩০০ হলে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’এবং ৩০১-৫০০ হলে ‘অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর’ বলা হয়। বায়ুর বৈশ্বিক মানদণ্ডকে অনুসরণ করে পরিবেশ অধিদপ্তর বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ করে। বায়ুতে ক্ষুদ্র বস্তুকণা ও চার ধরনের গ্যাসীয় পদার্থ পরিমাপ করে এ সূচক তৈরি করা হয়। বাতাসে ভাসমান বস্তুকণার (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম) পরিমাপ করা হয় প্রতি ঘনমিটারে মাইক্রোগ্রাম (পিপিএম-পার্টস পার মিলিয়ন) এককে। এসব বস্তুকণাকে ১০ মাইক্রোমিটার ও ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাস শ্রেণিতে ভাগ করে তার পরিমাণের ভিত্তিতে ঝুঁকি নিরূপণ করেন গবেষকরা। প্রতিদিনের বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা একিউআই সূচক একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটুকু নির্মল বা দূষিত সে সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দেয় এবং তাদের জন্য কোন ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হতে পারে তা জানায়।

বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেইস) প্রকল্প থেকে দেশের আটটি শহরের বায়ুর মান প্রতিদিন পর্যবেক্ষণ করা হয়। তাতে দেখা যায় ঢাকার পাশাপাশি গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, বরিশাল ও খুলনা শহরের বায়ুর মান মারাত্মক ও খুব অস্বাস্থ্যকর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর হলো রাজধানী ঢাকা। এরপর রয়েছে গাজীপুর। গত কয়েকদিনে চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা কিছুটা কম দূষিত শহর হলেও এর বায়ু মানমাত্রার চেয়ে খারাপ, অর্থাৎ আশঙ্কাজনক।

এদিকে, একিউআই মান ২০১ থেকে ৩০০ হলে স্বাস্থ্য সতর্কতাসহ তা জরুরি অবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয়। এ অবস্থায় শিশু, প্রবীণ এবং অসুস্থ রোগীদের বাড়ির ভেতরে এবং অন্যদের বাড়ির বাইরের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখার পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে। বাতাসের এই দূষণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ। ফুসফুসে ক্যানসার ও কিডনি বিকলের মতো রোগ ছড়াচ্ছে ব্যাপকভাবে। একিউআই স্কোর ১৫১ থেকে ২০০ হলে নগরবাসীর প্রত্যেকের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পড়তে পারে, বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও রোগীরা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। একিউআই সূচকে ৫০ এর নিচে স্কোর থাকার অর্থ হলো বাতাসের মান ভালো। সূচকে ৫১ থেকে ১০০ স্কোরের মধ্যে থাকলে বাতাসের মান গ্রহণযোগ্য বলে ধরে নেয়া হয়। একিউআই স্কোর ৩০১ থেকে ৫০০ বা তারও বেশি হলে বাতাসের মান ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা হয়।

উল্লেখ্য, বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করা সংস্থা আইকিউএয়ার-এর এয়ার ভিজ্যুয়াল পরপর টানা দুই বছর ২০১৯ ও ২০২০ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বস্তুকণা বা পার্টিকুলেট ম্যাটার (পিএম) ২.৫ মানের ওপর ভিত্তি করে প্রকাশিত প্রতিবেদনে নিকৃষ্ট বায়ুর শহরের তালিকায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা অবস্থান প্রথমে রয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ বাচাঁও আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, ‘বায়ুদূষণের কারণে আমাদের মত ঘনবসতিপূর্ণ দেশে কতটা মানবিক বিপর্যয় তৈরি করছে তা কেউ ভাবতেও পারছে না। এমন একটা অবস্থা হয়েছে যেন কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। এর কারণে যে কত কত মানুষের অকালমৃত্যু ও স্বাস্থ্যক্ষতি হচ্ছে আর তার সাথে যে মানুষের অর্থনৈতিক ক্ষতিও হচ্ছে তা অপূরণীয়। আমার মনে হয় এসকল কারণে বিদেশি বিনিয়োগেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

এ প্রসঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের সহকারী পরিচালক মিয়া মাহমুদুল হক চলমান নিউইয়র্ককে বলেন, আমাদের তিনটি স্টেশন থেকে প্রতিদিন বায়ুমান পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং যারা বা যেসকল প্রতিষ্ঠান বায়ু দূষণ করে পরিবেশের ক্ষতি করছে তাদের আইনের আওতায় এনে জরিমানা করা হয়।

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন