মোহাম্মদ আলী: অসহায় বৃদ্ধা মনিবালা শীল। বয়স ৭০ বছর। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মারা গেছেন তার শ্বশুর, স্বামী ও দেবর। একমাত্র কন্যা থাকেন শ্বশুর বাড়িতে। আয়-রোজগারের কেউ নেই। বয়স ৬২ বছর পার হলেও পান না বয়স্ক ভাতা। বিধবা ভাতা ছাড়া পান না আর কোন সরকারী সহযোগিতা। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবার হিসেবেও পান না কোন সরকারী সুযোগ-সুবিধা। মুক্তিযুদ্ধের পর স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখল করে নেন তার শ্বশুরের সহায়-সম্পত্তি। খবর নেন না এলাকার কোন জনপ্রতিনিধিও। বর্তমানে পেলে খান, না পেলে উপোস থাকেন। মুক্তিযুদ্ধে স্বামী-স্বজন হারিয়ে এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ের মনিবালা শীল।
চট্টগ্রাম জেলার মীরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ থানার ওসমানপুর ইউনিয়নের পাতাকোট গ্রামের পাতাকোট জগন্নাথ ধামের/পাতাকোট দূর্গা মন্দিরের পাশে ছোট একটি বেড়ার ঘরে থাকেন মনিবালা শীল। তার বিয়ের দুই বছর পর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। তার শ্বশুর নিবারন চন্দ্র শীল, স্বামী গুনাই চন্দ্র শীল ও এক দেবর রঞ্জন চন্দ্র শীল শহীদ হয়েছেন ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে। আরেক দেবর মনা রঞ্জন শীল তখনই চলে গিয়েছিলেন পাকিস্তানে। এক মেয়ে ফটো রানী শীল থাকে নোয়াখালীর শ্বশুর বাড়িতে। ফলে তাকে দেখার কেউই নেই বর্তমানে।
জানা গেছে, মনিবালা শীলের শ্বশুর গুনাই চন্দ্র শীলের দুই-তিন খানিরও বেশি জায়গা-জমি ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পর সেসব জায়গা-জমি গ্রামের প্রভাবশালীরা দখল করে নেন। ফলে মনিবালা শীলের সহায়-সম্পত্তি বলতে বর্তমানে কিছুই নেই। অন্যের সাহায্য সহযোগিতা নিয়েই তিনি চলেন। গ্রামে কোন পরিবারে বাচ্চার জন্ম হলে তার চুল কামাই করে ১০০-১৫০ টাকা পান।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে মনিবালা শীল বলেন, ‘পেলে খাই, না পেলে খাই না। কোন আয়-উন্নতি নাই। যতক্ষণ রদ চলে, ততক্ষণ খাই। আমার কোন অভিভাবক নাই। তাই সরকারকে বলারও কেউ নাই। অসুখ হয়ে পড়ে থাকলে, খাওয়ার কিছু থাকে না, দেখা-শোনার কেউ থাকে না।’
নাম না বলার শর্তে পাতাকোট গ্রামের এক দোকানদার বলেন, ‘নিজের ঘরের আশ-পাশে মনিবালা শীলের শ্বশুরের অনেক জায়গা-জমি ছিল। সে সব জায়গা-জমি এখন আশ-পাশের স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে। কেউ কিছু বলার সাহস করেন না। বর্তমানে কেউ সহযোগিতা করলে সেটা দিয়েই মনিবালা শীল জীবন নির্বাহ করেন। তার একটা মেয়ে আছে, সেও অসুস্থ।’
এ নিয়ে পাতাকোট গ্রামের মেম্বার মুজিবুল হক বলেন, ‘জায়গা-জমির বিষয়গুলো অনেক আগের কথা। এ বিষয়ে কয়েক বার সালিশ হয়েছিল। মনিবালা শীলের নামে ৫০০ শতক জায়গা আছে। বাকি জায়গাগুলো যাদের দখলে আছে, তাদের কাছেও কেনার দলিল আছে। আর মুক্তিযুদ্ধে স্বামী-স্বজন হারা হিসেবে সরকারী সুযোগ-সুবিধার বিষয়টা তো মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, সংসদ আছে। উনার দেখবেন। অন্য দিকে, আমার গ্রামের বয়স্ক মানুষ অনেক আছে। তালিকাভুক্তির জন্য মনিবালা শীলকে এক বার কাগজপত্র নিয়ে আসতে বলেছিলাম, আসেনি। পরে আমাকে আর কখনো বলেও নি।’
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মীরসরাই উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মিনহাজুর রহমান বলেন, ‘জায়গা-জমির বিষয়ে যদি উনি অন্যায়ের শিকার হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি অবশ্যই প্রতিকার পাবেন। মুক্তিযুদ্ধে স্বামী-স্বজন হারা হিসেবে তালিকাভুক্ত হলে তিনি অবশ্যই সরকারী সুযোগ-সুবিধা পাবেন। আগে তালিকাভুক্ত হতে হবে। উনাকে (মনিবালা শীল) জাতীয় পরিচয় পত্র নিয়ে আমার কাছে আসতে বলবেন, আমি বিষয়টি দেখব। আর সমাজসেবা কার্যালয় থেকে প্রতি বছর বয়স্ক ভাতার জন্য আবেদন আহবান করা হয়। যারা বয়স্ক ভাতার যোগ্য, তাদের তালিকা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা সমাজসেবা কার্যালয়ে জমা দেন। ওই এলাকার চেয়ারম্যান ও সদস্য হয়তো মনিবালা শীলের নামটা জমা দেন নি, তাই তিনি বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন না। এখন আমি যেহেতু জানতে পারলাম, বিষয়গুলো আমি দেখব।’
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন