মোহাম্মদ আলী: গণতন্ত্রের চর্চা বাংলাদেশে কোন অবস্থাতেই আর নেই বলে অভিযোগ করেছেন আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির যুগ্ম আহবায়ক অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম।
তিনি বলেছেন ‘বাংলাদেশে সরকার ও রাজনৈতিক দল আছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক চর্চার সবচাইতে বড় কথা সুষ্টু নির্বাচনী ব্যবস্থা, মানুষ তার নিজের পছন্দ অনুযায়ী প্রতিনিধিদেরকে নির্বাচিত করবে। বাংলাদেশে গত দুই টার্ম থেকে কোন নির্বাচন সুষ্টভাবে হয়নি। একটা নির্বাচন জাতীয়ভাবে যেটা হয়েছিল, সেখানে বিনা প্রতিদ্বন্ধীতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন অধিকাংশ সংসদ সদস্য। পরবর্তী যে নির্বাচন হয়েছে, সেটাকে বলা হয়েছিল, লাইলাতুল ইলেকশন; রাতের বেলার ইলেকশন। মধ্যরাতের আগেই ভোট দেয়াটা সম্পন্ন হয়েছিল। মূলত এ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থা একেবারেই ধ্বংস হয়ে গেছে।’
সম্প্রতি আমেরিকার নিউইয়র্কে গণমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তাজুল ইসলাম এসব কথা বলেন।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বাংলাদেশ সুপ্রিম কার্টের এ আইনজীবী বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদের একজন সদস্য থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত মানুষ বুঝতে পেরেছে যে, তাদের আসলে ভোট দেয়ার জায়গাটি নেই এবং তাদের ভোট কোন ম্যাটার করে না। মানুষের ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার কোন প্রয়োজন হচ্ছে না। কারণ, তারা যাওয়ার আগেই ভোটগুলো কাস্ট হয়ে যাচ্ছে। মানুষ ভোট কেন্দ্রে না গেলেও দিন শেষে ভোট কেন্দ্র থেকে ফলাফল ঘোষণা করা হচ্ছে যে, বিপুল সংখ্যক ভোট পেয়ে একজন প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন এবং তার প্রতিদ্বন্ধী প্রার্থীরা চার ভোট, পাঁচ ভোট পেয়েছেন। এ বিষয়গুলো মানুষের সামনে আসার পর মানুষ বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি সম্পূর্ণভাবে তাদের আস্তাটা হারিয়েছেন। যে কারণে তারা মনে করেন, ভোট কেন্দ্রে যাওয়টা একটি অনর্থক বিষয় এবং তারা ভোট কেন্দ্রে যাচ্ছেন না।’
তিনি মনে করেন, এ যে রাজনীতির এবং রায় প্রকাশের ব্যাপারে মানুষের অনীহা, হতাশা, এটা একটা রাষ্ট্র ও জাতির জন্য অত্যন্ত বিপদজনক।’
তাজুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের মানুষ যদি রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে কোন কিছু বলতে না পারে, কোন কার্যক্রমে অংশ না নেয়, তাহলে সে রাষ্ট্রটি কখনোই তার সার্বভৌমত্ব নিয়ে ঠিকে থাকতে পারে না। এটার প্রভাব গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থার সব জায়গাতেই কিন্তু পড়ে। মানুষ ভোট কেন্দ্রে যাচ্ছে না, কারণ তারা মনে করে বর্তমান সরকার যে কোন উপায়ে নির্বাচন ব্যবস্থাকে তাদের পক্ষে নিয়ে যায়। সুতরাং, মানুষের এ হতাশা বোধের কারণে রাষ্ট্রীয় জীবনের অন্যান্য সেক্টর বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগের বিভিন্ন জায়গায় এবং সরকারি অফিস-আদালতে, মানুষের দৈনন্দিন কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে মানুষ মনে করে যে, আইন মান্য করারটা বোধ হয়, প্রয়োজন নাই। কারণ, এ দেশে সরকারের নির্বাচন ব্যবস্থাটা যেহেতু বৈধভাবে হচ্ছে না এবং তারা মনে করেন, এক ধরনের অবৈধভাবে এ সরকার ক্ষমতায় থাকছে। সে কারণে তাদের মধ্যেও আইন মানার প্রবণতাটা কমে যাচ্ছে। যেটার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই, সরকারের যে কোন কার্যক্রমে টেন্ডার প্রক্রিয়া দুর্নীতির পাহাড় সম বা সাগর সম দুর্নীতির রিপোর্ট প্রতিনিয়ত আসছে। একটা বালিশের তুলার খরচ দেয়া হচ্ছে ছয় হাজার টাকা, একটা এলইডি বাতির দাম হচ্ছে ৩৭ হাজার টাকা, একটা পর্দার দাম ৩৭ হাজার টাকা। দুর্নীতির এ কাহিনীগুলো এটা হয়তো খুবই সামান্য মিডিয়াতে আসছে, কিন্তু পেছনে বিপুল সংখ্যক দুর্নীতির খবর কিন্তু আমরা পাচ্ছি না।’
তাজুল ইসলাম আরো বলেন, ‘এ দেশের তরুণ প্রজন্ম, এ দেশের মানুষ হতাশার মধ্যে ডুবে আছে। মানুষ যখন রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করবে না, তখন বাইরের কেউ চাইলে সার্বভৌমত্বকে হরণ ও কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। ৩০ লাখ মানুষের রক্ত ও সংগ্রামের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে, এ স্বাধীনতাটা মানুষ আজো পেল না। স্বাধীনতার অঙ্গীকারটা ছিল, একটা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। যেখানে সাম্য, মানবিক বোধ, সামাজিক সুবিচার- এ তিনটা কথা স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রে ছিল। যা বাংলাদেশের মানুষ আজো পাই নি। স্বাধীনতা নামক যে চেকটি বাংলাদেশের মানুষ ১৯৭১ সালে পেয়েছিল, সে চেকটি ৫০ বছর পরও বাংলাদেশের মানুষ নগদায়ন করতে পারেনি।’
সরকারি দলের বিরাজনীতিকরণ ও মানুষকে ভোট থেকে দূরে তাড়িয়ে দেয়ার বিষয়ে বিরোধী দলগুলো তাদের ভূমিকা যথাযথভাবে রাখতে পারেনি উল্লেখ করে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘একটা স্বৈরশাশনের বিরুদ্ধে অথবা এ জাতীয় রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়া, সেগুলোর বিরুদ্ধে যেভাবে রাজনীতি হওয়া উচিত ছিল, সেটা বিরোধী দলের লোকেরা করতে পারেনি। গত দশ বা ১৪ বছরে বাংলাদেশের বিরোধী দলের আন্দোলন, সংগ্রমাম, রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলোর অধিকাংশই ছিল দলের নেতানেত্রীদের মামলা প্রত্যাহার অথবা তাদের কারামুক্তি, বিচার থেকে বাঁচানো। এসব ব্যাপার রাষ্ট্রের মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। খালেদা জিয়া অন্যায়্যভাবে জেলে ছিলেন, সরকারের অনুকম্পায় বের হয়েছেন। খালেদা জিয়াকে জেল থেকে বের করার জন্য বিএনপি তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করছে, তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য তারা সর্বশক্তি প্রয়োগ করছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের জন্য খালেদা জিয়ার মুক্তি অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতটা করোনাা টিকা গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের স্বাস্থ্য সেবা যত গুরুত্বপূর্ণ, বেগম জিয়ার মুক্তি একজন নাগরিকের কাছে তত গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিরোধী দলগুলো জনমুখী রাজনীতি করতে পারেনি। একইভাবে ইসলামী দলগুলো ইসলামের বিপ্লবের কথা বলছেন। কিন্তু নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার নিশ্চিত করা, বাক স্বাধীনতার নিশ্চিত করা, তাদের দৈনন্দিন জীবনে মসৃণ করার চেষ্টার তাদের রাজনীতির মধ্যে ছিল না।’
এবি পার্টি গঠন করা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বাস্তবতা উপলদ্বী করে আমরা ২০১৯ সাল থেকে জন আকাঙ্খার বাংলাদেশ ফ্ল্যাটফর্ম নিয়ে কাজ করছি। ২০২০ সালে ২ মে ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি’ বা এবি পার্টি নামে রাজনৈতিক দল ঘোষণা করি। এর প্রেক্ষাপট হচ্ছে, বাংলাদেশে ২০০ এর উপরে রাজনৈতিক দল থাকার সত্বেও মানুষ রাজনীতির উপর আস্থা রাখেনি। বাংলাদেশের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। বলতে পারেন পদ্মা সেতু হচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্রের যে পিলার যথা গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সুশাসন- এ পিলারগুলো দিন দিন খসে যাচ্ছে, ধসে পড়ছে। অন্য দিকে, ফ্লাইওভার বা পদ্মা সেতুর পিলারগুলো নিয়ে আমরা ব্যস্ত থাকছি। এটা রাষ্ট্রের জন্য শুভ নয়। পদ্মা সেতুর পিলারের চেয়ে বড় প্রয়োজন গণতন্ত্র, সুশাসন, মানুষের অধিকার ও বাক স্বাধীনতা থাকা। সেটা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারেনি বলে আমরা এবি পার্টি করেছি।’
বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইনালের বিচারের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘এটি এখন অতীত। কারণ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইনালে আমি আমার ক্লায়েন্টদের উপস্থাপন করেছি, তাদের পক্ষে যা করেছি, তা প্রফেশনাল দায়িত্ববোধ থেকে। আমার যোগ্যতা অনুযায়ী সর্বোচ্চটা দেয়ার চেষ্টা করেছি এবং সেখানে আমার প্রফেশনালিজমের কোন ঘাটতি ছিল না। সে বিচারগুলো শেষ হয়েছে এবং এফিলেট ডিভিশন থেকে অধিকাংশ আপিলও নিষ্পত্তি হয়েছে। কিছু আপিল এখানো নিষ্পতির অধীন রয়েছে। আমি এখন ওই মামলাগুলোর সাথে সম্পৃক্ত নই। ২০১৫ সালের পর থেকে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনাল কিংবা তার বিচার প্রক্রিয়া, যেটা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে এখনো পেন্ডিং আছে, সেগুলোর সাথে আমি সম্পৃক্ত নই। এ ব্যাপারে আমি নতুন কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করছি না। কারণ আজকের বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটি এখন আর বড় ইস্যু নয়। সে সময়ে যেটা বলার দরকার ছিল, আমি যা বলেছি, সেটি আমি আজো মনে করি, সঠিক করেছি এবং সেটা ছিল আমার পেশাগত দায়িত্ব। এর সাথে আজকের রাজনীতির কোন সম্পর্ক নেই।’
বাংলাদেশের তরুণ যুবকদের উদ্দেশ্য তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে বিরাজনীতিকরণ এবং রাজনীতির প্রতি যে হতাশাবোধ তৈরি হয়েছে, সেখান থেকে এবি পার্টি আপনাকে বের করে আনতে চায়। আমরা এমন একটি রাষ্ট্র চাই, যেখানে মানুষকে তার যোগ্যতা দিয়ে বিচার করা হবে। তার বিশ^াস, রাজনৈতিক ও পিতার পরিচয়ে নয়।’
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন