শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

শিরোনাম

গাছ নিয়ে যার সংগ্রাম, তিনি গাছ বন্ধু সাহেলা আবেদিন

সোমবার, সেপ্টেম্বর ২০, ২০২১

প্রিন্ট করুন
গাছ বন্ধু সাহেলা আবেদিন 1
গাছ বন্ধু সাহেলা আবেদিন 1

শারমিন রিমা: সময়টা ২০০৯ ‍সালের ২৫ মে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও খুলনা উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’৷ ২০০৭ সালে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর এই ঘূর্ণিঝড় ভারতের ১৪৯ জন ও বাংলাদেশের ১৯৩ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়৷ সেসময় বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে উপকূলের প্রায় তিন লাখ মানুষ গৃহহীন হয়৷ জলবায়ু পরিবর্তন, ঘনঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বায়ু দূষণ, নির্বিচারে গাছ কেটে ফেলায় শহরতলীর অলিতে-গলিতে সবুজ যেন বিলীন হতে থাকে। পরিবেশের এই হাহাকার করা গুমোট হাওয়া বইতে থাকে চট্টগ্রামের এক গাছ বন্ধুর মনে। তিনি সাহেলা আবেদিন। পরিবেশের বিপর্যয়  ক্রমাগত তাকে আরও ভাবিয়ে তোলে।  শেষমেষ ২০১১ সালে রীতিমতো তিনি একাই ‘সবুজায়নের আন্দোলনে’ কোমর বেঁধে মাঠে নেমে গেলেন। ঘরে ঘরে গাছ লাগানোর আহবান জানাতে শুরু করেন। এরইমধ্যে শুরু করেন ‘কনসেপ্ট ফর নেচার’ নামের ব্যতিক্রমী আয়োজন। সেই থেকে শুরু। 

পরিবেশের প্রতি মানুষের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে গড়ে তোলেন ‘তিলোত্তমা চট্টগ্রাম’। ১০ বছর ধরে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গাছ নিয়ে একা আন্দোলনে সাহস দেখিয়েছেন এ গাছ বন্ধু। সমাজের অনেক বাঁকা চোখের কটুকথা উপেক্ষা করেও এগিয়ে চলেছেন সাহেলা আবেদিন। সবুজায়নের আন্দোলনে নেমে গাছ নিয়ে সংগ্রাম করা তিনিই একমাত্র নারী। তাঁর ১০ বছরের পথচলায় অসংখ্য অগণিত গাছ তিনি রোপণ করেছেন, দিয়েছেন উপহার। সেই গাছ বন্ধু সাহেলা আবেদিনের পথচলার গল্প তুলে এনেছে চলমান নিউইয়র্ক। 

কেন এই কাজ করছেন?

এর জবাবে তিনি বলেন- “প্রতিনিয়ত আমরা যেভাবে পরিবেশের ক্ষতি করছি তা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে হুমকির মুখে ফেলছে। যেভাবে আমরা বায়ু দূষণ করছি, নিবির্চারে বন উজাড় করছি তার হিসাবও আমাদের নেই। কিন্তু পরিবেশ রক্ষায় সেই হিসাবে ক’জনই বা গাছ লাগাচ্ছে? আমাদের নিশ্বাস ফেলার জায়গাটুকুও আমরা ধীরে ধীরে নষ্ট করে ফেলছি। এর পেছনে দায়ী যেহেতু আমরাই তাই সেই দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে আমিই উদ্যোগ নিলাম। যখন আমি গাছ লাগানোর এই সংগ্রামের একটা সূচনা করেছি, একটা উদ্যোগ নিয়েছি আমার দেখাদেখি অনেকেই এখন এগিয়ে আসছেন, গাছ রোপণ করছেন। যদিও শুরুর দিকে চলার পথ এতটা সহজ ছিল না। তবে ধীরে ধীরে সকলে এগিয়ে আসছেন এবং আমার এ সংগ্রাম অনেকাংশেই সার্থক বলা যায়।”

এ আন্দোলনের শুরুটা কেমন ছিল?

এমন প্রশ্নের জবাবে সাহেলা আবেদিন বলেন, শুরুর দিকে গাছ লাগানোর পাশাপাশি আমি ছাদবাগান করার জন্য নানানভাবে মানুষকে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছিছিলাম।  তবে এক্ষেত্রে একা কাজ করা কঠিন ছিল। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এই উদ্যোগে আমার সহযোগী ছিল। সেভাবেই আমার ছাদ বাগানের প্রকল্প শুরু হয়েছিল। আমি বিভিন্ন জায়গায় ছাদ বাগান করেছি। বাওয়া স্কুলের ছাদ বাগান আমার করা। যাতে মানুষকে গাছ লাগানোর প্রতি উৎসাহিত করা যায়। সেই লক্ষ্যে তিলোত্তমা চট্টগ্রামের যাত্রা। কারণ ঘরে ঘরে গিয়ে বাগান তৈরি করা আমার একার পক্ষে সম্ভব নয়। সেই চিন্তা থেকেই কাজ শুরু করি। আমাদের উচিত আমাদের জনগণকে এ সম্পর্কে সচেতন করা। কারণ আমরা যদি এক সাথে কাজ করি তবে আমাদের দেশ বাঁচবে, সমাজ বাঁচবে এবং আমরাও থাকব। তাই সেই চেষ্টা এখনও অব্যাহত রেখেছি।’

গাছ নিয়ে এমন ব্যতিক্রমী কাজের অনুপ্রেরণা কোথায় পেলেন?

এ বিষয়ে সাহেলা আবেদিন বলেন, ‘গাছের প্রতি ভালোবাসা ছোট থেকেই ছিল। কিন্তু বিয়ের পর শাশুড়ি মায়ের অনুপ্রেরণায় এ কাজের ভাবনা মাথায় আসে। পরিবেশ রক্ষায় আন্দোলনের শুরুটা না হয় আমার থেকেই হোক। এটি এমন একটি ক্ষেত্র যা সম্পর্কে আগে কেউ এমনভাবে হয়তো ভাবেননি কিন্তু যখন অন্যরা আমাকে দেখেন, তারাই আমাকে  জিজ্ঞাসা করেন, কেন আমি গাছ নিয়ে কথা বলছি? তবে আমি ভাগ্যবান যে আমাকে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়নি। যে কোনও কাজের জন্য আত্মবিশ্বাস, সাহস এবং ধৈর্য থাকা দরকার এবং তা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস রেখেছি। কারও কটু কথায় আমি কখনও দুঃখবোধ করিনি বা কোনও সমালোচনার জন্যও দুঃখিত অনুভব করিনি। আমাকে কাজ চালিয়ে যেতে হবে আর এটাই আমার লক্ষ্য। এই ক্ষেত্রে যখন আমি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাথে যোগাযোগ করছিলাম তাদের থেকে পরিপূর্ণ সহযোগিতা আমি পেয়েছিলাম। যা মানুষকে জানাতে আরও সহজতর করেছে।’

গাছ বন্ধু সাহেলা আবেদিন যেকোনো আড্ডায়, আনন্দ আয়োজনে কিংবা শুভেচ্ছা বিনিময়ে ফুলের পরিবর্তে গাছ উপহার দেন। তার কারণ কি?

এমন প্রশ্নের জবাবে সাহেলা আবেদিন বলেন, ‘ চলতে ফিরতে উঠতে বসতে আমি ফুলের পরিবর্তে গাছ উপহার দেই। আমার মনে হয়, অফিস টেবিলে রাখা একটি গাছ শুধু অক্সিজেনই দেয় না বরং একটা মানুষের ব্যক্তিত্ব-রুচিবোধও বাড়িয়ে তোলে। আর যেকোন ভালো কাজে সম্পৃক্ত থাকার মধ্যেও আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায়। আর তাতেই আত্মতৃপ্তি।’ 

আগামী দিনগুলোর পরিকল্পনা প্রসঙ্গে সাহেলা আবেদিন জানান, ‘ছাদ বাগান নিয়ে কাজ করছি অনেক বছর ধরে। সব সময় বন্ধু -বান্ধব আত্মীয়-স্বজন,পাড়া -প্রতিবেশীদের উৎসাহিত করতাম ছাদ বাগান করার। অনেকে হাসাহাসি- ঠাট্টা করতো। বলতো তুমি যদি নিজে সব লাগিয়ে ফেলো তাহলে কৃষকরা কি করবে? আজ তাদের বলি, দেখ নিজের ছাদ বাগানের সবজি ফল কতটা নিরাপদ যা অন্য জায়গা থেকে পাওয়া যাবে না। আর এই করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে এর গুরুত্ব আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন যার যত টুকু জায়গা আছে সে জায়গা গুলোতে সবজি লাগাতে। শুধু বাগান করা নয়, একটা  সুন্দর সময় কাটানোরও জায়গা হতে পারে। আমি বিশ্বাস করি যে এই শিল্পটি ভবিষ্যতে আমাদের দেশে একটি বিপ্লব তৈরি করবে। মানুষকে যতবেশি জানানো যাবে, যত বলবেন দেখবেন একসময় না একসময় মানুষ এগিয়ে আসবে। যদি এই আহবানে ১০ জনও এগিয়ে আসে তাদের দেখাদেখি বাকিরাও অনুপ্রাণিত হবে। তাই  সকলের কাছে পরামর্শ বেশি বেশি করে গাছ লাগান, নিজে ভালো থাকুন, পরিবার-পরিজনকেও ভালো রাখার চেষ্টা করুন। ‘

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন